২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শীত এসেছে, দরকার সার্বিক প্রস্তুতি

শীত এসেছে, দরকার সার্বিক প্রস্তুতি - নয়া দিগন্ত

মাসের হিসাবে শীতকাল এখনো আসেনি। চলছে অগ্রহায়ণ মাস। অর্থাৎ ঋতুটি ‘হেমন্ত’। গ্রামীণ বাংলায় এককালের মঙ্গাপীড়িত ‘মরা কার্তিক’ আর নতুন ফসলের সম্ভার নিয়ে অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবের আনন্দবার্তার ঋতুটি এখন চলছে। পল্লীকবির ভাষায়-
‘ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’

ফুলের আয়ু ফুরিয়ে শীত এসে গেছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। শীতের আগমনী বেশ স্পষ্ট রাজধানীতেও। আকাশ দখল করে নিয়েছে মেঘ, আর দৃষ্টিসীমায় কুয়াশা। শীতের অনুভূতি বাড়তে শুরু করেছে। দেশের উত্তরাঞ্চল কাঁপিয়ে দক্ষিণে আসতে শুরু করেছে হিমেল বাতাস। দিন-দুপুরে কুয়াশা গ্রাস করছে ঢাকার আকাশ। সকালে কুয়াশার হালকা চাদর দুলছে দৃষ্টির সীমায়, রাজপথে, স্কাইলাইনের ঠিক ওপরে। হাফহাতা জামা ছেড়ে একটু পুরু ফুলস্লিভ জামা পরতে হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিছানা লেপের দখলে না গেলেও রাতে ফ্যান বন্ধ হয়েছে। কাঁথা, হালকা কম্বলে আপাতত রাত কেটে যাচ্ছে। সচ্ছল মানুষেরা তাদের নতুন শীতের সুন্দর পোশাকটি পরে কবে বাইরে বেরুতে পারবেন সেই পাঁয়তারা করছেন মনে মনে। নারীরা শীতের বাড়তি প্রসাধনের সব আয়োজন করে ফেলেছেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলে রীতিমতোই টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের জাঁকালো উপস্থিতি। কুড়িগ্রামে এরই মধ্যে শীতের তীব্রতায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে। তাপমাত্রা নেমে এসেছে ১৩-১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শীত আর কুয়াশায় দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গত সোমবার সেখানে কুয়াশাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা বাতাসে বিপাকে পড়েন চরাঞ্চলবাসীসহ খেটে খাওয়া মানুষজন। ঘরের বাইরে মানুষের উপস্থিতি কমে যায়। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, নভেম্বরের শুরু থেকেই এ জেলার তাপমাত্রা নিম্নগামী হতে শুরু করেছে। দিনের তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করলেও রাতের তাপমাত্রা নেমে আসছে ১৫ থেকে ১৩ ডিগ্রিতে। এ অবস্থায় শীতকষ্টে ভুগতে শুরু করেছেন কুড়িগ্রামের ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষ।

একই অবস্থা নীলফামারীর সৈয়দপুরেও। ঘন কুয়াশার সাথে তীব্র শীত বয়ে চলেছে। গত সোমবার সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেনি সেখানে। সেই সাথে ঝিরঝির বৃষ্টিও পড়েছে। তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে সৈয়দপুরের মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। নদী অববাহিকায় কুয়াশায় ৫ ফুট সামনে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না কোনো কিছু। সড়কে যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলাচল করছে। এমন অবস্থায় দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ছে বৃদ্ধ ও শিশুদের রোগব্যাধি। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, মূলত রংপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত পুরো উত্তরাঞ্চলেই ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলজুড়ে শীত ও কুয়াশার সাথে ঝিরঝির বৃষ্টিও শুরু হয়েছে।

পূর্বাভাস বলছে, মঙ্গলবার থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বেশির ভাগ এলাকার মেঘ সরে যাবে। কুয়াশাও কমে আসবে। এরপর শীত আরো বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শীতের দাপট বেশি থাকবে। এরই মধ্যে নওগাঁর বদলগাছিতে রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের অন্যান্য স্থানের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও ছিল ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।

এমনিতেই এ বছর আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি একটু লাগামছাড়া। শরতে যে আকাশভাঙা বৃষ্টি হয়েছে আর যে পরিমাণ উত্তাপ ছড়িয়েছে প্রকৃতি তা ছিল অনেকটাই অনাকাক্সিক্ষত। আবহাওয়ার এই রূপ বদল ঘটছে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। এর কারণগুলো অপসারণে বিশ্ব বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ কার্যকর করতে না পারলে আবহাওয়ার খেয়ালি আচরণ চলতেই থাকবে বলে মনে হয়। এবারের শীতেও তার কিছুটা ছাপ থেকে যেতে পারে।’ কারণ আবহাওয়াবিদদের বরাত দিয়ে পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে, মঙ্গলবার থেকে মেঘ কেটে যেতে পারে। তেমনটা হলে শীত বাড়তে পারে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে আবারো লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। তখন আবারো আকাশ মেঘলা হয়ে শীত কমে যেতে পারে। চলতি ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে। মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এক থেকে দুটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। শৈত্যপ্রবাহের সময় ওই এলাকাগুলোর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নেমে আসতে পারে।

মূল কথা হলো, যথানিয়মে শীত এসেছে এবং তা জনজীবনকে প্রভাবিত করবে। এটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক রীতি। শীত এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এ জন্য শীতের প্রস্তুতির একটি ব্যাপার সবসময়ই থাকে। প্রকৃতিতেও এটি লক্ষণীয়। ‘শীতের সঞ্চয় চাই খাদ্য খুঁজিতেছি তাই, ছয় পায়ে পিলপিল চলি,’ পিপীলিকার এই শীতের প্রস্তুতির কথা আমরা সবাই জানি। মানুষ হিসেবে আমাদেরও সার্বিক প্রস্তুতি নিতেই হয়। শীতের আগেই ঘরবাড়ির প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে নিতে হয়; সাধ্যমতো কাঁথা, কম্বল বা লেপ-তোশকের ব্যবস্থা করতে হয়; বেশি শীতে ফসলের ক্ষতি যাতে না হয় সে দিকে মনোযোগী হতে হয়; ঠাণ্ডাজনিত রোগব্যাধি যাতে দুর্ভোগের কারণ হয়ে না ওঠে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এই সবগুলোই শীতের প্রস্তুতির অঙ্গ। এর বাইরে আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রিক কিছু প্রস্তুতির বিষয় থাকে। সামাজিক-রাজনৈতিক বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো শীতের করাল থাবা থেকে গরিব মানুষদের বাঁচাতে তাদের মধ্যে কম্বল এবং খাদ্যসামগ্রী বিতরণের কর্মসূচি হাতে নেয়। অনেকে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে গরিবদের মধ্যে বিলি করেন।

এবারের শীত কিন্তু একটু ভিন্ন বার্তা নিয়ে আসছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় পুরো বছর ধরে চলছে কোভিড-১৯ মহামারী। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এই মহামারী এরই মধ্যে পুরো বিশ্বের চালচিত্র পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এটি যে ভয়াবহ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তার রেশ বিশ্ববাসী কত দিনে কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। বিশ্বের অনেক জায়গার মতো বাংলাদেশেও সেই মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ চলছে। অনেক আগেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন যে, শীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে। সেই হুঁশিয়ারি সত্য হয়েছে। দেশে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। সরকারিভাবে নাগরিকদের আগেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে কার্যত তা কোনো কাজে আসছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে না। কারণ, আগাম জানা থাকার পরও সংক্রমণ রোধে এমন কিছুই করা হয়নি যাতে এর প্রকোপ সীমিত রাখা বা মৃত্যুহার কমিয়ে রাখা যায়। শোনা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহের সব প্রস্তুতি সরকার নিয়ে রেখেছে। কোনো কোনো দেশ এরই মধ্যে টিকা সংগ্রহ করে ফেললেও আমরা টিকা এনে কোথায় কিভাবে সংরক্ষণ করব, সেই জায়গা বা ব্যবস্থাটিও করে উঠতে পারিনি এখনো। এটিই আমাদের বাস্তবতা। শীতের সাথে সাথে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়লে নিজের জীবন হুমকির মুখে ঠিলে দিয়ে কেউ গরিবদের জন্য কম্বল বিতরণ করতে যেতে পারবে না। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

আর এখানেই আসবে রাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রসঙ্গ। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতি বছর প্রশাসনের মাধ্যমে শীতার্ত গরিব মানুষের মধ্যে কম্বল, শীতবস্ত্র ও ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এবারো তেমন প্রস্তুতি আছে বলে জানা গেছে। সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এটিই প্রত্যাশিত।

এর বাইরে শীতের মওসুমে রবিশস্যের ফলন যাতে মার না খায় তার ব্যবস্থা করার কথা কৃষি বিভাগের। সে দিকেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রবি মওসুমের যেসব ফসল চাষাবাদ করা হয় তার মধ্যে বোরো ধান, গম, মসুর ডাল, যব, সরিষা, পেঁয়াজ, মটরশুঁটি উল্লেখযোগ্য। পেঁয়াজের দাম অকারণে বাড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরা এ বছর সাধারণ ভোক্তাদের যে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছেন তাতে চলতি মওসুমে বাড়তি পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন অনেক চাষি। তাদের জন্য সুলভে ভালো বীজ সরবরাহ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা সরকারের তরফে নেয়া উচিত।

এবারের শীতের সবচেয়ে বড় প্রস্তুতির একটি দিক হলো, করোনা সতর্কতা। মহামারীর কারণে জনজীবন কোনোভাবেই স্বাভাবিক হয়নি এবং তা হতে দেয়া এই মুহূর্তে কাম্যও নয়। শীতের পিঠা খাওয়ার জন্য দলে দলে সবাই গ্রামের বাড়িতে যেতে শুরু করলে করোনাভাইরাসের সহজ শিকারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। দল বেঁধে পিকনিকে যাওয়া শুরু করলেও একই অবস্থা হবে। এসব সামাজিক কর্মসূচি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এ জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন এখন থেকেই।

‘মহাপৃথিবী’র কবি বলেছিলেন, ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে।’ করোনাভাইরাস যেন আমাদের হৃদয়ে মৃত্যুর হিম শীতল ছোবল হানতে না পারে, সেটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চাওয়া।


আরো সংবাদ



premium cement
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার অতিসত্বর নির্বাচন হওয়া দরকার : আমীর খসরু জেলখানায় হত্যা : শেখ হাসিনা ও জেল সুপারসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন ডিএসইসি সদস্যদের জন্য ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত জবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক হিমেল, সদস্যসচিব আরেফিন এমন একটি দেশ চাই যাকে কেউ ভাগ করতে পারবে না : জামায়াত আমির কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় আটক ৫ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে হাসপাতালে রিজভী জাতীয় ফুটবল দলকে আওয়ামীকরণ করে ধ্বংস করা হয়েছে : মেজর হাফিজ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের নতুন ডিজি আবু সুফিয়ান আ’লীগের মতো অপকর্ম করব না, বাংলাদেশ গড়ব : পিন্টু

সকল