২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রশাসনে কৃষ্টির সংযোগ ও কর্ম-নির্দিষ্ট নিয়োগ

প্রশাসনে কৃষ্টির সংযোগ ও কর্ম-নির্দিষ্ট নিয়োগ -

মেধাবী হলেই শিক্ষা অর্জন করা যায়; কিন্তু সাংস্কৃতিক মনন ও বোধ তৈরি করা যায় না। কৃষ্টি হলো দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে এই নীতি ভালোভাবে অনুসরণ করত। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজনও আইসিএস অফিসার রিক্রুট না হওয়ার পেছনে এটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ব্রিটিশরা এই রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে শুধু প্রার্থীর শিক্ষা বিবেচনা করত না, তার পারিবারিক ঐতিহ্যও দেখত। শিক্ষার সাথে দৈহিক গড়ন ও অন্যান্য বিবেচনায় আমার বাবা একই প্রক্রিয়ায় ১৯১৯ সালে পুলিশ অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং নিয়ে বাড়ি এলে দাদা তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?’ দাদার পরামর্শে তখন বাবা পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্র্যাকটিস শুরু করেন। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৫ সালের দিক থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিসে রিক্রুটমেন্ট শুরু হয়। পাকিস্তান হওয়ার পর একঝাঁক সিএসপি অফিসার নিয়োগ পেলেন। ১৯৪৯ সালে সিএসপি পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে মরহুম শফিউল আজম প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হয়েছিলেন। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। তার সাথে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তখন আমিও এই প্রক্রিয়ার অংশীদার ছিলাম।

সরকারি চাকরির জন্য দুটি পরীক্ষা দেই। একটি ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস) ও দ্বিতীয়টি সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের (সিএসপি)। আমার সময় পর্যন্ত প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটা হলেও অবশিষ্ট ছিল। মনে আছে, তখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আমাকে যে আবেদনপত্র পূরণ করতে হয়েছিল সেটি বলতে গেলে, ছিল আমার পরিবারের ছোটখাটো ইতিহাস। বাবা, মা, নানা-নানী, দাদা, আমার দাদা- সবার বিবরণ দিতে হয়েছে। এটি পূরণ করতে আমার মাস খানেক সময় লেগেছিল। অনেক খোঁজখবর নিতে হয়েছে, অনেককে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে। আবেদনপত্রের একটি কপি আমি রেখে দিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, সেটা হারিয়ে ফেলেছি। এটি পরিবারের ভালো একটি ইতিহাস হতে পারত। তখন ইপিসিএস-এ একটি মাত্র ক্যাডার ছিল-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আমার সময়ে ২৪ জন রিক্রুট করা হয়েছিল। পরে সরকারের সিদ্ধান্তে সিভিল সার্ভেন্ট লিস্ট পরিবর্তন করে এই ২৪ জনকে প্রায় ৭০০ সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে একীভূত করা হলো। এই তালিকায় আমার নাম অনেক পেছনে পড়ে যায়। ফলে ইপিসিএস ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেই যদিও আরো কিছু কারণ ছিল।

আজকে আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের বালাই নেই। অর্থাৎ কৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশাসন- এই তিনের সংযোগ নেই। তাছাড়া শিক্ষা-নির্দিষ্ট নিয়োগও এ দেশে হয় না। ঢালাওভাবে সবাইকে সব ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় দক্ষতার অবনমন ঘটছে। কেউ যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে হয়তো তার উপযুক্ত পদে ওই প্রার্থীকে বসানো হচ্ছে না। ডাক্তারি পাস করে যেমন ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে, তেমনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পুলিশে যাচ্ছে, অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে যাচ্ছে ফরেন ক্যাডারে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।

আমার মনে হয়, এই প্রক্রিয়া আমাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বলা হয়, ‘ডেভেলপমেন্ট ইজ অ্যা ফাংশন অব স্কিলড লেবার’। আমরা উন্নয়নের যত কথাই বলি না কেন একে টেকসই করতে হলে সুনির্দিষ্ট জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ব্যক্তি যেন ওই কাজের জন্য যোগ্য হয়। তবে কারো জন্য সুযোগ সঙ্কুচিত করতে বলছি না। বলছি তাকে তার উপযুক্ত চেয়ারে বসাতে। সবাইকে এক জায়গায় এনে জগাখিচুড়ি না করতে। অর্থাৎ আমি বলছি, ‘ডেড-লেভেল ইকুয়ালিটি’ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া আমাদের দেশের সুনামের সাথেও বিষয়টিও জড়িত। আমাদের উন্নয়ন ক্রমেই বিশেষায়িত হচ্ছে। তাই বিশেষায়িত জ্ঞান ক্রমেই বেশি জরুরি হয়ে পড়ছে। যে আইন পড়েছে, তাকে আইন সংশ্লিষ্ট কাজেই লাগানো উচিত। যে ডাক্তারি পড়েছে তাকে হেলথ সেক্টরে রাখা দরকার। যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে তাকে কেন প্রশাসনে পরীক্ষা দিতে হবে? তার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ তো রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার তৈরি করতে জনগণের পয়সা সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। তারা অন্য ক্যাডারে যেতে চাইলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাওয়া উচিত। ওরা একদিকে দেশের সম্পদ সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছে আবার অর্জিত দক্ষতার অপচয় করছে।

‘জব-স্পেসিফিক রিক্রুটমেন্ট’-এর কথা বলছি। পাশাপাশি কৃষ্টিকেও রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। ‘জব-স্পেসিফিক জব-ডেসক্রিপশন’ তৈরি করে প্রার্থীর আবেদনপত্রটি ওই ডেসক্রিপশনের সাথে মিলছে কি না, সে কালচারালি টিউনড কি না, তা দেখা উচিত। এটি কিভাবে করা যাবে তা খুঁজে বের করবে সরকারি কর্মকমিশন। এ জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমাদের কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা কম। কোনো পর্যায়েই তা নেই। জব স্পেসিফিক সার্ভিস হলে মান বাড়বে, দেশের উন্নতি হবে, উন্নতি টেকসই হবে। একদিকে জব-স্পেসিফিক রিক্রুটমেন্ট হয় না অন্য দিকে শিক্ষার্থীর জ্ঞান হালনাগাদ করার ব্যবস্থা নেই। ফলে রাষ্ট্রের পয়সায় শিক্ষা অর্জন করা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রকে তেমন কিছু দিতে পারে না। এর ফল ভোগ করতে হয় সমাজকে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে দাবি করে, আমরা জনশক্তি তৈরি করেছি। কিন্তু এই জনশক্তিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। কারখানায় পণ্য উৎপাদনের পর এর গায়ে যেমন ল্যাবেল লাগিয়ে দেয়া হয়, তেমনি শিক্ষার্থীর ডিগ্রিটাও যেন একটি ল্যাবেল। কিন্তু কোনো পণ্য উৎপাদনের পর সে জিনিসটি ঠিকমতো চালু রাখতে সে জন্য একটি সার্ভিসিং সুবিধা দেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো তাদের আঙ্গিনা থেকে চলে যাওয়া শিক্ষার্থী কী করছে, তার কোনো খবর রাখে না।

কোনো শিক্ষার্থী যদি কর্মজীবনে অপকর্ম-দুর্নীতি করে, তাহলে তার ডিগ্রি বাতিলের কোনো বিধান নেই। যন্ত্র নষ্ট হলে আমরা মেরামত করি। খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া না গেলে বা সার্ভিসিং সুবিধা না থাকলে আমরা ওই যন্ত্রটি কিনি না। অথচ আমরা মানুষকে ‘জনশক্তি’ বললেও তার যে ‘সার্ভিসিং’ বা ‘আপগ্রেড’ করা দরকার, সে কথা কেউ বলি না। অথচ এটি হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় তার যে শিক্ষার্থীকে নিয়মিত আপগ্রেড করবে না, তাকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হবে না। আমেরিকায় একজন এমডি বা ডাক্তার হতে গেলে খুব কঠিন শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়; কিন্তু এরপরও যে ডিগ্রি তাকে দেয়া হয়, তা তার সারা জীবনের জন্য নয়; মাত্র ১০ বছরের জন্য। এই ১০ বছর পর আবার তাকে বোর্ডের সামনে হাজির হয়ে সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত।

তাই বলছি, আমাদের উন্নয়নকে টেকসই করতে শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে। সংস্কৃতির সাথে এগুলোকে সমন্বিত করতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement