১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ মাঘ ১৪৩১, ১৬ রজব ১৪৪৬
`

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সংশোধন

-

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসংক্রান্ত। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধান প্রণয়নকালে এ ভাগে অনুচ্ছেদ নং ৮ থেকে ২৫ পর্যন্ত ১৮টি অনুচ্ছেদ ছিল। এ ভাগটি সংবিধান (চতুর্থ সংশোধন) আইন, ১৯৭৫, দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮, সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ ও সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২Ñ এ চারটি দ্বারা চারবার সংশোধিত হয়। বর্তমানে এ ভাগটিতে অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৯। উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সংস্কৃতি বিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ২৩ক সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ এর মাধ্যমে সংযোজিত হয়েছে। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ১২ যা দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা অবলুপ্ত হয়েছিল, সে অবলুপ্ত অনুচ্ছেদটিও সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ মাধ্যমে পুনঃস্থাপিত হয়।

যেকোনো নীতি যখন ‘মূলনীতি’ হিসেবে পরিগণিত হয় তখন ধরে নিতে হয় যে, এ নীতিটি আদি বা আসল বা আবশ্যক নীতি। নীতি শব্দটির বহু অর্থ থাকলেও এবং আমাদের সংবিধানে নীতি বলতে বিধান বা বিধানাবলির প্রতি আলোকপাত করা হলেও বস্তুত মূলনীতি বা নীতি বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা ৮ নং অনুচ্ছেদের অধ্যয়ন হতে স্বব্যক্ত।
নীতি আইন বা অধিকারের সমার্থক নয়। আইন বা অধিকারের লঙ্ঘন হলে তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য; কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে সে সুযোগ অনুপস্থিত।

৭২’র সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ থাকলেও এ চারটি মূলনীতি হতে উদ্ভূত দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত অন্য সব নীতি মূলনীতি হিসেবে পরিগণিত হবে মর্মে বলা ছিল।

সংবিধান প্রণয়ন কালে ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে দু’টি দফা ছিল। দফা নং (১) এ বলা হয়েছিল- জাতীয়তবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- এ নীতিসমূহ এবং তদ্সহ এ নীতিগুলো থেকে উদ্ভূত এ ভাগে বর্ণিত অন্য সব নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলে পরিগণিত হবে। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা দফা নং (১) প্রতিস্থাপন পূর্বক উক্ত দফায় ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে মূলনীতি হিসেবে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল। তা ছাড়া ওই আদেশে সমাজতন্ত্র বিষয়ে বলা হয়, সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।

একই আদেশবলে দফা নং (১) এর পর (১ক) দফা সন্নিবেশনপূর্বক বলা হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি। অনুচ্ছেদ নং ৮ এর (২) এ মূলনীতির অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। এ দফাটিতে বলা হয়েছে, এ ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্র হবে, আইন প্রণয়ন কালে রাষ্ট্র তা প্রয়োগ করবে, এ সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তা নির্দেশক হবে এবং তা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হবে, তবে এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হবে না। (২) নং দফাটি কখনো কোনো ধরনের সংশোধনীর আওতায় না আসায় এর বিষয়বস্তু সংবিধান প্রণয়ন হতে অদ্যাবধি অক্ষত রয়েছে। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশবলে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ৯ এবং সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি বিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ১০ অবলুপ্ত করে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নবিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ৯ এবং জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণ বিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ১০ স্থলাভিষিক্ত করা হয়। দ্বিতীয় ভাগের ১১নং অনুচ্ছেদটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক। এ অনুচ্ছেদ হতে সংবিধান (চতুর্থ সংশোধন) আইন, ১৯৭৫ এর মাধ্যমে “এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে” এ বাক্যটি অবলুপ্ত করা হয় যা পরে সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ এর দ্বারা পুনঃস্থাপিত হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগের সর্বশেষ অনুচ্ছেদ অনুচ্ছেদ নং ২৫ আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত। সংবিধান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশবলে ২৫ নং অনুচ্ছেদকে উক্ত অনুচ্ছেদের (১) দফারূপে পুনঃসংখ্যায়িত করা হয় এবং পুনঃসংখ্যায়িত (১) দফার পর নতুন (২) দফা সংযোজন করে বলা হয়, রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করতে সচেষ্ট হবেন। অতঃপর সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ এর মাধ্যমে ২৫ নং অনুচ্ছেদ হতে (১) সংখাটি বন্ধনীসহ এবং দফা (২) অবলুপ্ত করে ৭২’র সংবিধানের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।

দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা ৬ নং অনুচ্ছেদে বিবৃত বাঙ্গালি জাতীয়তার ক্ষেত্রে এ দেশের নাগরিকদের পরিচিতি বাঙ্গালি হতে বাংলাদেশীতে পরিবর্তন করায় মূলনীতি হতে জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ নং ৯ এর অবলুপ্তি অত্যাবশ্যক ছিল। পরবর্তীতে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ এর মাধ্যমে জাতীয়তা বিষয়ে বাংলাদেশীর পরিবর্তে পুনঃবাঙ্গালি স্থলাভিষিক্ত হলে একই সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশবলে পূর্বের অবলুপ্ত জাতীয়তাবাদ বিষয়ক অনুচ্ছেদটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপনের পর এ অনুচ্ছেদটি ৭২’র সংবিধানে যেভাবে বিবৃত ছিল হুবহু সেভাবে বিবৃত হয়। এ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট যে বাঙ্গালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মু্িক্তযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছেন, সে বাঙ্গালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।

জাতীয়তা দেশভিত্তিক না হয়ে জাতিভিত্তিক হলে তা একটি দেশে বসবাসরত অন্য যেকোনো জাতি বা উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃ-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, এগুলোকে একযোগে বহির্ভুক্ত করে। এ ধরনের বহির্ভুক্তি উপরি উক্ত যেকোনো শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিতে পারে যা কোনো দেশের শান্তি, অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক নয়।
দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা মূলনীতি হিসেবে বিবৃত সমাজতন্ত্র এর অর্থকরণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার সংযুক্ত করায় সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ নং ১০ এর কার্যকারিতা অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। সে নিরিখে তা অবলুপ্ত করা হয়। অতঃপর সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ এর মাধ্যমে ৮ নং অনুচ্ছেদে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র কোনোরূপ অর্থকরণ ব্যতিরেকে বিবৃত হলে একই সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা পূর্বের অবলুপ্ত ১০ নং অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করা হয়। সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি বিষয়ক ১০ নং অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে- মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে।

দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশবলে মূলনীতি হিসেবে ৮নং অনুচ্ছেদের (১) দফায় ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত এবং সংযোজিত (১ক) দফায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি বাক্যটি সন্নিবেশিত হওয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক ১২ নং অনুচ্ছেদটি অবলুপ্ত হয়। অতঃপর সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১২ এর দ্বারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিস্থাপিত হলে এবং ৮ নং অনুচ্ছেদ হতে (১ক) দফা অবলুপ্ত করা হলে একই সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্বের অবলুপ্ত অনুচ্ছেদ নং ১২ প্রতিস্থাপন করা হয়। অনুচ্ছেদ নং ১২ এর ধর্মনিরপেক্ষতাকে কার্যকরণে গৃহীত ব্যবস্থাদির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছেÑ ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্যÑ (ক) সর্ব প্রকার সম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন- বিলোপ করা হবে।

গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্্র পরিচালনার মূলনীতি হলেও স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও দুঃখজনকভাবে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমাদের বড় তিনটি দল বলতে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টিÑ এ তিনটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে যে, নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় না সে বিষয়ে দল ও দল বহির্ভূত সবাই সম্যক অবহিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা গণতন্ত্রের মূলশক্তি। কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছে এ কথাটি দাবি করার কোনো অবকাশ আছে কি? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার কারণেই ব্যাপক জনমতের প্রতিফলনে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন। ব্যবস্থাটির প্রতি এখনো দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সমর্থন থাকলেও কোনো ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ব্যতিরেকেই দলীয় স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থাটির বিলোপসাধন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থাটির বিলোপে এক ব্যক্তির আকাক্সক্ষাই যে মুখ্য ছিল, তা আজ আর কারো অজানা নয়। এ ধরনের একতরফা মনোবৃত্তি কখনো বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এভাবে গণতন্ত্র অবমূল্যায়িত হলে কি করে বলা যায়, গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি?

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর পর সংবিধানে ফিরে আসলেও তা কি বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীবহির্ভূত অন্যদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? সে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায় একটি বিশেষ দল ক্ষমতাসীন থাকলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের চেয়ে অধিক হারে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কী কারণে এবং কোন রাষ্ট্রের ভয়ে এ বৈষম্য তা জানার অধিকার কি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেই? আমাদের পাশের রাষ্ট্রটির রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও সে দেশের সংখ্যালঘু বৃহৎ সম্প্রদায় তাদের জনসংখ্যার সংখ্যানুপাতে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কি প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছে? সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব যে অনেক নিম্নে, এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলে ধর্মনিরপেক্ষতা কিভাবে গণতন্ত্রের আবরণে একটি সম্প্রদায়কে অবদমিত করে রাখছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া রাষ্ট্রটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতি বছর বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সে দিক থেকে আমাদের এখানে কি হতাহতের ঘটনা ঘটছে? আমাদের এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নিপীড়ন তার মূল খুঁজতে গেলে দেখা যায়, একটি বিশেষ দল ক্ষমতাসীন থাকাকালে পাশের রাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের জন্য এবং তাদের ক্ষমতায় রাখা ব্যতিরেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে এমন ধারণা সৃষ্টি করে নিজেরাই কথিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভব ঘটায়।

সংবিধানের ৮ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি বর্ণিত রয়েছে। ৮ নং অনুচ্ছেদটি ৭২’র সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, সংবিধানের অন্য যে কোনো অনুচ্ছেদের মতো সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সমর্থনে সংশোধনযোগ্য ছিল। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা ৮ নং অনুচ্ছেদসহ কিছু অনুচ্ছেদের সংশোধনের বিষয়ে সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সমর্থনের অতিরিক্ত গণভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনের বিধান করা হয়। সর্বশেষ, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইনের মাধ্যমে ৮ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতিসহ দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার সব মূলনীতিকে সংশোধন অযোগ্য করা হয়।

যেকোনো দেশে সমাজের গতিশীলতার সাথে আইনের সংশোধন সময় ও যুগের চাহিদানুযায়ী চলমান প্রক্রিয়া হওয়ায় সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সংশোধনপদ্ধতি সাধারণ আইনের সংশোধন পদ্ধতির চেয়ে কিছুটা জটিল করা হয়ে থাকে। কিন্তু সংশোধন একেবারে বারিত করা শুধু আমাদের দেশ নয়, যেকোনো দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতার নিরিখে সুদূর পরাহত। সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন এর মাধ্যমে ৮ নং অনুচ্ছেদের সংশোধন-অযোগ্যতা সংবিধানের মৌলিক বিষয় বলে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসেবে করা হয়েছে এ কথাটি বলার সুযোগ আছে কি? আর সুযোগ না থাকলে বলতেই হয়, একেবারে সংশোধন অযোগ্যতার চেয়ে সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের পর গণভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনে সংশোধন জন-আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ নয় কি?
যেকোনো দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিগণিত হওয়া আবশ্যক। এর অন্যথা হলে মূলনীতিকে তার নিজ অবস্থানে অনড় রাখা যাবে না। আর অনড় রাখা যাবে না বলেই আমরা ইতোমধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে চারবার সংশোধনীর সম্মুখীন হয়েছি। সর্বশেষ সংশোধনী মূলনীতি বিতর্কের অবসান, নাকি পুনঃসূত্রপাত ঘটিয়েছে তা আগামী দিনের ঘটনাপ্রবাহ বলে দেবে। 
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
জাবিতে জুলাই হামলার ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল নারী অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাল শুরু যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করল ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা জামায়াত দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছে : বুলবুল শনিবারে লালমনিরহাটে ড. আজহারীর মাহফিল, একদিন আগেই মাঠ পরিপূর্ণ ইলন মাস্কের ইউরোপীয় ফার-রাইটদের প্রতি সমর্থন ‘গণতন্ত্রের জন্য হুমকি’ : শোলৎজ কাল সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিএনপি ভবিষ্যতে যারা আসবেন, অতীত থেকে শিক্ষা নেবেন : উপদেষ্টা সাখাওয়াত ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন চীনের প্রেসিডেন্ট, পাননি মোদি ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ৫ অধিদফতরের স্বতন্ত্র অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ স্থাপন

সকল