২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়

আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় - ছবি : নয়া দিগন্ত

এটি আমার স্বপ্নের অংশ। আমাদের চার পাশে দেখা গতানুগতিক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এটি নয়। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের কোথাও এমন কার্যক্রম নিয়ে কোনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। মরণোত্তর ডিগ্রি দেয়ার কথা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ভাবছে না। আমার কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণাধর্মী ও জীবনধর্মী কারিকুলামভিত্তিক। এমন কারিকুলাম তৈরিতে গবেষণা চাই। পশ্চিমা ধারার কারিকুলাম আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। যেকোনো স্থাপনার ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি থাকে। তাই শিক্ষার্থীর উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণ ব্যবস্থারও যথাযথ মান ও পরিমাণের ভিত্তি থাকতে হবে। পাঁচতলা ভবনের ভিত্তির ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা যায় না। তেমনি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জনসম্পদ বা জনশক্তি তৈরি করা যাবে না। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এ রকম ভিত্তির অভাব রয়েছে। আমাদের শিক্ষাকারিকুলাম ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। ওই শিক্ষাকারিকুলাম ছিল পশ্চিমাদের প্রজা তৈরির জন্য। সেটাই প্রান্তিক কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র। ফলে এখান থেকে যেসব শিক্ষার্থী বের হচ্ছে তারা সমাজের জন্য অপ্রাসঙ্গিক।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহরকেন্দ্রিক। ৫৩টি সরকারি ও প্রায় ১০০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবই শহরে। শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিতে চাইলে প্রতিষ্ঠানও তার দোরগোড়ায় থাকা উচিত। সমাজের ভিত্তিটি বুঝতে না পারার কারণে শহরে পড়াশোনা করে কেউ আর গ্রামে ফিরে যেতে চায় না। শিক্ষার্থীরা আমাদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রাণ তথা গ্রামীণ আবহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাঠ্যবইয়ের সাথে বাস্তব জীবনের মিল-অমিল শিক্ষার্থীর বুঝার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি যে বিশ্ববিদ্যায়ের উদ্যোগ নিয়েছি এর অবস্থান ইউনিয়ন পর্যায়ে, প্রত্যন্ত গ্রামে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকারিকুলাম হবে জীবনভিত্তিক। আমি কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের কেন এমন বিশ্ববিদ্যালয় নেই- যেটি ‘কালচারালি টিউনড’। যেমন- একজন মুসলমানের বাড়িতে একটি নামাজের জায়গা থাকা দরকার। তাই স্থপতিকে বাড়ির মালিকের সাংস্কৃতিক মনন বুঝতে হবে। গ্রিক স্থাপত্য কল্পনা করে মুসলমানের বাড়ির নকশা করলে চলবে না। খ্রিষ্টান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। মরু আরবের সংস্কৃতি বাংলার সবুজ-শ্যামল জমিনে খাপ খাবে না। আমি বুঝাতে চাচ্ছি, ইঞ্জিনিয়ারিং শুধু প্রযুক্তির পেছনে ছোটা নয়, এর সাথে মানব আচরণও জড়িত। ফলে সমাজ, সংস্কৃতি, মনন না বুঝলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষাটি ‘কালচারালি টিউনড’ হবে না। তাও, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা হয়তো তাদের শিক্ষাকে কিছুটা এদিক-সেদিক করে সমাজের সাথে তাদের কাজকে কিছুটা খাপ খাওয়াতে পারবে, কিন্তু যারা এখানে বসে পশ্চিমা অর্থনীতি, সামাজনীতির আলোকে পড়াশোনা করছে তাদের জন্য কাজটি হবে আরো কঠিন। কারণ তাদের পড়াশোনার সাথে আমাদের সমাজের কোনো যোগ নেই।

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি নিজ জেলা সিরাজগঞ্জের নিমগাছিতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি বেশ কয়েক বছর আগে। আমার এক ভাগ্নি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে পড়ে। তার বাড়িও সিরাজগঞ্জে। একবার তাকে আমার স্কুলটি দেখাতে সাথে নিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে এক জায়গায় আখক্ষেত দেখে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, খালু, এটা কি ধানক্ষেত? আমার তো আক্কেলগুড়ুম। আমি বললাম, তুমি এটা কী বললে? তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো, আর ধানক্ষেত চেনো না? আসলে, ওই ঘটনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক মৌলিক ত্রুটি প্রকাশ করছে।

আমাদের দেশে সামাজিক পারস্পারিকতা (social reciprocity), সামাজিক আচরণ (social behavior) অনেক বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বাজার অর্থনীতিতে সম্পর্কটি নৈর্ব্যক্তিক (impersonal), যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় নেই। টাকা আছে পণ্য পাবে। অথচ আমাদের কোনো গ্রামে গেলে দেখব কারো গাছে আম হলে সে পেড়ে নিয়ে প্রতিবেশীকেও কিছু দিচ্ছে। ঝড়ে আম পড়ছে তো পাড়ার ছেলে-মেয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলে না। কিন্তু পশ্চিমা সমাজে এটা অকল্পনীয়।

কেউ এমনটা করতে গেলে তার ‘চোর’ হিসেবে গুলি খেয়ে মরার আশঙ্কা রয়েছে। আর মার্কসবাদী অর্থনীতিতে কারো কথা বলার সুযোগ নেই। নির্দেশ মতো সব কাজ হবে। এই অনমনীয়তার ফলে কাজ হয় বটে কিন্তু মানবিক দিকটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়। আর ইসলাম বলে সবকিছু ন্যায় ও নৈতিকতাভিত্তিক হতে হবে। আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অথচ এখানকার শিক্ষার্থীদের চেতনা ও অনুশীলনে ওই ভিত্তিটি অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীর চেতনায় তার সামাজিক পরিচয় প্রগাঢ়ভাবে প্রবিষ্ট করাতে হবে। এ জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন তা আমার কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় করবে। তাই বলে প্রচলিত সব শিক্ষা কারিকুলাম বাদ দেয়া হবে না। একটি তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরা হবে। শিক্ষার্থী শুধু ‘ওক ট্রি’ চিনবে না, ধানগাছও চিনবে। মানে, তার শিক্ষা হবে ব্যাপকভিত্তিক, তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে প্রসারিত। ফলে এখানকার কোনো শিক্ষার্থী পৃথিবীর যেখানেই যাক না কেন তার শিক্ষাটি ওই সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। এখানে বাংলাদেশ স্টাডিজ, ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন, ইংলিশ লিটারেচার, ইত্যাদি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর জন্য মৌলিক বিষয় হিসেবে থাকবে। আর নৈতিক কাঠামোর মধ্যে জীবনধর্মী, গবেষণাধর্মী বিষয়গুলো পড়ানো হবে।

আমার কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক অর্থায়নের ওপর জোর দেবে। তবে শুধু মুসলমান বলে নয়। আমাদের দেশে আটটি ইসলামিক ব্যাংক এবং প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামিক ব্যাংকিং উইনডো রয়েছে। সরকারের সবচেয়ে বড় করদাতা ব্যাংক হলো ইসলামিক ব্যাংক। এগুলোর শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, বুথ, ইসলামিক ব্যাংকিং উইনডো ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার আউটলেট রয়েছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের জনশক্তির ৩৫ শতাংশ এখানে নিয়োজিত। অথচ এগুলোর জন্য উপযুক্ত মানের বিপুলসংখ্যক জনশক্তি তৈরির উপযোগী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এদেশে নেই। আমাদের আরো বড় দুর্বলতা হলো, সরকার অনেক মেগা প্রজেক্ট করছে, কিন্তু ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের এই মেগা খাতটির জন্য কোনো আইন করতে পারেনি।

আমাদের এখানে ইসলামী ব্যাংকগুলো চলছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। কোনো ব্যাংকেই মুশারেকা বা ইকুইটি ফাইন্যান্সিংয়ের ব্যবস্থা নেই। সবাই মুরাবাহা বা কস্ট-প্লাস ফাইনেন্সিং নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে। কারণ তাদেরকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। তখন অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়ে একে সুদের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। এখানে লেবার ও ক্যাপিটেলের সমন্বয় নেই। ‘প্রফিট ডিপেন্ডেন্ট ওয়েজ সিস্টেমের’ মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা নেই। মুরাবাহা বা মোড অব ফাইন্যান্সিং ধারণাটিও আগে গ্রহণ করা হয়নি। এটা এখন বেশ জনপ্রিয় এবং এটাই যেন ইসলামিক ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার অবলম্বন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে তারা ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট চালু করেছে।

আমাদের দেশে দেড় লাখের বেশি ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়া আছে দুই লাখ মসজিদের মধ্যে এক লাখ ২৩ হাজারটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি হিসেবে নিবন্ধিত। বাংলাদেশ ও এর বাইরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে। আমাদের দেশে দেবোত্তর সম্পত্তিও রয়েছে অনেক। এগুলোর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি পূরণ করবে আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াক্ফ সম্পত্তি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কোর্স চালু করবে।

একান্তভাবে ইসলামিক ব্যাংকিংকে লক্ষ্য করে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া ছাড়া আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। সৌভাগ্যক্রমে তাদের সেই উদ্যোগে আমার জড়িত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মাহাথির মোহাম্মদ তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাকে বলা হলো ইসলামিক ব্যাংক করতে হলে এর আইন করতে হবে। তিনি সেটি শুনলেন।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখি তা শুধু দেশের নয়, বিদেশী শিক্ষার্থীদেরও টেনে আনবে। আইডিবির কাজের সুবাদে বহু মুসলিম দেশে যাওয়ার ও সেখানকার পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওই সব দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা কঠিন কিছু নয় আমার জন্য।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফলোআপ করবে। পরবর্তী জীবনে তারা কে কোথায় কী করছে সেই খবর রাখতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি নেই। সেই সুবিধা থাকবে এখানে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে আপডেট করা হবে, যাতে তার কর্মজীবনের জ্ঞান সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়। এখানে মরণোত্তর ডিগ্রি দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। আর জীবিতকালে দেয়া হবে ‘প্রভিশনাল ডিগ্রি’। এর কোনো শিক্ষার্থী কর্মজীবনে দুর্নীতি বা গুরুতর অসদাচরণ করলে তার সার্টিফিকেট বাতিল এবং অন্য দিকে তার অসাধারণ কর্মের জন্য পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা থাকবে। এখানে ‘নন ফরমাল এডুকেশনের’ ওপর ব্যাপক জোর দেয়া হবে; ‘লার্নিং অন দ্য জব’ থাকবে। ‘হল অব ফেম’ ধরনের অনুষ্ঠানে সমসাময়িক নির্ধারিত কোনো বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞকে এনে ‘স্টেট অব আর্ট লেকচার’ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে শিক্ষার্থীদের আপডেট করার জন্য।

বর্তমানে বৈশ্বিক ইসলামিক অর্থায়নের পরিমাণ ২.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ১০-১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাংলাদেশসহ ৮০টির বেশি দেশে এই সম্পদ ছড়িয়ে আছে। ২০১৮ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বে ৪১৮টি ইসলামিক ব্যাংক রয়েছে। অথচ কোনো ইসলামিক ব্যাংকিং ইউনিভার্সিটি নেই। এটা কি ভাবা যায়? আসলে গোটা মুসলিম বিশ্বই এখন অ্যাডহকভিত্তিক হয়ে পড়েছে। এখানে কোনো পারপাস নেই, কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। অথচ ইসলামিক বিশ্বের যে সম্পদ তা দিয়ে গোটা মানব জাতির কল্যাণ করা সম্ভব।
এই ৮২ বছর বয়সেও আমার স্বপ্ন আছে, উদ্দেশ্য আছে। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় ‘দ্য গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’ (জিইউআইএফটি) নামের বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করাই এখন আমার বড় স্বপ্ন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement