আমারও একটি ধর্ম আছে
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৩৬
জন্মসূত্রে আমি মুসলমান। আমার বাবা-মা মুসলমান ছিলেন। সেই সূত্রে নিজেও মুসলমান। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মুসলিম রীতি অনুযায়ী দেয়া আজানের সুর হয়তো আমার কানে প্রবেশ করেছে। তখন থেকে চেতনার গহিনে ইসলামিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছে। পারিবারিক পরিবেশের কারণে ইসলামিক সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছি। আমি মাদরাসায় যাইনি, ছেলেবেলায় বাড়িতে কুরআন পড়া, ইসলামিক নিয়ম-কানুন শেখানো হয়েছে। আসলে আমার মধ্যে বাবা-মায়ের ধর্মীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছে। অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী পিতা-মাতার ঘরে জন্ম হলে হয়তো তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই বড় হতাম। শিশু তো কুমারের হাতে কাদামাটির মতো। তাকে যেভাবে গড়া হবে সে তাই হবে। মোদ্দা কথা হলো, আমি মুসলমান এবং এই বিশ্বাস লালন করি। তাই বলে অন্য ধর্মের প্রতি আমার কোনো প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ নেই। ইসলামেই এর নির্দেশ রয়েছে। তা ছাড়া আমার পক্ষে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হওয়া সহজ হয়েছিল কারণ আমি শৈশবে সিরাজগঞ্জের যে এলাকায় বেড়ে উঠেছি সেটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত, অনেকটা কসমোপলিটন জনপদের মতো। স্থানীয় নদীবন্দর ঘিরে বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। ছিল খ্রিষ্টান বণিকদের আবাস। ব্রিটিশ আমলে অখণ্ড বাংলার রাজস্ব আদায়ের অন্যতম কেন্দ্র হওয়ায় রাজকর্মচারীদের আনাগোনাও ছিল বেশি। ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতার সাথে এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অনেক সহজ। পূর্ব বাংলার অনেক এলাকার আগে এখানে বিদ্যুতের আলো আসে। তখন শিশু মনে খটকা লাগত, কেন হিন্দুদের রীতি-আচার একরকম, আর মুসলমানদের অন্যরকম। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ভাবতে থাকি করুক না, ওরা ওদের কাজ; আর আমরা আমাদের কাজ। অন্য ধর্মের বলে কেউ আমার বন্ধু হতে পারব না কেন? হিন্দু সহপাঠীদের সাথে মিলে মিশে স্কুলে যাই। ওরা আমার বাড়ি আসে। আমিও ওদের বাড়িতে যাই। ওদের বাড়িতে আমাকে মুড়ি-বাতাসা খেতে দেয়; আমার বাড়িতে এসেও ওরা অনেক কিছু খায়, ক্ষতি কী?
আমার জন্ম হয়েছিল এমন একটি সময়ে যখন পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তনের প্রস্তুতি চলছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সূচনালগ্ন। আমি শৈশবে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় দেখেছি একই ভারা থেকে হিন্দু মুসলমান খাবার খাচ্ছে। সেখানে জাত-পাতের কোনো বালাই ছিল না। আমি দেখতাম আব্বা আজান দিয়ে নামাজ পড়ছেন, কুরআন তিলাওয়াত না করে তার ডাক্তারির চেম্বার খুলছেন না অথচ তার কাছে হিন্দু সমাজে যারা নি¤œ জাতের বলে পরিচিত যেমন পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী, তারাও আসছে। আব্বা তাদের সাহায্য করছেন। কর্মসূত্রে পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পর সুপিরিয়র সার্ভিসে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান গেলাম। সেখানে সহকর্মীদের মধ্যে হিন্দু কাউকে পাইনি, তবে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী পেয়েছি। পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে পেয়েছিলাম। তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এরপর আইনমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তার সাথে আমার পরিচয় ও আলোচনার প্রেক্ষাপটটি অবাক করার মতো। আমি ছিলাম সরকারি নন-গেজেটেড অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি। এ সময় বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য লড়াই করছিলাম আমরা। ফলে আমাকে বেতন কমিশনের কাছে প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। এই আন্দোলন করতে গিয়েই বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সাথে আমার পরিচয়। তার সাথে দু’বার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তখন দেখেছি ধর্মের চেয়ে মনুষ্য পরিচয় মানুষকে কতটা মহান করতে পারে।
আমার জীবনের পরের অধ্যায় আমেরিকায়। সেখানে পিএইচডি করতে গিয়ে দুই বছর রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকার দেশে ডেকে পাঠালেও সাড়া দিইনি। ফলে আমার স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। এই কঠিন সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার পিএইচডি কমিটির প্রফেসররা। তারা কেউ মুসলমান ছিলেন না। তাদের মধ্যে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও হিন্দু ছিল। তারা বললেন, এই ছেলেটি ভালো, তাকে সাহায্য করা দরকার। আমার ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের টিম লিডার প্রফেসর হান্টার আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে আমার কাজের সুবিধার জন্য তার নিজের অফিস রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রহীন এক ছাত্রের জন্য এই মহানুভবতা কি ভোলা যায়? আমার প্রফেসররা একদিন কৌতুক করে বললেন, মান্নান, তুমি তো পিএইচডি পাবে না। আমরা কেউ মুসলমান নই। তুমি তো মুসলমান। আমি ঝটপট উত্তর দিলাম, এ জন্যই আমার পিএইচডি হবে। এই উত্তর দিতে পেরেছিলাম কারণ তাদের ঔদার্য, মানবদরদি মন আমি দেখেছি। সব মিলিয়ে আমার শৈশব থেকে কর্মজীবন পর্যন্ত সর্বত্র বৈশ্বিক ধর্মগুলোর মহামিলন ঘটেছিল। সবখানে আমি মানবতার জয় দেখেছি। আমাকে ঘৃণা করেছে এমন কাউকে পাইনি।
আমেরিকা থেকে পাপুয়া নিউগিনির (পিএনজি) ‘টেকনলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব লেহ’তে সিনিয়র লেকচারার পদে চাকরি পাওয়ার পেছনেও আমার প্রফেসরদের বিপুল অবদান ছিল। তারা আমাকে যেন আগলে রেখেছিলেন। যে প্রতিনিধি আমার ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিল তাকে আমার সাথে দেখাই করতে দেননি। ওই প্রতিনিধির কাছে প্রফেসররা এমন সুপাশির করেছিলেন যে আমাকে কোনো ইন্টারভিউ দিতে হয়নি।
তাই আমি বলছি, আমার একটি ধর্ম আছে। আমার প্রফেসরদেরও ধর্ম আছে। কিন্তু তারা আমাকে দেখেছেন মানবতার দৃষ্টিতে, ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়। পিএনজির অধিবাসীরা মূলত প্রকৃতি পূজারি (ফোক রিলিজিয়ন)। অথচ এই সমাজে আমি পাঁচটি বছর কাটিয়েছি। এটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সেখানে প্রায় সাত শ’ উপজাতি আছে। তাদের ভাষাও আলাদা। ধর্মও ততসংখ্যক। প্রায় আদিম ধরনে সেই সমাজে বাস করতে আমার অসুবিধা হয়নি। কারণ সবাইকে আমি যেমন মানুষ হিসেবে দেখেছি। তারাও আমাকে মানুষ হিসেবে দেখেছে। সেখানে জীবন এত প্রশান্তির ছিল যে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে হতো না। দিনে কয়েকবার ভূমিকম্প হতো। সেখানকার বাড়িঘর কাঠের মাচার ওপর তৈরি। দিনের বেলা প্রখর রোদ, রাতে মুষলধারে বৃষ্টি। আর চারিদিকে সবুজ এতটাই ঘন যে চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস হবে না। আমি যখন সেখানে যাই তখনো নরখাদক অবস্থা থেকে সেখানকার সমাজের পুরোপুরি উত্তরণ ঘটেনি।
১৯৭৫ সালে দেশটি স্বাধীন হয়। তখন এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন স্যার আলবার্ট মাওরি কিকি। তিনিও একসময় নরখাদক ছিলেন। দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার মাইকেল সুমারে ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সেখানে বিভিন্ন গোত্র থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত। এসব গোত্রকে হতো ‘ওনটক’, মানে একই ভাষাভাষী। তারা সবাই আমাকে ভালোবাসত। একদা ইউনিভার্সিটি সিদ্ধান্ত নিলো বিদেশী শিক্ষকদের ছাঁটাই করা হবে। এর মানদণ্ড নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান করা হলো আমাকে। জন স্যান্ডোবার ছিলেন ভিসি, তিনি ব্রিটিশ। তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। হয়তো আমাকে বাজিয়ে দেখতেই কমিটির চেয়ারম্যান করেছিলেন। স্থানীয় কাউকে তিনি করতে পারতেন। আমি নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজটি করে তার কাছে সুপারিশমালা পেশ করি। তাতে আমি বলেছিলাম, যাদের চাকরির বয়স বেশি তাদের বিদায় করা যায়। সেটি দেখে স্যান্ডোবার বলেন, ‘মান্নান, ইউ আর দ্য ফার্স্ট পারসন টু গো’। আমি বলি, হ্যাঁ, আমিইতো এখানে সবচেয়ে সিনিয়র বিদেশী। স্যান্ডোবার বলেন, না আপনাকে এখানে থাকতে হবে। তার এই আচরণে ধর্মীয় বিবেচনা কোথায়?
তাই বলছি, আমার একটি ধর্ম আছে, ওদেরও একটি ধর্ম আছে। কিন্তু ধর্মের মূল কথা একটাইÑ মানুষকে ভালোবাসা। এরপর সৌদি আরব গেলাম। সেখানে কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে তখন ১৬০০ পিএইচডিধারী শিক্ষক ছিলেন। সেখানেও অনেক ধর্মের লোক ছিলেন। তবে হিন্দু ছিলেন না। মক্কায় অমুসলিমদের প্রবেশের ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকায় এটা হতে পারে। সেখানে আমার প্রতিবেশী ছিলেন খ্রিষ্টান, ব্রিটেনের নাগরিক। স্কুলে বাচ্চাদের আনা-নেয়ার কাজ আমরা ভাগাভাগি করে করতাম।
তাহলে এখন কেন আমরা এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের এত হানাহানি দেখি। আমাদের রীতিনীতি আলাদা হতে পারে। কিন্তু মৌলিক চেতনা তো এক। যেমন কেউ দশতলা ভবনে আর কেউ একতলা ভবনে থাকে। কেউ টিনের ঘরে বা কেউ কুঁড়ে ঘরে থাকে। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হলো আশ্রয়ের। কেউ তার ঘরকে উন্নত করতে পারে, সাজাতে পারে। কিন্তু সবার আশ্রয় প্রয়োজন। সবার একটি ঘুমানোর জায়গা প্রয়োজন। করোনাকালে সারা দুনিয়া এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যস্ত। কিন্তু কেউ তো বলে না এটা হিন্দু ভ্যাকসিন, ওটা মুসলমান ভ্যাকসিন বা খ্রিষ্টান ভ্যাকসিন। একই ভ্যাকসিন যদি সব ধর্মের মানুষের দেহে কাজ করতে পারে তাহলে সেই মানুষগুলো কেন শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় একে অপরকে ঘৃণা করবে?
ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মিশে আমার ধর্মবিশ্বাস ছুটে যায়নি বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে আমি শুধু ভালোবাসাই পেয়েছি। আমার ধর্ম তো বলেনি অন্যকে ঘৃণা করো। ধর্মের মূল কথা একটিই, মানুষকে ভালোবাসো। এই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পারলে ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’ সৃষ্টি হবে। তাই তো বলছি আমারও একটি ধর্ম আছে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা