প্রবাসী আয় নিয়ে শঙ্কা
- সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
- ১৫ আগস্ট ২০২০, ০৭:৫২
বৈশ্বিক মহামারী গোটা বিশ্বকে ওলটপালট করে দিয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বাংলাদেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স আসে এমন দেশও রয়েছে আক্রান্ত দেশের মধ্যে। ভাইরাসটি দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইতালি, কানাডা, জাপান, হংকং, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখী করেছে। এসব দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে প্রবাসী আয়ে পড়েছে ভাটার টান, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি এ প্রথম সাত মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন এক হাজার ১০৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে মাত্র ৩০টি দেশ থেকে এসেছে এক হাজার ৯১ কোটি ডলার। বাকি রেমিট্যান্স এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে। রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষ ১৬ তে অবস্থান করছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। একইভাবে আরব আমিরাত দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে, মালয়েশিয়া পঞ্চম, ইতালি নবম, জাপান ২৪তম, হংকং ২৭তম এবং প্রবাসী আয়ের দিক থেকে চীন ৩০তম।
চীনের অর্থনীতির ব্যাপ্তি ও পরিসর বৃহৎ হওয়ায় অনেক দেশেই এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশও এ থেকে আলাদা নয়। সঙ্গত কারণে করনোয় আক্রান্ত দেশগুলোর সাথে পণ্য রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে ওই সব দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। এ ছাড়া এসব দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে ফিরছেন ব্যাপকভাবে। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহও হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সাথে ব্যবসায়িক মন্দার কারণেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার আশঙ্কাও করছেন তারা। কারণ, বাংলাদেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স আসে এমন অনেক দেশই এখন করোনায় বিপর্যস্ত।
দেশের মোট রেমিট্যান্সের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এ চার দেশ থেকে আসে ১১ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসে সোয়া ১২ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে সাড়ে ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে সাড়ে ৭ শতাংশ। এসব অঞ্চলের মধ্যে ইতোমধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোতে করোনার প্রভাব ভয়ানক রূপ নিয়েছে।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। এ দেশটিতেও করোনা আক্রান্তের হার উচ্চমাত্রার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার উদ্বেগজনক পর্যায়ের। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই যেমন দেশে ফিরছেন, তেমনিভাবে দেশ থেকে নতুন করে ওই সব দেশে কোনো কর্মী পাঠানোও সম্ভব হচ্ছে না। তাই করোনাভাইরাসের সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদি হলে এ খাতের অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর পরিস্থিতি সেদিকেই মোড় নিচ্ছে।
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের দেশ প্রবাসী আয় এখন সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ শতাংশে। পরের দুই অর্থবছরে আবার প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে আড়াই শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে সাড়ে ১৪ শতাংশ। এ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি মাথায় নিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ হার বাড়ে প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ আগের ঘাটতি সমন্বয় করলে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২১ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। গত অর্থবছর থেকেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিপরীতে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হলেও এশিয়ায় এই প্রভাব আরো বেশি জোরালো। আর প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়ার তিনটি দেশের একটি হবে বাংলাদেশ- এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ২০১৮ সালের চেয়ে চলতি বছর দেশের প্রবাসী আয় এক-চতুর্থাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই বছরের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমতে পারে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে প্রবাসী আয় নিয়ে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এডিবির এ পূর্বাভাসের মধ্যে জুলাইয়ে দেশে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এক হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী, করোনায় ২০২০ সালে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় হারাবে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের তুলনায় কোন দেশের কত প্রবাসী আয় কমতে পারে, সেই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এডিবির মতে, সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় কমতে পারে নেপালের। দেশটির প্রায় ২৯ শতাংশ প্রবাসী আয় কমে যেতে পারে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা তাজিকিস্তানের কমতে পারে প্রায় ২৮ শতাংশ। করোনা সঙ্কট যদি দীর্ঘায়িত এবং তা যদি আরো এক বছর স্থায়ী হয়, তাহলে এশীয় দেশগুলো কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হারাতে পারে, তা দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে ২০২০ সালে সারা বিশ্ব প্রায় ১০ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় হারাতে পারে। করোনা না থাকলে যত প্রবাসী আয় প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এর চেয়ে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ কম প্রবাসী আয় আসবে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে এশীয় দেশগুলো। এশীয় দেশগুলোর প্রবাসী আয় কমতে পারে প্রায় পাঁচ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ কম। এডিবির বক্তব্য হচ্ছে, করোনা সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এতে প্রবাসী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন। তাদের চাকরির ঝুঁঁকি বেড়েছে। তা বহু প্রবাসী শ্রমিক ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকের মজুরি কমে গেছে।
এশিয়ার কোন অঞ্চলে কত প্রবাসী আয় কমতে পারে, সেই হিসাবও দিয়েছে এডিবি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দুই হাজার ৮৬০ কোটি ডলার কম পাবে, যা ২০১৮ সালের মোট প্রবাসী আয়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া সেন্ট্রাল এশিয়া ৩৪০ কোটি ডলার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এক হাজার ১৭০ কোটি ডলার, পূর্ব এশিয়া (চীন ও জাপান ছাড়া) ১৭০ কোটি ডলার ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দুই কোটি ৬৭ লাখ ডলার প্রবাসী আয় হারাতে পারে বলে মনে করছে এডিবি।
এ বছর বিশ্বের কোন অঞ্চল থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমবে, তা-ও বলেছে এডিবি। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে দুই হাজার ২৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রবাসী আয় কমে যাবে। এই অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এশীয় দেশগুলো এ বছর যত প্রবাসী আয় হারাবে, তার ৪১ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসবে না। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমবে দুই হাজার কোটি ডলারের প্রবাসীর আয়। যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৩৪০ কোটি ডলার কম অর্থ আসবে।
করোনার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায়ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়ায় তারা অভিবাসী শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। এতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর। ফলে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের ছন্দপতনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)।
করোনার কারণে উপসাগরীয় দেশগুলোয় পর্যটন, সেবা ও নির্মাণ খাতে কর্মরত অসংখ্য অভিবাসী সম্প্রতি চাকরি হারিয়েছেন। সিঙ্গাপুরপ্রবাসী শ্রমিকরা ব্যাপকহারে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাহরাইন, কুয়েত, মালদ্বীপ, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে চাপ দিচ্ছে।
সম্প্রতি প্রবাসী আয়ের সেবার সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএএমটিএন একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এই সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, করোনার কারণে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাধারণত বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের প্রায় অর্ধেকেই ওই দেশগুলো থেকে আসে। তাই প্রবাসী আয়ে এই নি¤œগামীতা আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছে এডিবি। বিশেষ করে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করার কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র পরিবারগুলোকে নগদ সহায়তা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের জাতীয় আয়ের উল্লেøখযোগ্য অংশ হচ্ছে প্রবাসী আয়। তাই আমাদের অর্থনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে প্রবাসী আয় যেকোনো মূল্যে সচল রাখতে হবে। হারানো শ্রমবাজার ধরে রাখার চেষ্টা ও নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। একই সাথে কর্মচ্যুত ও দেশে ফেরত প্রবাসীদের পুনর্বাসন করাও জরুরি। অন্যথায় আমাদের অর্থনীতির পথচলা মসৃণ হবে না।
smmjoy@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা