২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমানত সুরক্ষা আইন কড়চা

-

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আমানত সুরক্ষা আইন’ সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখা কেউ নিরাপদ মনে করছেন না। প্রস্তাবিত আইনে গ্রাহকদের যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা শুভঙ্করের ফাঁকি বলেই মনে হচ্ছে। যদিও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বিষয়টিকে নিছক গুজব বলেই প্রচার করছে। নতুন আইন প্রস্তাবনায় ‘তহবিলের দায়’ বিষয়ক ধারা-৭(১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের আদেশ হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সংশ্লিষ্ট অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীকে তার বীমাকৃত আমানতের সমপরিমাণ (সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা) তহবিল হতে প্রদান করবে। কিন্তু এমন প্রস্তাবনাকে কেউই যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়ানুগ মনে করছেন না। কারণ প্রস্তাবিত আইনে ‘ক্ষতিপূরণ’ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, তা আমানতকারীদের জন্য রীতিমতো ‘অর্ধচন্দ্র’ই বলা যায়।

প্রস্তাবিত ‘আমানত সুরক্ষা আইন’কে প্রায় সব মহলেই তুলোধুনো করা হচ্ছে। সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নতুন আইনে আমানতকারীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। ব্যাংক বন্ধ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্কিম করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করবে। সে হিসাবে ব্যাংকটির সম্পদ, বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত টাকা, জমা আমানত ও আদায় হওয়া টাকা থেকে আনুপাতিক হারে গ্রাহকদের দায় শোধ হবে। ব্যাংক বন্ধ হলে শুধু বীমার এক লাখ টাকা নয়, আইন অনুযায়ী, ব্যাংকের জমা ও সম্পদ বিক্রির অর্থ থেকে আগে টাকা ফেরত দেয়া হবে। এ ছাড়া বীমার আওতায় সব আমানতকারী এক লাখ টাকা করে পাবেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের এসব কথা ছেলে ভোলানো বলেই মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি সব টাকা ফেরতই দেয়া হয় তা হলে নতুন করে ‘আমানত সুরক্ষা আইন’ বা ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ আসছে কেন?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য হলো, বিদ্যমান আইনে কোনো ব্যাংক অবসায়িত হলে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে আমানতকারীদের প্রাপ্য টাকা আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল থেকে পরিশোধ করা হবে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক অবসায়িত হলে ওই ব্যাংকের সম্পদ থেকে সব আমানতকারীর পাওনা পরিশোধের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। তাই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জনগণকে বিভ্রান্ত বা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কারণ ইতোমধ্যেই শেয়ার মার্কেটের লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা কারো অজানা নয়। বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কথা এখনো কেউ ভুলে যায়নি। আর আইনের প্রস্তাবনা যেভাবে করা হয়েছে, তাতে তা আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা হবে না; বরং প্রস্তাবিত আইনে ব্যাংক মালিকদের সুরক্ষা দেয়া হবে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি আগেই দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ হবে কিভাবে? সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টর রীতিমতো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের কারণে অর্থনৈতিক সেক্টরে সীমাহীন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে দুর্নীতির বরপুত্রদের লুটপাট তো রয়েছেই। আর ব্যাংকের টাকা লোপাট করে একশ্রেণীর ধুরন্ধর লোক যেভাবে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভব সৃষ্টি করছে, তাতে সাধারণ মানুষ এখন তাদের আমানত নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আর এসব ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততা মানুষকে আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে!

আমানতকারীদের ফেরত দেয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট রেখে ব্যাংক মালিকরা কোনো ব্যাংক অবসায়িত করে দেবে না বলেই সাধারণ মানুষের ধারণা। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি এত বেশি যে, তাদের আসলে মূলধন বলতে বাস্তবে কিছুর অস্তিত্ব নেই। কয়েকটি তো বিধিবদ্ধ সঞ্চিতিও রাখতে পারছে না। তাই প্রস্তাবিত নতুন আইনের ব্যাখ্যায় সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাচ্ছে না। ফলে আমানতকারীদের উদ্বেগও কাটছে না।

প্রস্তাবিত নতুন আইন নিয়ে নানাবিধ প্রশ্নের অবতারণাও হচ্ছে। আর প্রায় ক্ষেত্রেই এসব প্রশ্নের যৌক্তিকতার বিষয়টিও অস্বীকার করার যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ব্যাংকের সম্পদের চেয়ে যদি আমানতকারীর বেশি পাওনা হয় তাহলে কী হবে, এই টাকা কে দেবে ? তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নতুন আইনে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর বিষয়টি নিয়ে ধূম্রজালও সৃষ্টি হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে চরম অচলাবস্থা ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামক দু’টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে বিদেশে পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গতকারণেই আমাদের ব্যাংকসহ আর্থিক খাত সুরক্ষিত নয়, জনমনে এমন ধারণা প্রায় স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। তাই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না আমানতকারীরা। এ অবস্থায় নতুন আইনকে তারা রীতিমতো সন্দেহের চোখে দেখছেন এবং পরিকল্পিতভাবেই কিছু ব্যাংক অবসায়িত করা হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

‘আমানত সুরক্ষা আইন ২০২০’-এর যে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে, তা আদৌ গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষা দেবে কি না- এ প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খসড়া আমানত সুরক্ষা আইনটি মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে পারবে না। এর ফলে শুধু যে আমানতকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। আর ক্ষতিপূরণের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় গ্রাহকরা ধীরে ধীরে আমানত তুলে নেবেন। এতে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবাহ কমবে। আর আমানত কমলে ঋণ দেয়ার ক্ষমতাও হারাবে ব্যাংক। আর ঋণ দিতে না পারলে বিনিয়োগ হবে না। যা জাতীয় অর্থনীতির চাকা স্থবির করে তুলবে।

শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নয়, বহু সাধারণ মানুষেরই এখন এক লাখ টাকার উপরে এফডিআর রয়েছে। তাদের আমানতের সুরক্ষা দেয়ার বিষয়টিও উপেক্ষা করার মতো নয়।

দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানতকারীরা তাদের অর্থ তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষা যেখানে আরো বেশি জরুরি, সেখানে ক্ষতিপূরণের নামে উল্টো ‘ক্ষতির’ বিধানসংবলিত আইন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষার দিক বিবেচনা করে আইনটি শুধু নামে নয়, সত্যিকার অর্থেই যুগোপযোগী করা দরকার বলে বিভিন্ন মহল থেকেই পরামর্শ আসছে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এক ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক থেকে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক থেকে ইচ্ছামতো অর্থ লুটপাট করছেন। সরকারের ছত্রছায়ায় ও একশ্রেণীর অর্থলোভী ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক বিপর্যয়, চরম দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়ার অভিযোগ তো অতি পুরনো। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এমতাবস্থায় আমানত সুরক্ষা আইনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রস্তাবনা দিয়েছে, তাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আমানতকারীদের আস্থা প্রায় শূন্যের কোটায়।

তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করে আমানতকারীরা যাতে ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখতে পারে এবং আমানত ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা পায়, প্রস্তাবিত আইনকে সেভাবেই ঢেলে সাজাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমানতকারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যেসব নেতিবাচক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, সেসবের অপনোদন করার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। প্রস্তাবিত ‘আমানত সুরক্ষা আইন’-এর অন্তরালে বা নেপথ্যে নেতিবাচক কোনো অনুষঙ্গ কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। দেশের মানুষ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে : শাহজাহান কপ-২৯ : ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ২০০ মিলিয়ন বরাদ্দ দিতে ইইউ’র সমর্থন চাইল বাংলাদেশ আইসিসির পরোয়ানা : গ্রেফতার হবেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী? ছাত্র জমিয়তের ময়মনসিংহ জেলা কমিটি গঠন সবার আগে নির্বাচনী সংস্কার দরকার : এ্যানি হাসিনার নেয়া প্রতিটি রক্তের ফোটার বিচার হবে : ইসহাক খন্দকার ডেঙ্গুতে আরো ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪৫৮ রেলওয়ে কারখানাকে আধুনিকায়ন করে জনবল নিয়োগ দেয়া হবে : রেল উপদেষ্টা বর্ণিল আয়োজনে বশেমুরকৃবির ২৭তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় : গোলাম পরোয়ার বাংলাদেশ এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে : শামা ওবায়েদ

সকল