২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবাধিকারের ইসলামী দলিল

মানবাধিকারের ইসলামী দলিল - ছবি : নয়া দিগন্ত

মানবাধিকার মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। মানবাধিকার মানুষের স্বভাবগত। অর্থাৎ মানুষের যে স্বভাব তার মধ্যেই মানবাধিকারের দাবিটি রয়েছে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘কুল্লু মাউলুদিন আলাল ফিতরা।’ এর অর্থ হলো প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি স্বভাবের ওপর। সে স্বভাবের মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা। হজরত উমর রা:-এর একটি বিখ্যাত বক্তব্য আছে, ‘আল্লাহ তো তোমাদের সবাইকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছিলেন, কে তোমাদেরকে গোলাম করল?’ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য।

আমরা মানবাধিকারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, ‘মদিনার সনদ’ বা মদিনার রাষ্ট্র গঠনের সময় ইহুদিদের সাথে রাসূলুল্লাহ সা: যে চুক্তি করেছিলেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘মিসক আল মদিনা’ বা মদিনার চুক্তি, তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। এটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। তার আগে কোনো লিখিত সংবিধান কোনো রাষ্ট্রের ছিল কি না, তা ইতিহাস থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। এ সংবিধানে বিভিন্ন দিকের কথা বলা হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে রাষ্ট্র কেমন হবে, এর শাসক কে হবেন। কিন্তু একই সাথে এ সনদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কী অধিকার থাকবে তা-ও বলে দেয়া হয়েছিল। কাজেই এটি শুধু একটি সাংবিধানিক ডকুমেন্টই নয়, এটি একটি মানবাধিকার ডকুমেন্টও। বিশ্বের ইতিহাসে মানবাধিকারের ডকুমেন্টের মধ্যে মদিনার সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট বা দলিল। আগেই বলেছি, মানুষের স্বভাবের মধ্যে এটি আছে। কিন্তু ডকুমেন্ট হিসেবে যদি আমরা দেখতে চাই, তাহলে মদিনার সনদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝা যায়।

মানবাধিকার সংক্রান্ত ইসলামের যেহেতু একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং যেহেতু ইসলাম মূলত একটি নৈতিক শক্তি, সেজন্য তার একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সে কারণে যখন ওআইসি গঠিত হয় তখন এর নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করলেন যে, তাদের একটি মানবাধিকার দলিল প্রস্তুত করা দরকার। সে কাজটি শুরু হয় আশির দশকের প্রথম দিকে। ১০ বছর ধরে এর কাজ করা হয়েছে। এ জন্য সব ইসলামী চিন্তাবিদ, আইনজ্ঞ, ফিকাহবিদকে একসাথে যুক্ত করে ওআইসির ফিকাহ একাডেমি এ ডকুমেন্ট তৈরি করে। নানা পদ্ধতি, ঘাত, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের দিকে কায়রোতে এ ডকুমেন্ট পাস করা হলো। এটি একটি ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এখানে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

এ সনদের ১ অনুচ্ছেদের (ক) তে বলা হয়েছে : আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক মতবাদ, সামাজিক অবস্থান বা অন্য যেকোনো বিবেচনা নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান। খাঁটি ঈমান ব্যক্তির মধ্যে মানবিক পূর্ণতা এনে দিয়ে এ মর্যাদা বৃদ্ধির গ্যারান্টি দেয়।
(খ) প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তার সমগ্র সৃষ্টিজগতের কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু খোদাভীতি (তাকওয়া) ও সৎকর্মের ভিত্তিতেই একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে।

এ ধারাতে মানবজাতি বা সব মানুষের যে মৌলিক সমতা তা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ লিঙ্গ, জাতি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে ভেদাভেদ না করে মতবাদ নির্বিশেষে সবাই যে আল্লাহ তায়ালার অধীনস্থ বান্দাহ এবং তারা মানুষ হিসেবে সমান এ কথাটি তাতে বলা হয়েছে।
এ সনদের ২ অনুচ্ছেদে মানুষের জীবনকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তা নিম্নরূপ :

(ক) জীবন হলো খোদাপ্রদত্ত একটি উপহার এবং প্রত্যেক ব্যক্তিরই জীবন ধারণের সুনিশ্চিত অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে এ অধিকারকে যেকোনো প্রকার অবমাননা থেকে রক্ষা করা। শরিয়াহ নির্দেশিত কোনো কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা হারাম বা নিষিদ্ধ।

(খ) এমন কোনো কাজ করা বা উপায় অবলম্বন করা নিষিদ্ধ যা মানবজাতির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

(গ) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কারো জীবন রক্ষা করা শরিয়াহ নির্দেশিত একটি কর্তব্য।

(ঘ) শারীরিক ক্ষতি বা নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার জন্য সুরক্ষিত। একে নিশ্চয়তা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং শরিয়াহ নির্দেশিত কোনো কারণ ছাড়া এ অধিকার লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ।

এ সনদের ৬ অনুচ্ছেদে নারীর অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, (ক) মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশপরিচয় বজায় রাখার অধিকার।
(খ) পরিবারের ভরণপোষণ ও সার্বিক কল্যাণের দায়-দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তাবে। এ সনদের ৭ অনুচ্ছেদে পিতা-মাতা, শিশুদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের শিক্ষার অধিকারের কথা সনদের ৯ ধারাতে বলা হয়েছে।

এ সনদের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। কাউকে দাস করা যাবে না, গোলাম করা যাবে না, সব ধরনের উপনিবেশবাদ নিষিদ্ধ। তেমনিভাবে অন্যান্য ধারায় মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সবারই কাজ করার অধিকার থাকার কথা বলা হয়েছে। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে দায়িত্ব বা ক্ষমতা আমানত মাত্র। ২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এ সনদের আলোকে যা কিছু দেয়া হয়েছে এগুলো ইসলামী শরিয়াহর আওতায় হবে। যদি কোনো কিছুর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় তাহলে সেটি ইসলামী শরিয়াহ থেকে নিতে হবে- এ কথা ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।

মুুসলিম বিশ্বের জন্য ডকুমেন্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের সাথে বলতে হয় এ দলিলটি যতটা প্রচার হওয়ার দরকার ছিল সরকারসমূহের ব্যর্থতার জন্য, এনজিওগুলোর ব্যর্থতার জন্য কিংবা লেখকদের ব্যর্থতার জন্য এটি সেভাবে ছড়ায়নি। আশা করি, ভবিষ্যতের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ছড়ানো হবে। ইসলামের আলোকে সর্বসম্মত মানবাধিকার ঘোষণার এ অত্যন্ত মূল্যবান দলিলের মাধ্যমে আমাদের জাতি-সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement
জামায়াত হবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দেশের বৃহত্তম দল : ডা. তাহের ভিসা দেয়া না দেয়া ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় : ভূমি উপদেষ্টা ‘৫ আগষ্টের পর অনেকেই রূপ বদলে বিএনপি হয়েছেন’ জুরাইনে রিকশাচালকদের অবরোধ : ৪ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী : আইএসপিআর বগুড়ায় যৌথবাহিনীর অভিযান : বিদেশী পিস্তলসহ ৩ আ’লীগ নেতা গ্রেফতার মুন্সীগঞ্জে মহাসড়কের পাশ থেকে কিশোরের লাশ উদ্ধার বুড়িচংয়ে অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের পরিবারের সাথে স্মরণসভা শ্রীপুরে মহিলা আ’লীগের সভাপতি গ্রেফতার মুডি’স রেটিং অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিফলন নয় : বাংলাদেশ ব্যাংক নাটোরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

সকল