২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাহিত্য নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য

সাহিত্য নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য - নয়া দিগন্ত

“আমাকে বলা হয়েছিল, ‘আপনার কবিতা অসাধারণ যেটি আমাদের সংগঠনের নজরে এসেছে। সংগঠনের একান্ত ইচ্ছায় আপনাকে আমরা পদক দিতে মনস্থির করেছি।’ প্রথমে শুনে আনন্দিত হলেও পরের ধাপে বিস্ময়ে থ বনে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে ‘স্বর্ণপদক’ দিতে চেয়েছিলেন। ... এটি পেতে আমাকে নাকি ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে!”

এখানে যে উদ্ধৃতি দেয়া হলো সেটি একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একজন লেখকের স্বীকারোক্তি। আমরা ধরে নিয়েছি, এই উদ্ধৃতির লেখক তেমন বড় মাপের কোনো লেখক নন। বড় বা বিখ্যাত লেখকরা এসব বিষয়ে সচরাচর কথা বলেন না। এড়িয়ে যান এবং এমন ভাব করেন যেন এসব তুচ্ছ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পদক নেয়ার মতো কথিত সাহিত্যিক কবির কোনো অভাব নেই। এমনকি নিছক ফেসবুক গ্রুপের ভার্চুয়াল পদক নিতেও অনেকে মরিয়া। একটি গ্রুপ ঘুরেফিরে প্রায় একই কবি বা লেখকদের পুরস্কৃত করছে, সেটা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারা যায়। এটি হচ্ছে সেই গ্রুপকেন্দ্রিক কবি বা লেখক গোষ্ঠী। যারা গ্রুপের সদস্য তাদেরই সেরা কবি বা সেরা লেখক হিসেবে পুরস্কার দেয়া হয়।

আর পদকটি যদি কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া হয় তাহলে অনেকেই এ জন্য লাইন দিতে হুড়োহুড়ো লাগিয়ে দেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে কোনোভাবে একটি হালকাপাতলা পদক বাগাতে পারলে যে কোনোভাবে সমাজে লেখক কিংবা কবি হিসেবে একটা জায়গা করে নেয়া যাবে, এমন ভাবনা থেকেই আসে তাদের পদক কেনার ধান্ধা। লিখতে পারুন বা না পারুন, ঘরে একটি পদক এবং সার্টিফিকেটের বাঁধানো কপি টাঙানো কম সুখের নয়। সেই পদক আর সার্টিফিকেটের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে ‘কবি’ নাম ভাঙানোর লোকের অভাব নেই। বরং এ ধরনের লোকই মনে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সে জন্যই সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নামে চলছে রমরমা ‘পদকবাণিজ্য’।

এমনও শোনা যায়, পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে পঞ্চাশ হাজার টাকায়ও পদক ও সম্মাননা কিনে ফটোসেশন করছেন নামধারী লেখকরা। পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ করছেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও প্রচার হচ্ছে। পকেটের টাকায় পদক কিনে কেউ নিজেকে বড় লেখক মনে করতেই পারেন। টাকা থাকাও তো কম গৌরবের বিষয় নয় আমাদের সমাজে। কিন্তু এর ফলে, সাহিত্যের নামে অনৈতিক বাণিজ্যে লিপ্ত ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। টাউট বাটপাড় ধান্ধাবাজ লোকেরা সাহিত্যের অঙ্গনটিকে কলুষিত করছে। আর সার্বিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে আমাদের সাহিত্যের। যতসব আবর্জনা লেখকের ভিড়ে সত্যিকারের লেখক-কবিরা হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা।

একটি আঞ্চলিক পত্রিকার পক্ষ থেকে ঢাকায় নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রতি অনুষ্ঠানে গোটা ১০-১৫ ব্যক্তিকে কবি বা গল্পকার বা অন্য কোনো ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হয়। তাদের মধ্যে মানসম্পন্ন লেখক দু-একজন থাকলেও থাকতে পারেন; কিন্তু বেশির ভাগই চকচকে চেহারাসর্বস্ব। অর্থাৎ তাদের চেহারাছবি ভালো এবং নিজের বা স্বামীর পকেটের অবস্থা ‘ভালো’। হ্যাঁ, পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক বা কবিদের বেশির ভাগই থাকেন নারী। এ ছাড়া আবৃত্তি সংগঠন, কবিতাবিষয়ক সংগঠন, অনলাইন ম্যাগাজিন এসব প্রতিষ্ঠানও সাহিত্য নিয়ে পদক-বাণিজ্য করে। সবাই করেন এমন নয়, তবে অনেকেই যে করেন তার প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে। কিছু পত্রিকা আছে যারা সাহিত্যের নামে ফেসবুক পোস্টে প্রকাশ করা ব্যক্তিগত অনুভূতি, তা গদ্যে বা পদ্যে যা-ই হোক, ছেপে দেন। সাধারণত এসব পোস্টের রচয়িতারা হন নারী এবং সুন্দরী। এসব ‘অখাদ্য’ ছাপার পেছনে সংশ্লিষ্ট সাহিত্য সম্পাদকের বিশেষ আগ্রহের কারণটি একেবারে অননুমেয় নয়।

এটি হলো বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে বাণিজ্যের একটি দিক। আরেকটি দিক আছে প্রকাশনার জগতে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো, বই প্রকাশ করা। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই তারা সেটি করে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য করছে বলে নিন্দামন্দ করার প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তখনই যখন প্রকাশক বই প্রকাশের জন্য লেখকের কাছ থেকে টাকা নেন। বাংলাদেশের প্রকাশকরা কয়টি বই নিজের খরচে করেন আর কয়টি লেখকের খরচে, তার কোনো জরিপ বা সমীক্ষা হয়েছে বলে এখনো জানি না। তবে লেখালেখির জগতের সামান্য খোঁজখবর যারা রাখেন তারা বলেন, লেখককে রয়েলটি দেয়া তো দূরের কথা, প্রকাশকরা নিজের খরচে কোনো বই-ই ছাপেন না। বরং লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপানোই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো প্রকাশনা সংস্থার ক্ষেত্রে এসব কথা হয়তো সর্বাংশে সত্য নয়, তবে খুব একটা অসত্যও নয়।

এর ফলে কী ঘটছে? যারা মানসম্মত সাহিত্যকর্ম করেন তারা ছিটকে পড়ছেন বই প্রকাশের দৌড় থেকে। ঢুকে পড়ছেন টাকাঅলা তথাকথিত লেখক লেখিকা। লেখা যেমনই হোক, বই হয়ে যাচ্ছে। এক বছর বা দু’বছর কবিতা লিখছেন সেই কবিরও বই প্রকাশ করতে হবেই! ফলত দেশে কোনো ভালো লেখক আছেন এমন বিশ্বাস ধরে রাখাও কঠিন হচ্ছে সাধারণের জন্য। এই ধারণা, অর্থাৎ দেশে ভালো লেখালেখি হচ্ছে না এই ধারণাই পোক্ত হয় যখন খোদ বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জানায় যে, ২০১৮ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত প্রায় পাঁচ হাজার নতুন বইয়ের মধ্যে মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৫০০টিরও কম। বাংলা একাডেমি মোটামুটি একটি সংখ্যা বললেও মানসম্মত বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেনি। সেটা তাদের কাজও নয়। তবে তালিকা দিলে পাঠকের উপকার হতো। তারা পড়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারতেন, বইগুলো সত্যি সত্যি কতটা মানসম্মত বা নয়। তার চেয়েও বড় উপকার হতো, মানহীন বইয়ের বিপুল কাদাজলের অরণ্যে গরুখোঁজা করে তাকে বই কিনতে হতো না। তখন ভালো লেখককে সহজে শনাক্ত করতে পারতেন।

সাহিত্য নিয়ে বাণিজ্য কেবল খুচরা সাহিত্য সংগঠন বা প্রকাশকরা করছেন এমনও কিন্তু নয়। এই বাণিজ্যের প্রভাব গিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায়ে। একুশে পদক বা বাংলা একাডেমি পদক নিয়ে যে কাণ্ডকীর্তি প্রকাশ্যে এসেছে তা সবারই জানা। কিন্তু জানা নেই ভেতরের রাজনৈতিক দলবাজির বিষয়টি। রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো লেখা কবি যখন পুরস্কৃত হন, তখন সাধারণ মানুষ সামান্য আঁচ করতে পারেন নেপথ্যের কারণ।

এই যে সাহিত্য নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য, এর কুফল থেকে কিন্তু কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। বাজারে দেশী বইয়ের চেয়ে বিদেশি বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। এতে প্রকাশক ও লেখক উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ক্ষতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতিরও। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি দেশে ইংরেজি ফিকশনের কাটতি নাকি দারুণ বেড়েছে। সেই বৃদ্ধির হার নাকি বাংলাদেশী গল্প-উপন্যাসের বিক্রির চেয়ে বেশি। বিদেশী বইয়ের একজন বড় আমদানিকারক এমনই তথ্য দিলেন। যে জাতি মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করল, শহীদ হলো, রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করল মাতৃভাষার মর্যাদা, সেই জাতি এখন বাংলা বই বাদ দিয়ে ইংরেজি চর্চা করছে।

তাহলে বাংলাসাহিত্য দিয়ে কী হবে? এমনিতেই এ দেশে ভালো কোনো সাহিত্য গড়ে উঠছে না। সে পরিবেশই নেই। গুণীর কদর না থাকলে সে সমাজে গুণী মানুষ পয়দা হন না। জানা কথা। আমাদের ক্ষমতাসীন দলটি এতটাই সঙ্কীর্ণমনা লোকদের দিয়ে পরিচালিত যে, দলীয় ভাবধারার বাইরের কোনো লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা, তাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের মতো ন্যূনতম সৌজন্য ও উদারতাও তাদের নেই। এই পরিবেশ শুধু সাহিত্য নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গনের জন্য ক্ষতিকর। আমরা এখন সেই ক্ষয়ের মধ্যেই ক্রমাগত ধসে যাচ্ছি।

ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, ‘একদিন রসদ ও শরাব ফুরাবে/প্রেয়সীর কালো চোখ ঘোলা হয়ে যাবে/কিন্তু বই হলো অনন্ত যৌবনা/যদি তেমন মানের হয় বইখানা।’ আমরা সে বই-প্রশস্তি পাঠ করে মুগ্ধ হই। কিন্তু নিজেরা তেমন বই লেখার তাগিদ বোধ করি না। তেমন উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার কথা ভাবি না। যদি ভাবতাম তাহলে লেখালেখির জগতে বর্তমানে বিরাজমান অরাজকতা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। প্রতিকারের কথা ভাবতাম। বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আবহ তৈরিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতাম।

আমাদের কবি-সাহিত্যিকদেরও সমস্যা আছে। তারা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিদেশের চিন্তাচেতনাকে বেশি গুরুত্ব দেন। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতিগত সংগ্রামের গৌরব, নিজের ধর্ম, সমাজের প্রাত্যহিক বাস্তবতার ভেতরে যে সৌন্দর্য থাকতে পারে সেটি তারা খুঁজে দেখেন না। ফলে তারা সমাজবিচ্ছিন্ন এবং কখনো সমাজবৈরী আউটসাইডার। ফলে এখানে বিশ্বমানের সাহিত্যিক সৃজন অসম্ভব একটি বিষয়। আমরা স্পষ্ট করেই বলতে পারি, নিজের ধর্ম ও সমাজের বাইরে গিয়ে পৃথিবীর কোনো জাতি কোনো মহৎ সাহিত্য রচনা করেছে এমন দৃষ্টান্ত একেবারেই বিরল।

প্রমথ চৌধুরী একটি লেখায় বলেছিলেন, ‘মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন।’ আমরা সেভাবে সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট নই। আমাদের মনোজগতে তাই বাতি জ্বলে না।

e-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement