বর্ণবাদ, বৈষম্য ও ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ২৭ জুন ২০২০, ২২:২৫, আপডেট: ২৭ জুন ২০২০, ২২:১৬
মানব সভ্যতা, বিশেষ করে পশ্চিমা সভ্যতা বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আমেরিকায় একজন কালো বর্ণের মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বৈষম্য শুরু হয়নি। এর আগে ইংল্যান্ড দাসপ্রথা শুরু করেছিল সপ্তদশ শতকে। তারাই আমেরিকা মহাদেশে হত্যা-নিপীড়ন চালিয়ে সেখানকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করেছে। সম্পদের লালসায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের ধরে আমেরিকায় নিয়ে যেত কাজ করানোর জন্য। আজকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া মামলা করেছে। অতীতে ওই অঞ্চলটি ছিল আফ্রিকা থেকে দাস পাচারের অন্যতম রুট। গাম্বিয়া থেকে নদীপথে দাসভর্তি জাহাজ আমেরিকার পথে পাড়ি জমাত। এরপর আমেরিকায় স্বাধীনতার যুদ্ধ হলো ১৭৭৫ সালে। পরে আব্রাহাম লিঙ্কন গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আসলে সে দেশে তা বিলুপ্ত হয়নি, নানা আদলে শুধু টিকেই থাকেনি; আরো বিকশিত হয়েছে। তখন দাসদের ওপর শারীরিক নিপীড়ন চলত। এখন মানুষকে মারা হচ্ছে তিলে তিলে।
আমরা যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনকে ‘পশ্চিমা সভ্যতার সূতিকাগার’ মনে করি। এই ব্রিটেনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কিন্তু দাসত্ব ও শোষণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। লর্ড ক্লাইভরা যে বর্ণবাদী ছিল সেই দাবি তো এখন সেখানেই উঠছে। তারা শাসন করেছে জনগণকে শোষণের জন্যই। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর দাস ব্যবসা তুঙ্গে উঠে। বিশ্বে বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয়দের কলোনি স্থাপিত হয়। বেশির ভাগ দেশ ছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপনিবেশ। ইংরেজ, ডাচ, ফরাসি, পর্তুগিজ, জার্মানসহ সবাই আছে এ দলে। ফিজিতে গিয়ে দেখেছি, ঔপনিবেশিক শাসকরা বিভিন্ন দেশ থেকে চাষাবাদের জন্য শ্রমিক নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এসব শ্রমিককে সেখানে ভূমির অধিকার দেয়া হয়নি। ফলে ওরা কয়েক শ’ বছর ধরে ভূমিহীন শ্রমিক হিসেবেই আছে। যুগ যুগ ধরে একটি দেশে আছে, সেখানকার পরিবেশ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে; অথচ ভূমির অধিকার নেই। এরা দাস নয়তো কী? ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোই এর জন্য দায়ী। এটাই তো ‘বর্ণবাদ’।
অনাদিকাল থেকে মানুষ মানুষকে শোষণ করেছে। অসহায় ও দুর্বলরা সবসময় শোষিত হয়েছে। এই উপমহাদেশের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে সংগ্রাম করে এখানকার মুসলমানরা ‘পাকিস্তান’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমাদের এই অংশের মুসলমানরাই অগ্রভাগে ছিল। মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র চাওয়ার পেছনে ছিল এক ধরনের বর্ণবাদ। কারণ বর্ণহিন্দুরা মুসলমানদের ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখত। ব্রিটিশদের পাশাপাশি হিন্দু জমিদাররা কিভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করত সেই কাহিনী বাবা, নানার কাছে শুনেছি। ছাতা মাথায় দিয়ে কেউ জমিদারের কাছে যেতে পারত না। জুতা হাতে নিয়ে যেতে হতো। সাহিত্যেও বর্ণবাদ ও বৈষম্য ছড়ানো হতো। এমন অনেক লেখক ছিলেন যারা হিন্দুদের মহান আর মুসলমানদের নীচ ও হীন হিসেবে উপস্থাপন করতেন। অবশ্য পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর আমরা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ বৈষম্যের শিকার হলাম।
তৎকালীন পাকিস্তান প্লানিং কমিশনে কাজ করার সুবাদে একেবারে ভেতর থেকে বৈষম্য দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ‘আঞ্চলিক উন্নয়ন’ অংশের খসড়া তৈরি করার। এটি করতে গিয়ে হিসাব করে দেখিয়ে দেই, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্র যে পরিমাণ খরচ করে বলে দাবি করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। আমি যখন ড্রাফটি তৈরি করি, তখন পরিকল্পনা কমিশনে আমার ওপরের দায়িত্বশীলরা এটা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু আমার বিশ্লেষণে কোনো খুঁতও ছিল না। আন্তরিকভাবে চেয়েছিলাম এই বৈষম্যের বিষয়টি সবাই জানুক এবং তা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু তারা তা চাননি। আমার ড্রাফটটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। যে কারণে দেখা যায়, পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ‘আঞ্চলিক উন্নয়ন’ অধ্যায়টি অনুপস্থিত (ইতঃপূর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি নয়া দিগন্তে)।
কোনো সম্প্রদায়কে হীনভাবে উপস্থাপন করে উপন্যাস, গল্প, কবিতা রচনা কিংবা সিনেমা বানানোও বর্ণবাদ। আমি আফ্রিকাতে গিয়ে দেখেছি কিভাবে মানুষকে দাসে পরিণত করে রাখা হয়েছে। ১৯৮০’র দশকে সুলতান অব সোকোতোর অতিথি হয়েছিলাম। সুলতানের প্রাসাদে আমরা অতিথিরা যখন বসেছিলাম তখন হঠাৎ দেখি দেয়ালে ছোট ছোট জানালার মতো দরজা দিয়ে খানসামারা মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দেয়ার মতো করে এসে হাজির। পরে জানলাম ওই সব খানসামা যেন মাথা নত করে সুলতানের সামনে হাজির হতে বাধ্য হয় সে কারণেই দরজাগুলো ওই বিশেষ কায়দায় তৈরি করা। এটাও তো বর্ণবাদ। তাই আমি বলছি, যত রাজা, বাদশাহ, সম্রাটের কথা আমরা জানি, তারা কিন্তু এই বৈষম্যকে ভিত্তি করে এবং মানুষকে শোষণ করে ওই পর্যায়ে গেছেন। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন এটি তৈরির পেছনে ঘাম ঝরানো শ্রমিকদের কথা ভেবেছি, তেমনি রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখে শ্রমিক ও দাসদের ওপর শক্তিমানদের নিষ্ঠুরতা কল্পনায় দেখেছি। মিসরে ফারাওদের পিরামিডও একই সাক্ষ্য দেয়।
তবে বৈষম্যের সব ইতিহাস এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। যে মহাত্মা গান্ধীকে শান্তির প্রতীক হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক দশক ধরে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এখন শুনছি বর্ণবাদী আচরণের কারণে তার মূর্তি ভাঙা হচ্ছে। এই উপমহাদেশকে প্রায় দুই শ’ বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার ‘কৃতিত্ব’ লর্ড ক্লাইভের। একসময় ব্রিটিশদের কাছে সে ছিল বীর। এখন তারাই ক্লাইভের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং তার মূর্তি ভাঙছে। আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য সুখ্যাতির অধিকারী কলম্বাস এখন আর শ্রদ্ধার পাত্র নয়। একইভাবে অস্ট্রেলিয়াবাসী সোচ্চার হচ্ছে জেমস কুকের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। ইতিহাস যে কাউকে ক্ষমা করে না, এটা তার প্রমাণ।
আসলে যুগে যুগে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে না পারা এবং মানুষকে ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতা থেকেই এমনটা হয়েছে। আজকে করোনা মহামারীর সময় স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা আমরা দেখছি। পাশাপাশি আধুনিক সভ্যতায় টিকে থাকা বৈষম্য ও দাসত্বের মতো কুৎসিত দিকগুলোও আমাদের সামনে প্রকট হয়েছে। এসব সঙ্কট কাটাতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয় হানাহানি। আর এই হানাহানি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’ গঠন করা প্রয়োজন। এটা হবে বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়, জাতি বা উপজাতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমরা মানবতার কথা বলছি। কিন্তু মানবতার শিক্ষা বা দীক্ষা কোথায়?
আজকে এই উপমহাদেশের দিকেই আমরা তাকাই না কেন? এখানে যে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে, এই উগ্রবাদ ধর্মভিত্তিক। অথচ কোনো ধর্মেই উগ্রতার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে নমনীয়তার কথা, সহনশীলতার কথা। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনার কথা। আমি যে ‘হিউম্যান কমিউনিটিজ’ গড়ে তোলার কথা বলছি তার মূল চেতনা হলো, ‘উগ্রবাদ পরিহার করো। তোমার আসল পরিচয়, তুমি মানুষ’। এই পরিচয় তো কেউ অস্বীকার করেনি।
আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করছি, কিন্তু কাজ করছি অসভ্যের মতো। উগ্রবাদিতা মানবজাতির কলঙ্ক। সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছার পর এখন আমরা উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমরা যদি মানুষকেই ভালোবাসতে না পারি, তাহলে ধর্মচর্চা করে কী হবে? তাই বলছি, বাংলাদেশের মতো ছোট অথচ বৈচিত্র্যময় ধর্মের মানুষের বসবাসের এই ভূখণ্ড থেকেই ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’-এর যাত্রা শুরু হতে পারে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কেন এই নৃশংসতা? ১৯৩৫ সালেও বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ব্রিটিশ ভারতের অংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশের অংশ।
শ্রীলঙ্কাও তাই ছিল। আমরা ব্রিটিশকে তাড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু সভ্য হতে পারিনি। এর পেছনে দায়ী ‘জাতিরাষ্ট্র’। আমার সীমানা, আমার রাজ্য, আমার শাসনক্ষমতা- এসবই যত সমস্যার সৃষ্টি করছে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপ থেকে এসেছে। এটা বৌদ্ধ, মুসলমান বা হিন্দু ধর্মের ধারণা নয়; কোনো হিউম্যান কনসেপ্ট নয়। তাই বলে এই ধারণা রাতারাতি বদলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে সব ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা সৃষ্টির কাজ আমরা করতে পারি। প্রতিহিংসা শুধু প্রতিহিংসারই জন্ম দেয়, ঘৃণা থেকে ভালোবাসার জন্ম হয় না। ভালোবাসার জন্ম হয় ভালোবাসা থেকেই। বিদ্বেষ, বিভাজন কখনো শান্তি আনতে পারে না। ইতিহাস বলে, ভালোবাসার মধ্যেই শান্তি নিহিত। শান্তি আছে ত্যাগ ও ক্ষমায়।
আমাদের বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, উপজাতিসহ অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রের মানুষ আছে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ গঠন করতে পারি। এতে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ অংশ নিতে পারে। এই কমনওয়েলথের বাণী হবে শান্তি ও ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে মুসলিম মা-বাবার ঘরে না পাঠিয়ে হিন্দু বা খ্রিষ্টান মা-বাবার ঘরেও পাঠাতে পারতেন। তাই একটি ধর্মীয় তকমা থাকলেই কি আরেকজনকে ঘৃণা করতে হবে? আমার আসল পরিচয় মানুষ, হিউম্যান। আমরা এই ভালোবাসা বিস্তারের কাজটি শুরু করছি না কেন? আমরা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে, মানুষকে ভালোবাসার বাণী ছড়াতে পারি।
এই করোনা মহামারীর সময়ে মানুষের প্রতি আরো বেশি করে ভালোবাসা প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
লেখক : ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক পরামর্শক, অর্থনীতির অধ্যাপক, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা