ভাস্কর্য, মহাকালের প্রেক্ষাপট
- গোলাম মাওলা রনি
- ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:৩৬
ভাস্কর্য কী এবং কেন- এমনতর প্রশ্ন যদি আপনার মাথায় এসে যায় তবে আপনি ভাস্কর্যের দেশ বলে পরিচিত ইতালি থেকে ঘুরে আসতে পারেন। রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের তীর্থভূমি ভ্যাটিকান সিটিতে যেসব ভাস্কর্য রয়েছে সেগুলো দেখলে আপনি ভিরমি খেতে বাধ্য হবেন। আর আপনি যদি ইসলাম ধর্মের একজন গোঁড়া অনুসারী হন, তবে কিছু কিছু ভাস্কর্য দেখার পর আপনার মনের মধ্যে যেসব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকের পক্ষে কলম ও কালি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
যারা ভাস্কর্য তৈরি করেন তাদের বলা হয় ভাস্কর। তাবৎ দুনিয়ার সর্বকালের সেরা বলে স্বীকৃত যে ক’জন ভাস্কর রয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তির নাম মাইকেল এঞ্জেলো। তার অনেক দুনিয়া কাঁপানো ভাস্কর্য রয়েছে, যেগুলো কিনা ভ্যাটিকানের পবিত্র স্থানে স্থাপন করে শিল্পী ও শিল্পকর্মকে সম্মান জানানো হয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলোর শিল্পকর্মের মধ্যে ডেভিড ভাস্কর্যটি দুনিয়া কাঁপাচ্ছে সেই ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। মুসলমানরা যে সম্মানিত নবীকে হজরত দাউদ আ: বলে ধ্যান-জ্ঞান করেন, পশ্চিমারা সেই নবীর নাম দিয়েছে ডেভিড। মাইকেল এঞ্জেলো ১৫০১ সালে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের কাজে হাত দেন এবং টানা চার বছর ধরে পাথর কেটে বিরাট এক উলঙ্গ পুরুষের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে এর নাম দেন ডেভিড।
ডেভিডের মতো আরেকটি সম্পূর্ণ নগ্ন পুরুষের ভাস্কর্যের নাম ‘পারসিয়াস উইথ দ্য হেড অব মেডুসা’। ইতালির নামকরা ভাস্কর অ্যান্থনিও নির্মিত এই ভাস্কর্যটিকে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সাত নম্বরের বিখ্যাত শিল্পকর্ম। গ্রিক দেবতা পারসিয়াসের জীবন ও কর্ম তুলে ধরার জন্য সম্পূর্ণ উলঙ্গ মূর্তিটির এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে মানুষের খণ্ডিত মস্তক তুলে ধরা হয়েছে।
আপনি যদি পৃথিবীর সর্বকালের সেরা বলে স্বীকৃত ভাস্কর্যের বৃত্তান্ত শোনেন তবে হয়তো বড় রকমের ভীমরতির কবলে পড়বেন। একটির নাম ভেনাস অব উইলেনড্রফ। রয়েছে অস্ট্রিয়াতে। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টের জন্মের ২৫ হাজার বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছিল। মাত্র চার ইঞ্চি উচ্চতার একটি উলঙ্গ নারী মূর্তি কী করে দুনিয়ার সর্বকালের সেরা ভাস্কর্য হলো তা নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা আপনার হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। মূর্তিটিকে একজন বেঢপ নারীর বিশাল পেট পর্যন্ত ঝুলে থাকা বিরাটাকার স্তন্য এবং যৌনাঙ্গটিকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা দেখে দুনিয়ার ভাস্কর্য বিশেষজ্ঞরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, পাথর যুগের আদি মানবেরা হস্তমৈথুনের কাজে মূর্তিটিকে ব্যবহার করত।
পৃথিবীর সর্বকালের এক নম্বর বলে স্বীকৃত ভেনাস অব উইলেনড্রফ ভাস্কর্য বাদ দিয়ে আপনি যদি চার নম্বর বিখ্যাত ভাস্কর্য খুঁজতে যান তবে খ্রিষ্টের জন্মের দুই শ’ বছর আগেকার একটি মূর্তি পেয়ে যাবেন যার নাম ‘লাওকুন অ্যান্ড হিজ সনস’। মূর্তিটি ১৫০৬ সালে রোমে আবিষ্কৃত হয় এবং ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, এটি রোমান সম্রাট টাইটাসের প্রাসাদে রক্ষিত ছিল। এই ভাস্কর্যটিতে একজন উলঙ্গ পিতা এবং তার উলঙ্গ পুত্রদ্বয়কে গ্রিক উপকথার সমুদ্র দেবতার অভিশাপে কিভাবে একটি অজগর সাপ অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে তা পাথরের শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূর্তিটিকে একটি পবিত্র নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ সেটিকে ভ্যাটিকানের গির্জার অভ্যন্তরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
উল্লিখিত ভাস্কর্যগুলো ছাড়াও আপনি ‘বাস্ট অব নেফারতিতি, দ্য টেরাকোটা আর্মি, গিটার, ম্যাডোনা, মিসরের গ্রেট স্ফিংস ছাড়াও মিসরের জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দেবতা আমুন, ফেরাউন রামসিস দ্য সেকেন্ড, ফেরাউন প্রথম সেটি এবং রানী থুইয়া, ফেরাউন আমেনাহোটেপ এবং আখের নাফেনের ভাস্কর্যগুলোতে চোখ বুলাতে পারেন। আপনি যদি পাথরের সৃষ্ট ঐতিহাসিক মহাযজ্ঞ অবলোকন করতে চান তবে জর্দানের পেত্রা নগরী, চীনের মহাপ্রাচীর, মিসরের পিরামিড, আগ্রার তাজমহল এবং দিল্লির কুতুবমিনার দেখে আসতে পারেন। এগুলোর বাইরে সিরিয়ার পালাম, পারস্যের পার্সিপোলিশ, মিসরের লুক্সর এবং আফগানিস্তানের বাসিয়ানের বুদ্ধমূর্তিও দেখে আসতে পারেন।
আপনি যদি উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্দির ঘুরে আসেন তবে মূর্তি অথবা প্রতিমূর্তি সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেয়ে যাবেন। এরপর আপনি চীনের গুয়াংঝু, নানকিং এবং নানঝিংয়ের বিভিন্ন বাজারে ঢুঁ মারেন তবে প্লাস্টিকের পুতুল যে কত প্রকার এবং কী কী হতে পারে তার কোনো কূলকিনারা করতে পারবেন না। প্লাস্টিকের পুতুলের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে সেগুলোকে সেক্সডলরূপে চীন যেভাবে সারা দুনিয়ায় ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে বলতে গেলে সব শ্রেণিপেশা-রাষ্ট্রশক্তি এবং ধর্মমত একাট্টা হয়েছে এই আশঙ্কায় যে, দুনিয়াতে যদি সেক্সডলের প্রচলন অবাধ এবং সার্বজনীন করে দেয়া হয় তবে মানবজাতির অস্তিত্বই লোপ পাবে।
ভাস্কর্য মূর্তি প্রতিমূর্তি এবং বাহারি পুতুল বাদ দিয়ে আপনি এবার চিত্রকর্মের দিকে একটু মনোনিবেশ করতে পারেন। আধুনিককালে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে যেভাবে জীবজন্তু-প্রকৃতি-পরিবেশের ছবি তোলা হয় তা ক্যামেরা আবিষ্কারের আগে জল রঙ, তৈলচিত্র বা স্কেচ প্রভৃতি মাধ্যমে তৈরি করা হতো। এসব ছবি-চিত্রকর্ম বা পোর্ট্রেেটর আবার দুটো শাখা রয়েছে। একটি হলো জীব-জন্তু প্রকৃতির হুবহু নকল, যাকে ছবি-প্রতিচ্ছবি বলে আখ্যা দেয়া হয়। অন্য দিকে জীব-জন্তু প্রকৃতির বিভিন্ন আচরণকে কল্পনার রঙতুলি দিয়ে যখন জলরঙ তেলরঙ দিয়ে অঙ্কন করা হয় তখন সেগুলো হয়ে ওঠে মোনালিসা, গুয়ের্নিকার মত চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্ম।
আলোচনার এই পর্যায়ে আপনি যদি ছবি-প্রতিচ্ছবি, মূর্তি-প্রতিমূর্তির আন্তঃমিল খোঁজেন এবং এগুলোর সংজ্ঞা জানতে চান তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে চিত্রকর বা মূর্তি নির্মাতার মস্তিষ্কে যখন কোনো জীব-জন্তু বা প্রকৃতির বাস্তব রূপ উপস্থিত থাকে অথবা তার চোখের সামনে যদি এগুলোর উপস্থিতি ঘটে তবে তারা যে ছবি তোলেন ছবি আঁকেন অথবা মূর্তি তৈরি করেন সেগুলোর ধরন ও প্রকৃতি একই বৈশিষ্ট্যের হয়। এ ক্ষেত্রে চিত্রকর মূর্তি নির্মাতা জীব-জন্তু এবং প্রকৃতির বাস্তবচিত্রকে নকল করেন মাত্র। ফলে অনেকে এগুলোকে প্রতিচ্ছবি প্রতিমূর্তি ইত্যাদি নামে ডেকে থাকেন।
মূর্তি-প্রতিমূর্তি কিংবা ছবি চিত্রপটের কারিগরদের নিয়ে মানুষ বেশি মাতামাতি করে না। কারণ এগুলোর নেপথ্যে কোনো নীতি আদর্শ চিন্তাচেতনা বা উদ্দেশ্য থাকে না। নিজের খেয়ালের বশে বা ব্যক্তিবিশেষের ফুটফরমায়েশে যারা ছবি আঁকেন মূর্তি বানান বা ছবি তোলেন তারা কেবল তখনই প্রশংসিত হন যখন তারা খুব সুন্দরভাবে নকল করতে পারেন অথবা একটি সাধারণ বিষয়বস্তুকে দৃষ্টিনন্দনরূপে উপস্থাপন করতে পারেন। কোনো কুৎসিত অথচ ধনাঢ্য ব্যক্তির ছবিটি যদি কেউ সুন্দর করে তুলতে পারেন বা আঁকতে পারেন তবে ছবিকর বা চিত্রকরের পারিশ্রমিক ও প্রশংসা দুটোই কাক্সিক্ষত হয়ে থাকে।
আপনি যদি পুতুল বা পুতলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন তবে সহজেই অনুধাবন করবেন যে, এগুলো নেহাত খেলনার সামগ্রী এবং সাধারণত শিশুতোষ বিনোদনের জন্যই তৈরি করা হয়। কখনো কখনো কিছু কিছু পুতুল খুব কুৎসিত বীভৎস বা ভয়ঙ্করভাবে বানানো হয় পশু পাখি জীব-জন্তু কীট পতঙ্গদেরকে ভয় দেখানোর জন্য। এর বাইরে অদ্ভুত সব পুতুল-পুতলি তৈরি করে পুতুলনাচের মতো হালকা রসাত্মক কিংবা ব্যঙ্গাত্মক চিত্রনাট্য প্রদর্শন করা হয়। কাজেই সেই অনাদিকাল থেকে খেলনা পুতুলের রঙঢঙ বা পুতুলনাচের পুতুলদের চেহারা সুরত, ভাবভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে মানুষ বিনোদনের বাইরে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা করেনি।
আমরা আজকের আলোচনার একেবারে প্রান্তসীমায় চলে আসছি। এই পর্যায়ে ভাস্কর্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আমার মতামত দিয়ে নিবন্ধের ইতি টানব। প্রথমেই বলতে চাই ছবি, চিত্রপট, মূর্তি-প্রতিমূর্তি অথবা পুতুলের সাথে ভাস্কর্যের কোনো মিল নেই। কারণ ভাস্কর্য সাধারণত বাস্তব কোনো জীব-জন্তুর জীবনকর্ম বা অভ্যাস-আচরণের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় না। কোনো ব্যক্তি বা মহলবিশেষের ফরমায়েশেও ভাস্কর্য নির্মিত হয় না। ভাস্কর্য হলো ভাস্করের চিন্তাচেতনার প্রতিমূর্তি, যা সে পাথর কাঠ অথবা অন্য কোনো ধাতুর সাহায্যে গড়ে তোলে। ভাস্কর্যের অন্যতম এবং প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তি যার বাস্তব ছবি বা মূর্তি রয়েছে তার কোনো ভাস্কর্য হয় না। যার জীবন ও কর্মের বেশির ভাগ যেখানে ঐতিহাসিক দলিলরূপে লিখিত রয়েছে তার ভাস্কর্য হয় না। কারণ পৃথিবীর সব ভাস্কর্যের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাস্কর যে কল্পনাশক্তিকে পাথরে অঙ্কিত করেছেন সেই কল্পনার মূল ভিত্তি হলো- মিথ বা মিথোলজি এবং আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন। ফলে ভাস্কর তার ইচ্ছেমতো কোনো ভাস্কর্যকে উলঙ্গ করেছেন আবার কোনোটিকে করেছেন হস্ত-পদ বা মস্তকহীন। কোনো ভাস্কর্যে হয়তো বিশেষ বিশেষ অঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে আবার কোনো কোনো ভাস্কর্যে কেবল ভাস্করের চিন্তাচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে।
উল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে আপনি যদি পৃথিবীর নামকরা ১০০টি ভাস্কর্য পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেখবেন, যার সম্পর্কে নির্ভুল ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে এবং যার ছবি-প্রতিচ্ছবি বা মূর্তি রয়েছে তাকে নিয়ে কোনো ভাস্কর্য তৈরি করা হয়নি। এমনকি যেসব পশুর আচার-আচরণ-চরিত্র এবং আকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞান একটি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে সেগুলো নিয়েও কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়নি। মহাকালের বিভিন্ন গল্পকথা, কাহিনী এবং রহস্যময় বিষয়াদি যা নিয়ে মানব মনে ভয়-ঘৃণা-লোভ-আকর্ষণ ইত্যাদির রসায়ন সৃষ্টি হয় সেগুলোতে কল্পনার রঙ মিশিয়ে কোনো ভাস্কর যখন পাথর-কাঠ-ধাতু ইত্যাদির সাহায্যে প্রশ্নবোধক কিছু নির্মাণ করেন কেবল তখনই তাকে ভাস্কর্য বলা হয়। ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার মনে যদি কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না হয়- আপনি যদি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গলদঘর্ম না হন এবং সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পর যদি আপনি আশ্চর্য বোধ না করেন তবে কোনো অবস্থাতেই সেটিকে ভাস্কর্য বলা যাবে না। আপনি সেটিকে বড় জোর কোনো মূতি-প্রতিমূর্তি অথবা কাঠামো বলতে পারেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা