সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট
- জসিম উদ্দিন
- ২২ এপ্রিল ২০২০, ২০:২২
যোগ্যদের বাঁচার অধিকারের প্রসঙ্গটি আবার ফিরে এলো। নভেল করোনাভাইরাস মানুষের মধ্যে একটা বিশেষ শ্রেণীকে কাবু করছে। এদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। বাকিদের জীবনের ওপর খুব বেশি ঝুঁকি নেই। অন্য দিকে, সব কিছু বন্ধ করে দেয়ায় মানুষের জীবন অচল হয়ে গেছে। দম বন্ধ হওয়া এমন পরিবেশ অন্যরা সইবেন কেন! আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের এক অংশ এই মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যাদের ওপর এ ভাইরাস কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারবে না তারা কেন এই একঘেয়ে জীবনে আটকে পড়বেন।
তাদের মতে, লকডাউন করে সব কর্ম বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলে তার পরিণামও ভয়াবহ। একসময় খাদ্য ফুরিয়ে গিয়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে। শেষে মহামারীর চেয়ে দুর্ভিক্ষে আরো বেশি মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন জৈব পরিসংখ্যানবিদ বলেছেন, সবাই বক্ররেখাটিকে সমতল করার চেষ্টা করছে। এতে করে সঙ্কটের কাল আরো দীর্ঘ হবে। নিউ ইয়র্ক সিটির রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারীতত্ত্ব ও গবেষণা ডিজাইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নট উইটকোভস্কি বলতে চাইছেন, এটা রকেট ছোড়ার মতো একটা ব্যাপার। প্রথমে সেটি উপরের দিকে উঠবে। তারপর নিচের দিকে নেমে আসবে। একসময় মাটিতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়ে শেষ হয়ে যাবে। তার মতে, নভেল করোনাকে মানুষের সাহসের সাথে মোকাবেলা করা উচিত।
তার মতে, ৮০ শতাংশ মানুষকে ভাইরাসটির সংস্পর্শে আসতে দেয়া উচিত। এতে করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হবে। তিনি আরও বলেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষেরই কোনো কিছু হয় না। বিশেষ করে শিশুদের এই ভাইরাস কিছুই করতে পারে না। নভেল করোনার সংক্রমণ ও প্রভাব নিয়ে উহানে গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, একটা বিশেষ শ্রেণীর মানুষ এতে বেশি ধরাশায়ী হয়েছেন। ইউরোপে গিয়ে ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্যের অনেক পরিবর্তন দেখা গেছে। আফ্রিকা-দক্ষিণ এশিয়ায় এর আরও ভিন্নমাত্রার প্রভাব দেখা গেছে। অনেক দেশে তরুণ ও শিশুরাও এতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
কিছু কিছু দেশ ভিন্নভাবে করোনাকে মোকাবেলার কৌশল নিয়েছে। সুইডেন, নেদারল্যান্ড ও নরওয়ে দলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করেছে। উইটকোভস্কির চিন্তাভাবনার সাথে তাদের প্রতিরোধ কৌশল মিলে যায়। সুইডেনের মহামারী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রধান ড. এন্ডারস টেগনেল দাবি করেছেন, সেখানের সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। রাজধানী স্টকহোমের মানুষ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘দলীয় প্রতিরোধক্ষমতা’ অর্জন করতে শুরু করবে। দলীয় প্রতিরোধসক্ষমতা অর্জনকারী মডেলের প্রণেতারা মনে করছেন, স্টকহোমের মানুষদের মধ্যে অনেকে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছেন। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার গতির ওপর অচিরেই তা প্রভাব ফেলবে। দেশটিতে ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় এক হাজার ৬০০ জন। নেদারল্যান্ডে ৩৩ হাজারের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন তিন হাজার সাত শতাধিক মানুষ। নরওয়েতে আক্রান্ত হয়েছেন সাত হাজারের বেশি, মারা গেছেন ১৮০ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জনসাধারণের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তিন দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। প্রথম দফায় রেস্তোরাঁ এবং খেলার মাঠ খুলে দেয়া হবে। এই ধাপে যদি করোনা সংক্রমণের রেকর্ড বৃদ্ধি না পায় তাহলে দ্বিতীয় ধাপের বাস্তবায়ন হবে। এ ধাপে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থান অনুপাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক প্রবেশের শর্তে বারগুলো খুলে দেয়া হবে। এই ধাপেও যদি সফলতা দেখা যায় তাহলে তৃতীয় ধাপে মানুষে মানুষে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগের অনুমতি দেয়া হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সীমিত সংখ্যক কর্মী রাখার বিধিনিষেধও তুলে নেয়া হবে। এভাবে নভেল করোনাকে পরাস্ত করার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা তিনি ১৬ এপ্রিল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের কাছে পেশ করেছেন। এ বিষয়টিও এখানে উল্লেখ্য যে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জনগণকে তারা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন কি না; সেটি কে বিবেচনা করবে?
দেশটিতে এই সময় লকডাউনের বিরুদ্ধে মানুষকে বিক্ষোভ করতেও দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের মানুষ অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কায় লকডাউনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। ওই সব অঙ্গরাজ্যের জনগণকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তার চর্চা তারা করতে পারেন। ট্রাম্প তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তবে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
ট্রাম্প অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার বিপরীতে চলতে পছন্দ করেন। এমন নীতি তাকে অনেক সফলতাও এনে দিয়েছে। করোনা নিয়ে তার দুঃসাহসী নীতির বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে দেশটিতে শুরু হয়ে গেছে। ফ্লোরিডা সবার আগে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করেছে। যদিও রাজ্যটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। যখন রাজ্য সরকার বিধিনিষেধ তুলে দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছিল, তখন সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যটিতে ৭২ জন প্রাণ হারিয়েছে। এটা ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যুর দিন। সেখানে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, মারা গেছে শুক্রবার পর্যন্ত ৭৪০ জন। তারা কয়েকটি সমুদ্রসৈকত জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সৈকতে শত শত মানুষ ভিড় জমানোর ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এমন এক সময় রাজ্যটি অন্যান্য জনসমাগম ওপেন করে দেয়ার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, যখন সেখানে করোনার আক্রমণও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরো বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য তাদের বিধিনিষেধ খুলে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কতদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে নভেল করোনাকে স্তব্ধ করা যাবে, এ নিয়ে কোনো সঠিক উত্তর মিলছে না। ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ লকডাউনের মধ্যে ভাইরাসের নিয়মিত সংক্রমণ স্থির রয়েছে। এ ভাইরাসে মৃত্যুর হারও একই গতিতে এগিয়ে চলছে। এ অবস্থায় অনেকে যুক্তি দেখাচ্ছেন, এতে মৃত্যুর হার সামান্য। মৃত্যু হার নগণ্য এই অর্থে যে, আক্রান্তের একটা বড় অংশের দেহে এর আক্রমণ একেবারে সামান্য হয়। আর যাদের দেহে এটি রুগ্ণতা তৈরি করে, তাদের ৯৫ শতাংশের বেশি সাধারণভাবে সুস্থ হয়ে যায়। আক্রান্তদের মাত্র এক শতাংশের ওপর এটি ভয়াবহ ক্রিয়া করে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে এ যুক্তিও দেখাচ্ছেন। লকডাউনে অর্থনীতির চাকা বন্ধ করে মহমারী ঠেকানো যাবে না। এভাবে সব কিছু বন্ধ করে দিলে অর্থনৈতিক মহামন্দায় আরো বেশি মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। তারা বলছেন, সব কিছু খুলে দেয়া উচিত। সব কিছু খুলে দিলে মহামারীর মারাত্মক প্রভাবের খুব একটা হেরফের হবে না। বরং এর ফলে মানুষের দলগত প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। কিছু মানুষ মারা যাবে, বাকিরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষমতা অর্জন করবে। এটা আসলে বেঁচে থাকা বাকিদের জন্য ‘সুবিধা’।
আবার কেউ কেউ বলছেন, এ ধরনের দলগত সক্ষমতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সম্পর্কিত ভাবনা ভ্রান্ত। সাধারণত টিকা অবিষ্কারের পর সেটি ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে দেয়া হলে পাশাপাশি টিকা না নেয়া লোকের মধ্যেও প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। করোনার প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সেহেতু দলীয় প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির নীতি করোনার ক্ষেত্রে কার্যকর হওয়ার নয়। নরওয়ে ও কানাডার দু’জন অধ্যাপক এমন মতামত ব্যক্ত করে নিবন্ধ লিখেছেন। তারা দু’জন সব কিছু খুলে দেয়ার নীতির সমালোচনা করে বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষতির তুলনায় তারা বয়স্ক মানুষগুলোর জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করছে। তারা এর সাথে পুঁজিবাদের সম্পর্ক দেখছেন। যারা দুর্বল বয়স্ক পুঁজিবাদের ভাবনায় তারা অনুৎপাদনশীল। একসময় প্রপাগান্ডা চালানো হতো, কমিউনিস্টরা বুড়োদের সাগরে ফেলে দেয়। কারণ, তাদের কাছে কমিউনিস্টদের কোনো গুরুত্ব নেই। বাস্তবে কমিউনিস্ট দেশগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছিল অনেক বেশি মানবিক। সুইডেনের করোনা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দাবির সত্যতা কতটুকু, অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
বহু মানুষ একসাথে আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাদের মধ্যে করোনা নিয়ে ভীতি কেটে যাবে। তারা নির্দ্বিধায় আক্রান্তদের সেবা করতে পারবেন। আর এভাবে মানুষ করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে যাবে। তাদের এমন মনোভাব কতটুকু সফলতা পায় সেটি অচিরেই দেখা যাবে। প্রত্যেকটি বড় সঙ্কটের পর মানুষ আবার সহজতা পেয়ে থাকে। মানুষের ইতিহাসে এমনটাই দেখা যায়। কিন্তু এবারে সেই সহজতা কিভাবে আসে বা সেটি আসতে কত সময় লাগে তা এখনো আমরা জানি না। না আগের সেই নিয়মে কোনো পরিবর্তন এসে যায় বিশ্ববাসীর জন্য, সেটিও দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
jjshim146@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা