২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আল কুরআনে অর্থনীতি : ৮

অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা

অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা - নয়া দিগন্ত

‘বলো, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল সা: এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, সন্তান, ভ্রাতা, পত্নী, আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য যার মাঝে মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত। আল্লাহ তাঁর বিরুদ্ধাচারীদের সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা আত-তাওবা ২৪)

পরিপ্রেক্ষিত
২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদার লোকেরা! নিজেদের পিতা ও ভাইদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালোবাসে।’ এ আয়াতে বলা হয়েছে- জন-সম্পদ ও অর্থসম্পদ যদি আল্লাহর ভালোবাসা, রাসূল সা:-এর ভালোবাসা ও আল্লাহর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।

সাধারণ তাৎপর্য : আয়াতে মুমিনের জীবনে আল্লাহর পথে জিহাদের গুরুত্বের আলোচনা করা হয়েছে। প্রত্যেক মুমিনের নিকট অবশ্যই আল্লাহ, রাসূল সা: এবং আল্লাহর পথে জিহাদ সব ধরনের রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ, দেশ, বাসস্থান, ব্যবসায়-বাণিজ্য অপেক্ষা প্রাধান্য পেতে হবে। আত্মীয়তা ও ধন-সম্পদ কখনো মুমিনের নিকট আল্লাহর রাসূল সা: ও আল্লাহর পথে জিহাদের ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না। যদি কখনো আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ ও ব্যবসায়-বাণিজ্য আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর আনুগত্য এবং আল্লাহর পথে জিহাদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে আল্লাহ, রাসূল সা: ও জিহাদকেই গ্রহণ করতে হবে। ‘আল্লাহর পথে জিহাদ’ বলতে বোঝায় নিজেকে ইসলামের ওপর কায়েম রেখে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে ব্যস্ত রাখা এবং জুলুম. নিপীড়ন, উৎখাত ও মজলুমদের সাহায্য করার জন্য সংগ্রাম করা। আল্লাহ কুরআনের বহু আয়াতে এবং আল্লাহর রাসূল সা: তাঁর হাদিসে এসবের জন্য জিহাদ করার তাকিদ দিয়েছেন।

তাফসিরকারদের আলোচনা : এ আয়াতের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিখ্যাত তাফসিরকারক সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন, এটা কখনো জীবনের উদ্দেশ্য নয় যে, একজন মুসলিম পরিবার-পরিজন, আত্মীয়তার সম্পর্ক, ধন-সম্পদ, পার্থিব ভোগ বর্জন করবে এবং বৈরাগ্য অবলম্বন করবে; আর আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা প্রাধান্য পাবে। যখন তা সম্পন্ন হবে, তখন তার জন্য জীবনের সর্ববিধ পবিত্র বস্তু থেকে উপকৃত ও লাভবান হওয়াতে কোনো দোষ নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে- তুমি কি তোমার ঈমানি আকিদা দ্বারা পরিচালিত হবে, না দুনিয়ার ভোগ ব্যবহার তোমাকে পরিচালিত করবে? যখন মুসলমান এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, তার আকিদা ও ধ্যান-ধারণা পরিশোধিত হয়ে গেছে, তখন তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র থেকে লাভবান হওয়া দূষণীয় নয়। অনুরূপভাবে দোষণীয় নয় ধন-সম্পদ ব্যবসায়-বাণিজ্য ও গৃহাদি থেকে লাভবান হওয়া এবং যার জন্য নেই কোনো বাধা, যদি এসবের ভোগ-ব্যবহারে ইনসাফ থাকে ও অহঙ্কার না থাকে। বরং এসব থেকে উপকৃত হওয়া সম্পূর্ণ বৈধ ও মুস্তাহাব। কারণ এ নিয়ামত পাওয়ার পর তা শোকরগুজারির রূপ নেয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রক্ত ও বংশের সম্পর্ক, ছিন্ন হয়ে যায় অধিকার সম্পর্ক। অতএব আল্লাহর জন্যই প্রাথমিক নৈকট্য; আর এর ওপরই রচিত হয় মানবীয় সব সম্পর্ক।

অর্থনৈতিক তাৎপর্য : এ আয়াত থেকে ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড পাওয়া যায়। ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থ, সম্পদ ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিশ্চয়ই গুরুত্ব রয়েছে, যা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এসব কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ ও রাসূল সা: অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা যাবে না। অন্য কথায়, অর্থ-সম্পদ ও ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সবকিছুই আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর নির্ধারিত আইন, বিধান, সীমা ও নির্দেশনার অধীনে হবে। সম্পদের ভোগ-ব্যবহার উন্নয়ন, বিনিময়, ব্যয় সবকিছুই আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর শিক্ষার অধীনস্থ হবে।

আমাদের অর্থনীতিবিদ, আমাদের পরিকল্পনা কমিশন ও সরকারকে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরি ও কার্যকর করার সময় এই নীতিটি মনে রাখতে হবে। এটা করা আমাদের ওপর ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বাধ্যতামূলক। তা না করা হলে এ আয়াতে যেমন বলা হয়েছে- ‘তারা আল্লাহ তায়ালার আজাবের উপযুক্ত গণ্য হবে।’

এ আয়াতে অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে, জিহাদের সাথে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বার্থ কিভাবে সমন্বিত হবে। অথবা জিহাদের সময় অর্থনীতিকে কিভাবে বিন্যাস করা হবে। এখানে অবশ্য শরিয়াহ সমর্থিত জিহাদের কথা বলা হচ্ছে- অবৈধ যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে না। এ আয়াতের আলোকে বলা যায়, জিহাদের প্রয়োজনে প্রত্যেক মুমিনকে তার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের বা সম্পদের ক্ষতি কোনো মুমিনকে জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় না। নীতিগতভাবে রাষ্ট্র ও গোটা মুসলিম সমাজের বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। আয়াতে গোটা মুমিন সমাজকেই সম্বোধন করা হয়েছে, এ কথাও লক্ষণীয়। জিহাদের প্রয়োজনে অথবা জিহাদ করা যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে তখন ইসলামী রাষ্ট্রকে তার জিহাদের দায়িত্ব পালনের জন্য সব অর্থনৈতিক ক্ষতি সহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আরো বলা যায়, জিহাদের সময়ে জিহাদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে সফলভাবে জিহাদ পরিচালনা করা যায়। কাজেই সূরা তাওবার এ আয়াতে ইসলামী অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement