বক্ষে আমার কাবার ছবি...
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৪১, আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১৯:২৭
আলহামদুলিল্লাহ, সুখবর। ৪ অক্টোবর ২০২০ থেকে মুসল্লিদের জন্য পবিত্র কাবা শরিফ খুলে দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘ ছয় মাসের বেশি সময় পর ওমরাহ পালনের জন্য কাবাঘর খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি প্রশাসন। ফলে মুসল্লিরা আবারও পবিত্র ওমরাহ পালন করতে পারবেন, বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে পারবেন, মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য আহকাম পালন করতে পারবেন। তবে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরে চুম্বন ও কাবাঘর আপাতত স্পর্শ করা যাবে না।
করোনা মহামারীর কারণে গত মার্চ মাস থেকে কাবা শরিফ বন্ধ রাখা হয়। মাঝে সীমিত পর্যায়ে হজ কার্যক্রমের জন্য গত জুলাইয়ের শেষের দিকে কয়েক দিনের জন্য সতর্কভাবে কাবা শরিফ ব্যবহার করতে দেয়া হয়। স্বাভাবিক অবস্থা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এজন্য সৌদি আরবের বাইরের মুসল্লিরা প্রথম পর্যায়ে ওমরাহ করার সুযোগ পাবেন না। প্রথম ধাপে শুধু সৌদি নাগরিক ও বাসিন্দারা ওমরাহ পালন করতে পারবেন। ৪ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন ছয় হাজার সৌদি নাগরিক ও বাসিন্দা অর্থাৎ কাবা চত্বরের ধারণ ক্ষমতার ৩০ শতাংশ মানুষ ওমরাহর অনুমতি পাবেন। ১৮ অক্টোবর দ্বিতীয় ধাপে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে। তখন ধারণ সংখ্যার ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতিদিন ১৫ হাজার মুসল্লি ওমরাহ পালন করতে পারবে।
তৃতীয় ধাপে ১ নভেম্বর থেকে বিদেশী পর্যটকসহ প্রতিদিন ২০ হাজার মুসল্লিকে ওমরাহ পালনের সুযোগ দেয়া হবে। আরব নিউজের খবরে বলা হয়, চতুর্থ ধাপে যখন করোনার ঝুঁকি আর থাকবে না, তখন মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর কর্মকাণ্ড সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। সৌদি সরকার বলছে, মহামারী পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় মুসলিম বিশ্বের আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে ওমরাহ পালনকারীদের। এর মধ্যে রয়েছে ‘আই-তামার্না’ নামের একটি ডিজিটাল অ্যাপ ব্যবহার করতে হবে, ওমরাহ আবেদনকারীর বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬৫ এর মধ্যে, ওমরাহ আবেদনের পর মসজিদে হারামে প্রবেশের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পবিত্র স্থানগুলোতে যাওয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এক্ষেত্রে আই-তামার্না অ্যাপের সাহায্যে ওমরাহ পালনকারীদের স্বাস্থ্যগত ও ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যাদির ওপর নজরদারি করা হবে। দিনের ২৪ ঘণ্টায় ১২টি গ্রুপ ওমরাহ পালনের জন্য তিন ঘণ্টা করে সময় পাবে।
এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর আই-তামার্না মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধন হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়, ১০ দিনের ওমরাহ পালনের নিবন্ধনের কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ৬০ হাজার নিবন্ধন হয়ে যায়। তিন দিনে দুই লাখ ৫০ হাজার আবেদন জমা পড়ে। ওমরাহ চালু হওয়ার পাশাপাশি হারাম শরিফের পুরো চত্বর জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। এর আগে গত মাসে জমজমের পানির সঙ্গে গোলাপ, উন্নতমানের সুগন্ধী উদ ও কসতুরি মিশ্রিত পানি দিয়ে কাবা শরিফ পরিষ্কার করা হয়। প্রত্যেক ওমরাহকারীকে জীবাণুমুক্ত করে হারাম শরিফে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। সৌদি কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, এক সফরে একাধিকবারও ওমরাহ করা যাবে। তবে আলাদা নিবন্ধন করতে হবে। দ্বিতীয়বার ওমরাহ করতে ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এবারের ব্যতিক্রমী হজ
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তীব্র সংক্রমণ শুরু হলে পবিত্র মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আশঙ্কা দেখা দেয় যে, ১৪৪১ হিজরির হজও বাতিল হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ সীমিত পর্যায়ে হজের আয়োজন করে। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা মেনে সৌদি আরবে অবস্থানরত ১০ হাজার মুসল্লিকে কেবল সংক্ষিপ্ত আকারে হজ করতে দেয়া হয়। এই সৌভাগ্যবানদের ৭০ শতাংশ ছিলেন সৌদিতে বসবাসকারী ১৬০টি দেশের লোকজন এবং বাকি ৩০ শতাংশ সৌদির স্থানীয় নাগরিক। হাজিদের গত ১৯ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য আইসোলেশনে রাখা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাদের ২৯ জুলাই জোহরের আগে মিনায় নেয়া হয়। ওইদিন থেকেই হজের কার্যক্রম শুরু হয়। ৩০ জুলাই আরাফাত ময়দান ও মসজিদে নামিরায় অবস্থান করানো হয়। হজে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২০ থেকে ৬৫ বছর বয়সের মুসল্লিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ৬৫ বছরের বেশি বয়সের কোনো মুসল্লিকে অনুমতি দেয়া হয়নি।
এবার হজের খুৎবা বাংলাসহ দশটি ভাষায় প্রচার হয়েছে। ২ আগস্ট মিনার কার্যক্রম শেষ করে বিদায়ী তাওয়াফের মাধ্যমে শেষ হয় পবিত্র হজ। ফিরে যাওয়ার আগে হাজিদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ হজের অন্যতম একটি কাজ। প্রত্যেককে জীবাণুমুক্ত কংকর সরবরাহ করা হয়, যা তারা নিক্ষেপ করেন। হজে অংশগ্রহণকারীদের কেউই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।
এবারের হজে অংশ নেয়া ৩৮ বছর বয়সের এক মালয়েশিয়ান প্রবাসী নারী ফাউজিয়া মোহাম্মদ আরব নিউজকে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে আমার জন্য ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি। নির্বাচিত হওয়ার সংবাদটি পেয়ে আনন্দে আমি কেঁদে ফেলি। মানুষের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে!
একই অনুভূতি বিবিসিকে জানান, ইন্দোনেশিয়ার সৌদি প্রবাসী ৩৯ বছর বয়সী ফরিদাহ বকতি। তিনি বলেন, হজে অংশ নেয়া আমার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল। স্মরণকালের ইতিহাসে এবারের মতো এত কম মানুষ আর হজ করেনি। আর এবারই হজ করার বিরল সুযোগ লাভ করি। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে যায়। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। চীনা হজযাত্রী নি হাওয়ুও সৌভাগ্যবানদের একজন। মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নি বলেন, মোবাইল ফোনে যখন খবরটি এলো সেই মুহূর্তে আনন্দে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। খুশিতে ছিলাম আত্মহারা, কান্না থামাতে পারছিলাম না।
পুবাল হাওয়া, পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া...
পবিত্র মক্কা ও মদিনা প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মক্কায় রয়েছে মহান আল্লাহর পবিত্রতম ঘর কাবা শরিফ এবং ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে এ শহরে। মদিনা হলো ইতিহাসের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী এবং এ শাশ্বত ধর্ম বিস্তারের কেন্দ্রস্থল। সেখানে চির বিশ্রামে আছেন আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা:। সেখানে রয়েছে প্রিয় নবীজী সা: প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নববী। আরো রয়েছে রওজা বা বেহেশতের বাগান। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি হলো বেহেশতের বাগানসমূহের একটি (রওজা)।’
মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা ঘর হচ্ছে মুসলমানদের কেবলা। পৃথিবীর প্রায় দেড়শ’ কোটি মুসলমান অন্তত দিনে পাঁচবার এ ঘরের দিকে মুখ করে মহান আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থায় দণ্ডায়মান হয়। ইসলামের দুটি পবিত্রতম স্থান, মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর সঙ্গে তাই মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি জড়িত।
মুসলিম জীবনে ইসলামের সব কথা ও কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে মক্কা-মদিনা। প্রতিটি মুসলমানের চোখে ভাসে কালো গেলাফ জড়ানো কাবা শরিফ। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর! মুসলমানরা কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়েন। আর হজে গিয়ে চোখের সামনে সেই কাবাকে দেখা, ছোঁয়া কত যে সৌভাগ্যের! কাবার জ্বল জ্বল করা দরজা স্পর্শ করা, হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরে চুমু খাওয়া, হাতিম ও মাকামে ইব্রাহিমে দু’রাকাত নামাজ আদায়, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে বিবি হাজেরার স্মরণে দৌড়ানো বা সাঈ করা যে কত পুণ্যের সে কি বলে বুঝানো যায়?
করোনা মহামারী ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। সুখবর হচ্ছে, এ মহামারীর থাবা কমে আসছে। আগামী অর্থাৎ ১৪৪২ হিজরি সালের হজ বিশ্ব মুসলিম আগের মতো স্বাভাবিকভাবেই করতে পারবে সবাই এ আশা করছে। মক্কা-মদিনা যাওয়ার সুযোগ যেন আর কখনো বন্ধ না হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের গানের বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছে- ‘দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে..., বক্ষে আমার কাবার ছবি, চক্ষে মুহাম্মদ, সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির..., পুবাল হাওয়া, পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া, এ গরিবের সালামখানি লইয়া...।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা