২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মৎস্য সপ্তাহ : বাঙালি বাঁচুক মাছে-ভাতে

মৎস্য সপ্তাহ : বাঙালি বাঁচুক মাছে-ভাতে -

গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ’। চলবে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। এ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অন্যান্য বারের মতো সারা দেশে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন লেকে মাছের পোনা ছেড়ে এই সপ্তাহের উদ্বোধন করবেন। এরপর উপর্যুপরি কয়েক দিনে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার এবং ঢাকার মেয়ররাও বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ ছাড়বেন। এ ধরনের সপ্তাহ পালনে সরকারি পর্যায়ে কিছু গৎবাঁধা কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়া মাছে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগবিরোধী অভিযান, মৎস্য আইন বাস্তবায়নে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, চাষিদের মাছ চাষের বিষয়ে পরামর্শ দান, চাষিদের মধ্যে মাছ চাষের উপকরণ বিতরণের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে এবারের স্লোগান ‘মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি, সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি’।

এটা ঠিক, কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য একেবারে খারাপ নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিই গর্ব করার মতো। সুপ্রাচীনকাল থেকেই কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নে কৃষি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। বলা যায়, কৃষির উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন, জাতির উন্নয়ন। এ জন্যই ১৯৭৫-এর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা করে মানুষকে স্বনির্ভর হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিলেন। তিনি মানুষকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

ছোট ছোট উদ্যোগ যেমন, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলা, সমবায়, আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার, গাছ লাগানো ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন জিয়া। তিনি এসব স্বকর্মসংস্থানে পুঁজি সরবরাহের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। তার সুযোগ্য অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এসব কাজের জন্য সহায়ক খাতে অর্থ জোগান দিয়ে সারা দেশে একটি সত্যিকারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পোলট্রি ও ডেইরি খাতের বিকাশ সেভাবেই হয়েছে। বর্তমানে দেশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে শীর্ষে না হলেও বিশ্বের সেরাদের কাছাকাছি অবস্থান দখল করতে সক্ষম হচ্ছে। সেটি জিয়াউর রহমানের অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি উদ্বুদ্ধ না করলে আমরা হয়তো কোনো দিনই নিজের হাতে কাজ করার মনোবলই অর্জন করতে পারতাম না।

খাদ্য উৎপাদনে আজ আমাদের দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান, গম ও ভুট্টা চাষে এদেশ বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে চতুর্থ বা পঞ্চম অবস্থানে উঠে এসেছে এটি নিঃসন্দেহে বিশাল অর্জন। সব মিলিয়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

মৎস্য সপ্তাহে আমরা বরং মাছ নিয়েই কিছু বলা বিধেয়। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস মাছ। কবে কে চালু করেছিলেন মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা জানা নেই, কিন্তু একটি কালজয়ী সত্য তিনি উচ্চারণ করে গেছেন। মাছ চাষের বা আহরণের সাথে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং মানবদেহে পুষ্টি সরবরাহে মাছের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য হলো, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শুধু মৎস্য খাতের অবদান এখন ৪ শতাংশ। আর এটিই বর্তমানে আমাদের জন্য বড় সুসংবাদের উৎস।

চলমান করোনা মহামারীকালে নানা দুঃসংবাদ যখন মানুষের শ্বাসরোধের উপক্রম করেছে তখন একটিই সুখবর নিয়ে এসেছে আমাদের মৎস্য খাত। মিঠা পানির মাছের ফলনের দিক থেকে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। গত ৮ জুন জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০ এই সুখবর দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই অর্জনের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দেশি মাছের চাষোপযোগী উন্নত জাত উদ্ভাবনকে। এফএও এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) একাধিক প্রতিবেদনও বলছে, বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া অত্যন্ত সুস্বাদু ইলিশ রক্ষায় সরকারের বিশেষ উদ্যোগও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। গত চার বছরে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দুই লাখ টন বেড়েছে। ভবিষ্যতে সামুদ্রিক মাছ আহরণের বিষয়ে মনোযোগ দেয়া হবে বলে জানান সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তারা। তা হলে আমাদের সামুদ্রিক মাছের উৎপাদনও বাড়বে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক বছরখানেক আগে বলেছিলেন, জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বশীর্ষে যাবে। তিনি বলেছিলেন, ওই সময় বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে চার নম্বরে ছিল। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চীনের উদ্ভাবিত মাছের জাত-পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় আসছে বাংলাদেশের সাফল্য। ওইসব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে আমাদের বাংলাদেশ।

আমাদের দেশের মিঠা পানিতে বসবাস করে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ। এ ছাড়া খাঁড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতে আছে কয়েক শ’ প্রজাতি। এর মধ্যে চাষযোগ্য মাছের প্রজাতি হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, বিদেশী মাগুর, থাই পাঙ্গাশ ইত্যাদি। এসব মাছের কিছু বিশেষ গুণ আছে। এগুলো খুব দ্রুত বাড়ে; খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না; পুকুরে অধিক সংখ্যায় চাষ করা যায়; পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে, পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে; খেতেও সুস্বাদু; বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে; সহজে রোগাক্রান্ত হয় না, চাষে লাভ বেশি। এ জন্য লাভজনকভাবে এসব মাছে চাষ করা যায় অনায়াসে। এসব কারণেই দেশের অনেক মৎস্যজীবীর পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত তরুণও মাছ চাষে এগিয়ে এসেছেন। এটিকে আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ করছেন তারা।

সুবিধা হলো, একই পুকুরে যেমন নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়, তেমনি খাল, বিল ও ডোবায়ও মাছ চাষ করা যায়। এমনকি চৌবাচ্চায়, খাঁচায়ও তা চাষ করা যায়। মাছ এ দেশের সব প্রাকৃতিক জলাশয়ে মানুষের কোনো রকম প্রয়াস ছাড়াই বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয়। তবে সেটিকে মাছ চাষাবাদ বলা হয় না। মাছ চাষের সংজ্ঞা হলো, নির্দিষ্ট জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প পুঁজিতে, অল্প সময় ও যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিকভাবে যে পরিমাণ ফলন হয়, তার চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন করা। এভাবে যে মাছের চাষ করা হয় তাতে লাভবান হতে হলে খুব যত্নের সাথে কিছু নিয়মকানুন মেনে কাজ করতে হবে। মাছ চাষের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি পর্বে উদ্যোক্তা বা চাষিকে বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হয়।

মাছচাষির অজ্ঞতা বা অবহেলা বা ভুল লাভজনক মাছ চাষের ক্ষেত্রে অন্তরায়। মাছ যেহেতু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রায় অপরিহার্য, তাই এর চাহিদাও বিপুল। সে কারণে মাছ চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। যেকোনো বাজারেই মাছ বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া বিদেশে মাছ রফতানি করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত রুই, কাতলা, কই, তেলাপিয়া, কালিবাউশ ও সরপুঁটির উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের পুকুরে যত মাছ চাষ হচ্ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি এসব জাতের। তারা দেশের বিলুপ্তপ্রায় ২২টি প্রজাতির মাছের চাষ করা পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন। সেগুলোর মধ্যে আছে টেংরা, পাবদা ও মলার মতো পুষ্টিকর বিভিন্ন মাছ। ঢাকার বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে এসব মাছের যে প্রচুর সরবরাহ দেখা যায় তার পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানীদের অবদান। মলা, ঢেলা, চেলা, কাজলি, বাতাসি ইত্যাদি মাছ বাজার থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এগুলো চাষের তালিকায় আনা যায় কি না সরকার ভেবে দেখতে পারে বিশেষভাবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মূলত প্রযুক্তিভিত্তিক মাছ চাষের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সর্বোপরি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। তারা যেসব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিচ্ছেন, তাতে তারা আরো উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আগামী বছরের মধ্যে দেশে ৪৫ লাখ টন মাছের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এটি সম্ভব হলে তা দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি হবে।

চলতি মৎস্য সপ্তাহে আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ শুধু মাছ উৎপাদনে নয়, পুরো কৃষি খাতেই বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত হবে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়কালে যেকোনো কারণেই হোক, হয়তো কাকতালীয় ঘটনাই যে, কৃষি খাত এমন দু’জন মন্ত্রী পেয়েছেন, যারা সৎ বলে বিশ্বাস করেন অনেকে। বর্তমানে যিনি মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী তারও আন্তরিকতার সুনাম শুনেছি। সুতরাং তাদের সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম কৃষি খাতকে সর্বশীর্ষে নিয়ে যেতে পারে এমন আস্থা আমরা রাখতে চাই। আমাদের আগামী দিনের স্লোাগান হোক, ‘বাঙালি বাঁচুক মাছে-ভাতে’।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
৮ মেগা প্রকল্পের নথি তলব দুদকের প্রত্যেক ধর্মের শান্তির বাণী নিজের মধ্যে স্থাপন করতে হবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ছক আ’লীগের গণহত্যায় জড়িতদের জায়গা হবে না বিএনপিতে : ফখরুল আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো সাবেক এমপি ও ৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা আমাদের শাসক আমরা ঠিক করব ভারত নয় : ডা: শফিক প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিরুদ্ধে হাসিনাকে কোর্টে যেতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ ও বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল গঠন দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত শেখ হাসিনা-জেল সুপারসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন চিঠির জবাব পেলে হাসিনাকে ফেরানোর পরবর্তী পদক্ষেপ

সকল