খাদ্য যখন এক নম্বর অ্যাজেন্ডা
- জসিম উদ্দিন
- ২৯ এপ্রিল ২০২০, ২০:২১
মানুষের প্রথম প্রয়োজন কোনটি? এর উত্তরে শেষ পর্যন্ত খাদ্যের কথাই আসবে। মানুষ যে ইতিহাস রচনা করেছে তাতে দেখা যায়, মানুষের পোশাক ছিল না; ঘর ছিল না, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তাকে অবশ্যই খেতে হয়েছে। অন্য দিকে স্র্রষ্টার রচিত ইতিহাস বলছে- শুরুতেই সবকিছু জোগাড় করে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে তিনি পাঠিয়েছেন। সেখানেও খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীতে যখন বড় দুর্যোগ-মহামারী দেখা দেয়, তখন খাদ্য হয়ে ওঠে প্রধান আলোচ্য বিষয়। সাধারণত দুর্যোগের হাত ধরেই দেখা দেয় খাদ্যঘাটতি। এভাবে দুর্ভিক্ষে পড়ে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানির ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে। খাদ্য সমস্যার সমাধান করে অনেকে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
সাড়ে তিন হাজার বছর আগের ঘটনা। মিসরের তখনকার রাজা একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তার দরবারের ড্রিম ইন্টারপ্রেটাররা। এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার কারাগারের এক কয়েদি। ইতিহাস তাকে জোসেফ নামে শনাক্ত করে। ওই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন- রাজ্যে সাত বছর ভালো ফলন হবে। এরপরের সাত বছর হবে অনাবৃষ্টি ও খরা। সাত বছরের উৎপন্ন ফসল দিয়ে বাকি সাত বছরের ঘাটতি মেটাতে হবে। তাই খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বণ্টন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী এই সময়ে আরেকটি খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
মিসরের রাজা এ সঙ্কটে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সমস্যা সমাধানে একজন উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি খোঁজ করছিলেন। ওই কয়েদি এই সমস্যা মোকাবেলায় কাজ করতে পারবেন বলে জানালে রাজা সানন্দে তাকে দায়িত্ব নেয়ার আমন্ত্রণ জানান। জোসেফ সঙ্কটের গভীরতা বুঝতে পেরেছিলেন। সাত বছরে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন, সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও পরবর্তীতে সেগুলো সঠিকভাবে বণ্টন করতে না পারলে দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঠেকানো যাবে না। এ দিকে এই স্বপ্ন বিশ্বাস না করার কারণে কৃষকরা এ কাজে সহযোগিতাও করতে চাচ্ছিল না। তা ছাড়া বিপুল খাদ্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ ও পরবর্তীতে খাদ্য বণ্টনের কৌশল নির্ধারণ ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
দেখা গেল, ওই কয়েদি পরে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রথমে সাত বছরে যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। নীলনদের পানি খাল খনন করে টেনে নিয়ে তিনি আবাদি এলাকার পরিমাণ বাড়াতে পেরেছিলেন। উৎপাদিত বাড়তি ফসল সংরক্ষণের জন্য বড় বড় হিমাগার নির্মাণও তিনি যথাসময়ে করতে পেরেছিলেন। সেগুলোতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাত বছরের খাদ্য মজুদ করা হয়েছিল। সব শেষে বণ্টনের জন্য একটি উন্নত ফর্মুলাও তিনি উদ্ভাবন করতে পেরেছিলেন।
সাত বছর পর সত্যি সত্যি অনাবৃষ্টি শুরু হলো। খাল-বিল-নদীনালা শুকিয়ে সব চৌচির হয়ে গেল। দলে দলে মানুষ খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল। পুরো সাত বছর সরকারি হিমাগার থেকে মানুষের জন্য খাদ্য জোগানো হয়েছিল। জোসেফ একটি সুন্দর বণ্টনব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আশপাশের দেশের মানুষও এই দুর্ভিক্ষে মিসরের খাদ্যগুদাম থেকে সহায়তা পেয়েছে। পৃথিবীতে যখন কোনো বিপর্যয় নেমে আসে, তখন শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ, সঙ্কটের মোকাবেলা করতে না পারলে শাসকদের পতন দেখা দেয়।
মিসরের সমাজে অভিজাতরা শোষণ করত নি¤œবর্র্ণের মানুষের ওপর। দুর্ভিক্ষের মধ্যে উদ্ভাবিত জোসেফের খাদ্য বণ্টনব্যবস্থা সমাজের অন্যায়কারী অভিজাতদের বাড়তি ক্ষমতার অবসান ঘটায়। এতে গরিব ও মেহনতি মানুষ ক্ষমতায়িত হয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার সময়মতো কৌশল নেয়া না গেলে খরার সাত বছরে মিসরসহ ওই অঞ্চলের মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাত। সঙ্কটের এমন অভাবিত সমাধান রাজদরবারে জোসেফের প্রভাব বৃদ্ধি করে। তৎকালীন শাসক তাকে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পদোন্নতি দিলেও কার্যত জোসেফের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। তবে তিনি ক্ষমতার অবৈধ চর্চা করেননি। সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার নীতি তাকে আরো মহান করে তোলে। সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কুরআন জোসেফকে ইউসুফ আ: হিসেবে শনাক্ত করে। তার নামে একট দীর্ঘ সূরাও রয়েছে। সেখানেও ওই সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতির চমৎকার বর্ণনা রয়েছে।
নভেল করোনার কারণে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থায় ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার ২৫ এপ্রিল সংখ্যায় প্রথম পাতার একেবারে উপরে একটি বড় ছবি দিয়েছে। পাঁচ কলাম ছবিটি একজন টমেটোচাষির। ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে এই টমেটোচাষির ক্ষেত পাকা টমেটোয় পূর্ণ। ওই চাষি জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষেতের টমেটো ক্ষেতে পড়ে আছে। তিনি জানান, তার দুই লাখ টাকার ক্ষতি হবে। পত্রিকাটি লিখেছেÑ বগুড়া, ঠাকুরগাঁও এবং যশোরের সবজিচাষিরা কঠিন দিন পার করছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে সবজি বিক্রি এখন তলানিতে ঠেকেছে।
একই দিন পত্রিকাটির পেছনের পাতায় নিচের দিকে আরেকটি বড় ছবি ছেপেছে। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন কৃষকের সাথে পাঁচজন যুবক। সবাই ধান কেটে এক হাতে কাঁচি অন্য হাতে কাটা ধান উঁচু করে ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন। ছবির ক্যাপশনে লেখা রয়েছে- ছাত্রলীগ কর্মীরা কৃষক আবু মিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছেন। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার হারিকোনা হাওরে তারা ধান কাটছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা কৃষিশ্রমিকের ব্যাপক সঙ্কটের মধ্যে ধান কাটতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জ ও সিলেটের হাওরাঞ্চলে।
এক দিন আগে দৈনিক প্রথম আলোর শেষের পাতায় ছাপানো আরেকটি ছবিতে দেখা যায়- বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা রয়েছেÑ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নগরপাড়া বিলের কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন তারা। এ জন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না। বোরো ধান মাঠ থেকে উঠানোর ঠিক এই সময়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিছু ধান আগেই উঠানোর কথা থাকলেও কৃষিশ্রমিক না পাওয়ায় তা উঠাতে পারেননি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকার কৃষকরা। কৃষি অফিস হাওর এলাকার কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে- পাকা, আধা-পাকা ধান যতটুকু পারা যায় মাঠ থেকে কেটে আনতে। আচমকা বন্যায় তলিয়ে হাওরাঞ্চলে এ ধান একেবারে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় শ্রমিক সঙ্কটে দিশেহারা কৃষকের ধান কাটতে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের যুবকরা।
সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের সদস্যের অভাব হয় না। সারা দেশে সবসময় সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের লাখ লাখ সদস্য থাকে। এরা সবাই এই দুর্যোগে কৃষকের সহায়তায় নেমে গেলে মাঠে ধান পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনও নিশ্চয়ই থেমে থাকবে না। তারাও কৃষকদের সহযোগিতা করতে প্রতিযোগিতা করে নেমে যাবে। যার লক্ষণ আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি।
বাস্তবতা হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যম হয়ে উঠছে প্রদর্শনের একটি হাতিয়ার। সবাই এখানে নিজের বিজ্ঞাপন দিতে উদগ্রীব। কেউ এক মুষ্টি চাল দিয়ে ছবি নিয়ে এখানে হাজির হচ্ছেন। কয়েকটি মাত্র ঝরেপড়া পাতা কুড়াতে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের ডজনখানেক কর্মকর্তাসহ রাস্তা ঝাড়– দেয়ার ছবি ফেসবুকে দেখা যায়। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন সত্যিকার অর্থে নিজেদের মার্কেটিং না করে কৃষকদের সহযোগিতায় নেমে গেলে লাখ লাখ কৃষিশ্রমিকের অভাব সত্যিকার অর্থে পূরণ হওয়ার কথা। এর সাথে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনও মাঠে থাকার চেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক-সাস্কৃতিক আরো নানা সংগঠন এ কাজ করতে আগ্রহী হবে আশা করা যায়। হাওরাঞ্চলে বাম্পার ফলনের পুরো সুযোগটি এভাবে নেয়া যেতে পারে।
চলমান অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে খাদ্যপ্রাপ্তি চ্যালেঞ্জ হবে। সময়মতো খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বণ্টনব্যবস্থা সচল না রাখা গেলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এমন খাদ্যাভাব থেকে এ দেশে কয়েকবার দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটেছে। তাই এখন থেকে খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে কৃষকরা টিকে থাকতে পারবেন না। তাদের উৎপাদিত ফসল যাতে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় এবং ফসলের বিনিময়ে তারা যাতে উপযুক্ত মূল্য পান সে দিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। jjshim146@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা