মুজিব মানস ও দরদি সমাজ গঠন
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০৭:০৩
শেখ হাসিনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১২ নভেম্বর। আর শেখ মুজিবের সাথে প্রথম কথা হয় ১৯৬৩ সালে, ময়মনসিংহে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের (ইপিসিএস) ট্রেনিং শেষে সেখানে আমার প্রথম পোস্টিং হয়। ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে শেখ সাহেব সিরাজগঞ্জে এসেছিলেন। তখন আমি কলেজের ছাত্র। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমাকে প্রভাবিত করে। তারও আগে ছাত্রাবস্থায় আমাকে প্রভাবিত করেছিল ভাষা আন্দোলন। অবিভক্ত ভারতে স্বাধিকার আন্দোলন ও পরে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের সমর্থক ছিল আমার পরিবার। আমার পিতা ছিলেন মুসলিম লীগের ঘোর সমর্থক। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রে আমি যখন যুক্তফ্রন্টের ভক্ত হই তখন আমার পরিবারের মধ্যেই দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এক দিকে আমার পিতা ও অন্য মুসলিম লীগ সমর্থকরা। অন্য দিকে আমি এবং আমার মা।
আমাকে সমর্থন করতেন আমার মা। আমি একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই বেড়ে উঠেছিলাম। আমার খালাতো ভাই ছিলেন আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ। আমার নানা সৈয়দ কফিল উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন শাহজাদপুরের নন্দলাল ইউনিয়ন বোর্ডের ৩২ বছরের প্রেসিডেন্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের ঠাকুর স্টেট ও আরেকটি ভাদুরি স্টেট অংশত এই বোর্ডেই অবস্থিত ছিল। গ্রামের নামও ছিল নন্দলাল। আমার নানা ১৯৫১ সালে মারা যান। তিনিও মুসলিম লীগের ঘোর সমর্থক ছিলেন। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। তবে নাতি হিসেবে নানার সাথে আমার কথা হতো।
তখন পাবনা একটি জেলা ছিল। আর সিরাজগঞ্জ ছিলো মহকুমা। আমাদের পরিবার আসলে পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জে এসে বসতি স্থাপন করে। তারও একটি ইতিহাস আছে। আমার দাদা ছিলেন মিয়া পরিবারের ছেলে। তিনি পাঠান পরিবারের মেয়ে বিয়ে করার জন্য পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জে চলে আসেন। এ কথা আব্বার কাছ থেকে আমি শুনেছি। আবার বাবা দেখতে দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন ছিলেন। আমাদের পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি মুঘলরা এই পরিবারের আদিপুরুষ। ইতিহাস বলে, পাবনার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চাটমোহর একদা মোগল-পাঠানদের অবাধ বিচরণ ভূমি ছিল।
১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মাসুম খাঁ কাবলি নামে সম্রাট আকবরের পাঁচহাজারী এক সেনাপতি সেখানে একটি মসজিদও নির্মাণ করেন, যা আজকের চাটমোহর শাহী মসজিদ। বইপত্রে এর নাম মাসুম খাঁ কাবলির মসজিদ বলে উল্লেখ রয়েছে। মসজিদটিতে তুঘরা লিপিতে উৎকীর্ণ একটি ফারসি শিলালিপি ছিল। বর্তমানে শিলালিপিটি রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ফলকে খোদাইকৃত পার্সি অক্ষরে মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় বাংলা অঞ্চলে যেসব পাঠান ও মোগল লোকজন এসেছিলেন তাদের সবাই ফিরে যাননি। ফলে পাবনা অঞ্চলেও পাঠান ও মোগলদের কেউ কেউ বসতি স্থাপন করে থেকে যান। তাদের মধ্যে একসময় বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাঠানরা খাঁ নামে এলাকায় পরিচিত ছিল। মোগলরা ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। ছোটবেলায় আমার কৌতুহল জাগতো আমার দাদা-নানারা কোথা থেকে এসেছেন। এভাবে তাদের শেকড়ের সন্ধান পাই।
আমার দাদাও ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক। আমি দাদাকে দেখিনি। তবে আম্মার মুখে শুনেছি যে আমার আব্বা পুলিশ বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু দাদা তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। দাদা বলতেন তুই পুলিশ হয়ে কি নিজের দেশের মানুষকে মারবি? ১৯২০ সালে আব্বা পুলিশ সার্ভিস থেকে এসে এলাকায় চিকিৎসা প্র্যাকটিস শুরু করেন। আমি তাকে পুলিশের চাকরি ছাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তখন আমাদের এখানে স্বদেশী আন্দোলন হচ্ছিল। বাংলায় মুসলমানদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিরোধিতা করেছিলেন। এ কথা শুনে ছেলেবেলায় আমিও অবাক হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে ইতিহাস এর সাক্ষ্য দিয়েছে।
আব্বা বলতেন, তোরা তো জানিস না আমরা কেন মুসলিম লীগ সমর্থন করি। মুসলিম লীগ না হলে এই দেশটিই হতো না। আমার আব্বার কাছে শুনেছি কিভাবে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে স্থান দিতে চাননি। ভারতীয় কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন : ভারত স্বরাজ লাভ করলে তার সাধারণ ভাষা কী হবে? রবীন্দ্রনাথ জবাবে বলেন : হিন্দী। অন্য দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য ছিল, বাংলা, উর্দু ও হিন্দী এই তিনটি ভাষারই যোগ্যতা রয়েছে রাষ্ট্রভাষা হবার।
এমন পরিবেশে থাকার পরও শেখ মুজিবের বক্তৃতা আমাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করে। ফলে আমি তমদ্দুন মজলিস, ভাষা আন্দোলনসহ সব ধরনের স্বাধিকার আন্দোলনের সমর্থকে পরিণত হই। আমার ফুফাতো ভাই মীর শামছুল হুদা তমদ্দুন মজলিস করতেন। ভাষা আন্দোলনকারীদের নানাভাবে দমনের চেষ্টা করে পুলিশ। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগে-পরের সময়টিতে জেলে কাটাতে হয় শেখ মুজিবকে। তবে সারা দেশে পুলিশের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে তিনি জেলে থেকেই আমরণ অনশন শুরু করে দেন। ফলে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনের সময়টিতে আমি স্কুলের ছাত্র হলেও বেশ সচেতন ছিলাম। আমার এই আন্দোলনকে সমর্থন করার কারণ ছিল। আমি বুঝেছিলাম যে, বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে আমরা মূর্খ হয়ে যাবো। আমরা সরকারি চাকরি-বাকরি পাবো না। ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিখব না বলে আমরা মুসলমানরা যে ভুল করেছি সেটি আমার মাথায় ছিল। এখন বাংলার বদলে উর্দু শিখে আবার সেই ভুল করতে চাই না।
এরই জের ধরে আমি সিরাজগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি হই। যদিও আজকের ছাত্রলীগ ও সে দিনের ছাত্রলীগের মধ্যে পার্থক্য দুস্তর। ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিবের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের দিনটিতে তিনি আমাকে অভিভাবকসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন: ‘তোমাদের ভিশন তোমরাই ঠিক করবা।’ তার সেই কণ্ঠ এখনো আমার কানে বাজে। তার সাথে আর কখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার। কারণ এরপর আমি কর্মোপলক্ষে দেশের বাইরে চলে যাই। প্রায় ৩৩ বছর বিদেশে কর্মজীবন কাটিয়ে যখন দেশে ফিরে আসি তখন এখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
শেখ মুজিবকে আমি পেয়েছিলাম একজন ক্যারিশম্যাটিক লিডার হিসেবে, দুর্দান্ত সংগঠক হিসেবে। তার একটি দরদি মন ছিল। যেটা আমি কাছ থেকে দেখেছি এবং এই কলামেই সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি। তিনি একটি সোনার বাংলা চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজটি আসলেই কঠিন ছিল। কারণ আমরা সোনার মানুষ ছিলাম না। যে কারণে ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলি আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর রাষ্ট্র ও সমাজযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটি অস্থির সময় তৈরি হয়। এই অস্থির সময়েই তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল করেন। তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। তবে এই পরিণত বয়সে এসে আমার মনে হয় তখনকার পরিস্থিতিতে এই রাষ্ট্রকে মেরামত করার জন্য একজন ‘বেনিভোলেন্ট ডিক্টেটর’ বা ‘জনদরদি স্বৈরশাসক’ দরকার ছিল।
মুজিব স্বাধীনতার জন্য জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নতুন একটি দেশের জন্ম দিয়েছে। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ওলট-পালট হয়ে গেছে। লাইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে। জনগণ তখন বিশৃঙ্খল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। তখনকার প্রেক্ষাপটে সেটি দরকার ছিল। কিন্তু সেটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সময় পাননি মুজিব। আজকে আমরা সমাজে যে সন্ত্রাস ও অস্ত্রবাজী দেখি তার শেকড় ওই সময়টাতেই রোপিত হয়েছিল। তখন সমাজকে শান্ত ও সুশৃঙ্খল করতে আমাদের একজন ‘হিতৈষী স্বৈরশাসক’ দরকার ছিল। ঘর ভেঙে যাওয়ার পর তা মেরামতের জন্য কারিগরি দক্ষতা লাগে। তেমনি রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার পর এর মেরামতের জন্যও ভিশন ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। রাতারাতি এটা হয় না, সময়ের প্রয়োজন হয়। সেই সময় মুজিব পাননি। বাকশাল করে তিনি প্রচলিত সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে হয়তো নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘চেইন অব কামান্ড’ প্রতিষ্ঠার আগেই তাকে জীবন দিতে হলো।
যে সমাজে ‘চেইন অব কামান্ড’ নেই সেটি হয় উশৃঙ্খল সমাজ। আমরা এখনো একই সমস্যায় ভুগছি। তাই প্রতিদিন সন্ত্রাসের কথা শুনি। সন্ত্রাসের অনেক কারণ ও ধরন আছে। আমাদের দেশে সন্ত্রাসের কারণ ‘চেইন অব কমান্ডে’র অভাব। প্রতিষ্ঠান মেরামত করা কত কঠিন সেটি আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি সামান্য একটি ব্যাংক করতে গিয়ে। এই ব্যাংকের ধারণা নিয়ে আমি প্রায় দুই যুগ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। আজো আমি ‘ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকে’র ধারণা নিয়ে ঘুরছি। আজ যখন দেশ বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে, অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম, বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে বলে বিশ্বসংস্থাগুলো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে তখন আমি এ ধরনের ‘ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকে’র গুরুত্ব অন্তর দিয়ে অনুভব করি। তবে ধারণা থাকলেই হয় না, একে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের প্রয়োজন হয়। তা না হলে ধারণার মৃত্যু ঘটতে পারে।
তাই আমি বলব, শেখ মুজিব তার ‘ভিশন’ বাস্তবে রূপ দেয়ার সময় একদমই পাননি। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি হয়তো এই ভাঙা সমাজটিকে মেরামত করতে পারতেন। তার মতো জনগণকে অনুপ্রাণিত করার দক্ষতা ইতিহাসে বিরল। ‘চেইন অব কমান্ড’ যে ভেঙে গেছে সেটি জীবদ্দশাতেই তিনি দেখেছেন। অনেক অনিয়মের কথা তার কানে আসতো। তাই হয়তো নিজের কম্বলটি কোথায় সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।
গত ১৭ মার্চ ছিল শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী। আমি অসুস্থ মানুষ। সে দিন রাত ১২টায় চার দিকে আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আক্ষরিক অর্থে আমি ভেবেছিলাম বুঝি কোথাও সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২টা ৩ মিনিট। কিছুটা ভয় পেলাম। আমার নার্সকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল বাজি ফুটানো হচ্ছে। তখন আমি টিভি খুলে দেখি শেখ মুজিবের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হচ্ছে। ফুল দিয়ে গোটা চত্বর ঢেকে ফেলা হয়েছে। এটা দেখে আমি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। কারণ, ১৯৭২-৭৫ সালেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু এমন ফুল বিছিয়ে দেয়া লোকজনের কাউকে ১৫ আগস্ট পাওয়া যায়নি। সমাধিতে ফুল দেয়া পশ্চিমা সংস্কৃতি। মুসলিম সংস্কৃতি হলো মৃতের জন্য দোয়া করা, তার রূহের মাগফিরাত কামনা করা।হ
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা