২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বড় হওয়ার গুণ শিখেছি গুলের কাছ থেকে

তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সাথে লেখক - ছবি : লেখক

সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, কর্মজীবনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ পাপুয়া নিউগিনি পর্যন্ত পৃথিবীর বহু দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। পাঁচটি দেশে আটটি চাকরি করেছি আক্ষরিক অর্থে। ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করার সুবাদে বহু দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়কে খুব কাছ থেকে দেখার ও বোঝার সুযোগ হয়েছে। আমার আরেকটি সৌভাগ্য ছিল যে, আমাকে বিদেশের চাকরিগুলো কখনো দরখাস্ত করে নিতে হয়নি। হয়তো কোনো সেমিনারে বা কনফারেন্সে গেছি। সেখানেই এমন কারো সাথে দেখা হয় যিনি আমার মতো কাউকে খুঁজছেন। আমাকে প্রস্তাব দিলেন। আমিও হয়তো বললাম ভেবে দেখি। আইডিবিতে আমার চাকরিও এভাবে হয়েছিল। সেটি খুব সম্ভবত ১৯৭৪ সালের দিকে। আইডিবি (১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। লন্ডনে এক মিটিংয়ে আইডিবির প্রেসিডেন্ট আহমেদ মোহাম্মেদ আলী আল-মাদানির সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি সেই ষাটের দশকে লেখা আমার ‘ইসলামিক ইকোনমিকস : থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ বইয়ে ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম ব্যাংক’-এর কথা বলেছিলাম। আরো বলেছিলাম, এই ব্যাংকের সদর দফতর সৌদি আরবে হওয়া উচিত। বইটি ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপরই আমি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করার জন্য চলে যাই। বইটির সুবাদে যারা ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে পড়ালেখা করতেন, তাদের কাছে আমি পরিচিত ছিলাম। যদিও বিষয়টি তখনো আমার ততটা জানা ছিল না। তখন আমি পাপুয়া নিউগিনিতে অধ্যাপনা করছিলাম।

১৯৭৬ সালের দিকে আইডিবি থেকে আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হলো ৯টি দেশের অর্থমন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত ভাইভা বোর্ডের সামনে হাজির হই। বোর্ডের প্রধান ছিলেন মিসরের সাবেক ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার। ৪০ হাজার দরখাস্ত বাছাই করে মাত্র ৩২ জনকে ডাকা হয়। তাদের মধ্যে শুধু আমিই দরখাস্ত করিনি। আর সেটি হয়েছিল আমার ওই বইটির জন্য। ইন্টারভিউ বোর্ডে আলোচনাকালে আমাকে বলা হলো, তারা আমাকে ব্যাংকের অপারেশন বিভাগে নিয়োগ দিতে চান। আমি বললাম, আমাকে ‘রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে’ দিলে ভালো হয়। আইডিবির প্রেসিডেন্ট বললেন, ব্যাংকের রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট এখনো হয়নি। হলে সেখানে আমাকে দেয়া হবে। দরখাস্ত বাছাই কমিটিতে ছিলেন বিশ্বের প্রথম ইসলামিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মিসরের আহমেদ আল নাজ্জার ও তুরস্কের প্রফেসর সাবাহতিন জাইম। তাদের সাথে সেখানেই প্রথম দেখা। তারা ভেবেছিলেন আমি প্রবীণ কোনো ব্যক্তি। আমাকে দেখে তারা কিছুটা অবাকই হলেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সী, ‘ক্লিন শেভড’ একজন লোক।
তাদের কাছে আমি প্রথম জানতে পারি যে, আমার বইটি আরবি ও তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে তুরস্ক ও আরব বিশ্বে আমি যে পরিচিত হয়ে গেছি, সেটি আমার জানা ছিল না। তখন নাজ্জার ও জাইম আমাকে বললেন, তুমি এখানে কেন, তোমার তো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার কথা। আমি বললাম, আমি তো দরখাস্ত করিনি। আপনারাই তো ডেকে এনেছেন। এরপর তারা দু’জন আমাকে কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে গেলেন। এ দিকে আইডিবি প্রেসিডেন্ট আমাকে বললেন, তুমি পাপুয়া নিউগিনি থেকে লিভ নিয়ে ব্যাংকে জয়েন করো। তিন বছর কাজ করলে বেতনসহ এক বছর ছুটি পাবে। ওই সময় চাইলে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে। এরপর আমি পাপুয়া নিউগিনি ফিরে যাই এবং কিছু দিনের মধ্যেই আইডিবি ও কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাই। তখন অনেক ভেবেচিন্তে ব্যাংকের স্থায়ী চাকরি ও বিপুল সুযোগ-সুবিধা বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুটা অনিশ্চিত চাকরিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই। আমার বই আরবি ভাষায় অনুবাদ হওয়ার কারণে আমার খুবই ইচ্ছা হয়েছিল আরবি ভাষা শিখব। কুরআন ও হাদিস নিয়ে গবেষণা করব। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর আমি আমার বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে ড. জুবেরিকে পাই। তখন আবদুুল্লাহ ওমর নাসিফ ছিলেন ইউনিভার্সিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট ছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার। আমার সময়ে সেখানে এক হাজার ৬০০ পিএইচডিধারী শিক্ষক ছিলেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর একদিন আইডিবির প্রেসিডেন্ট ড. আহম্মেদ মোহাম্মদ আলী, তিনি তখন সৌদি আরবের ডেপুটি এডুকেশন মিনিস্টার, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আইডিবিতে কনসালট্যান্সি করতে পারব কি না। আমি বললাম, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দিলে পারব। ড. আলী ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তার অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্টারে পারমিট না করার পরও আমাকে আইডিবিতে কনসালট্যান্সি করার অনুমতি দেয়া হলো। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বলা হলো, তোমার ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। তুমি বরং ইউনিভার্সিটির রিসার্চ সেন্টার ডেভেলপ করো। এভাবে ছয় বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ছিলাম। তত দিনে আইডিবির রিসার্চ সেন্টারও হয়ে গেছে। কনসালট্যান্সির সুবাদে আইডিবির প্রেসিডেন্টের সাথে আমার যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। ফলে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পুরোপুরি আইডিবিতে চলে আসি।

আইডিবির রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইসলামিক রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট- আইআরটিআই) হওয়ার পর সেখানে ডিরেক্টর হয়ে আসেন তুরস্কের কুরকুত ওজাল। তিনি ছিলেন তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট তুরগুত ওজালের ভাই। কুরকুত ওজাল তুরস্কের কৃষিমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি সাথে করে একঝাঁক তরুণ তুর্কি স্কলার নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ গুলও ছিলেন। একেবারে তরুণ। সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন। সেখানেই আমাদের পরিচয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইডিবিতে তার সিনিয়র কলিগ হিসেবে জয়েন করেছি। পাশাপাশি রুমে আমরা বসতাম। গুল খুবই বিনয়ী, মৃদুভাষী। তার মুখ দিয়ে যেন কথা বেরই হতো না। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। আবদুল্লাহ গুল মধ্য তুরস্কের একটি বিশেষ সম্প্রদায় থেকে এসেছেন। গুল পরিবার সেখানে খুবই জনপ্রিয়। তার বাবা ছিলেন এয়ারফোর্সের ইঞ্জিনিয়ার। গুল ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে পড়ালেখা করেন এবং পিএইচডি অর্জন করেন। একবার আইডিবিতে প্রাইস প্রিপারেটরি কমিটি গঠন করা হলে আমি ছিলাম তার চেয়ারম্যান। সেখানে মেম্বার ছিলেন গুল। হঠাৎ একদিন এসে বললেন, ড. মান্নান, আমি আর এখানে থাকব না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললেন, দেশে গিয়ে রাজনীতি করব। আমি বললাম, আপনি তো কথাই বলেন না, রাজনীতি কী করবেন? তিনি হেসে দিলেন। এটা নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ কৌতুক করি।

গুল খুবই সুদর্শন তরুণ। তিনি সত্যিই দেশে ফিরে গেলেন। কয়েক বছরের মধ্যে দেখি তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টও হলেন। ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ দিকে আমি আগাম অবসর নিয়ে আইডিবি থেকে দেশে ফিরে আসি। এসে ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করি। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক গঠন করি। এর বাইরে আমার জেলা সিরাজগঞ্জে চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে কিছু দাতব্য কাজ করার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১০ সালে গুল বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ কথা শুনে আমি অপেক্ষা করছিলাম আমাকে তার মনে আছে কি না; সেটি জানার জন্য। তিনি জানতেন আমি বাংলাদেশী। আমরা একসাথে আট বছর কাজ করেছি। আমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। আমি তার অনেক পেপার সংশোধন করেছি। সেটি অবশ্য পেশাদারি মনোভাব নিয়েই করতাম। আইডিবির একাডেমিক কমিটির মেম্বার সেক্রেটারি ছিলাম। ফলে আমি ওকে না করলে কোনো প্রকাশনা ছাড়া হতো না। কমিটির প্রেসিডেন্ট আমার ওপর এতটাই আস্থাশীল ছিলেন যে, কোনো প্রকাশনা গেলে আগে দেখতেন আমি সই করেছি কি না। কারণ প্রতিটি প্রকাশনার জন্যই প্রচুর সম্মানী দেয়া হতো। ফলে আমিও ভাবতাম, যেহেতু আমাকে এতটা বিশ্বাস করা হচ্ছে; তাই আমার মেধা ও সাধ্যমতো প্রতিটি অক্ষর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করার চেষ্টা করতাম। গুলকেও এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। অনেকসময় হয়তো তার লেখা বাতিল করা হয়েছে, বিলম্বিত হয়েছে, প্রশ্ন করা হয়েছে। এ কারণে আমি ভাবতাম তিনি হয়তো আমার উপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু গুল ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। আমার প্রতিটি মন্তব্য ও পরামর্শ খুশি মনে তিনি মেনে নিয়েছেন। আমাকে বড় ভাইয়ের মতোই সম্মান করতেন। স্যার না বলে বলতেন ব্রাদার মান্নান।

গুল যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে আসেন, তখন আমি অবসর জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশে এসে ঠিকই তিনি আমাকে খুঁজে বের করেন। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে তুরস্ক দূতাবাস থেকে আমার কাছে টেলিফোন আসে। টেলিফোনকারী জানালেন, প্রেসিডেন্ট গুল আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি হোটেল সোনারগাঁওয়ে রয়েছেন। আমি কিছুটা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। মহৎ মানুষের গুণ এটাই। আমি ঠিক ৯টায় হোটেলে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে গুলের সাথে সাক্ষাৎ করবেন বলে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও শমসের মবিন চৌধুরী অপেক্ষা করছেন এবং মিনিষ্টার-ইন-ওয়েটিং বাণিজ্যমন্ত্রী কর্ণেল (অব.) ফারুক খান রয়েছেন। তারা আমাকে কিছুটা চিনতেন। আমি কার্ড দেয়ার সাথে সাথেই ডাক পড়ল। এতে খালেদা জিয়াসহ অন্যরা কিছুটা অবাক হলেন বলে মনে হলো। যাই হোক, আমি রুমে ঢুকে কুশল বিনিময় করি। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে চাইলাম, কারণ অনেকে তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু গুল আসতে দেবেন না। বললেন- বসুন, কথা বলি। তখন ওয়ার্ল্ড ইসলামিক সোস্যাল ব্যাংক, ইসলামিক ইকোনমি, এসব বিষয়ে আমার ধ্যানধারণাগুলো নিয়ে আবারো কথা হয়। আসলে আমি যেখানেই গেছি সেখানেই আমার এসব চিন্তাধারা বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যদি এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর কিছুটা খেদমত হয়।

সংক্ষেপে কথা শেষ করে বেরিয়ে আসার পর আমি বিএনপি নেতা ও অন্যদের বললাম, আমি অনেক দিন তার কলিগ ছিলাম। যদিও খুব ভালো কলিগ ছিলাম না, অনেকবার তার সাথে কঠোর হয়েছি। ভেবেছিলাম, আমার মতো কাউকে তার মনে না রাখলেই বা কী আসে যায়। কিন্তু ঠিকই তিনি বাংলাদেশে এসে আমাকে শুধু খুঁজে বের করেননি, খুবই আন্তরিকতার সাথে গ্রহণও করেছেন।

এরপর বেগম জিয়াকে আমি বললাম, আপনারা এখানে এসেছেন, আপনারা জানেন, তার স্ত্রীও এসেছেন। তার জন্য কি কিছু গিফট নিয়ে এসেছেন? আমার কথা শুনে তিনি কিছুটা বিব্রত হলেন মনে হলো। বললাম, তাকে রাজশাহীর সিল্কের শাড়ি বা একটি ওড়নার মতো কিছু গিফট করতে পারেন। তখন শমসের মুবিন চৌধুরী উঠে গেলেন কিছু গিফট আনার জন্য। আমার এখানে বিষয়টি উত্থাপনের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী লোকদের মধ্যেও কোনো বিষয়ে হোমওয়ার্ক করার প্রবণতা এতটা কম যে, তা ভেবে অবাক হতে হয়। আমি খেদের সুরে বললাম, আপনারা দেখা করতে আসার আগে কিছু হোমওয়ার্ক করে আসতে পারলেন না?

সেখান থেকে চলে আসার পর গুল আমাকে আবারো মেসেজ পাঠালেন দেখা করার জন্য। একজন মানুষ কতটা বিনয়ী, ধৈর্যশীল, নিরহঙ্কার, সিনিয়রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে গুলের চরিত্রে আমি তা দেখেছি। আইডিবিতে আমার সাথে পরিচয়ের শুরু থেকেই গুল আমাকে শিক্ষকের মতো সম্মান করতেন। কারণ তিনি স্কুলে থাকতে ইসলামিক অর্থনীতির ওপর আমার বই পড়েছেন। আমার বই ১৯৭১ সালে তুর্কি ভাষায় অনুবাদ হয়। পরে বইটির বহু সংস্করণ হয়েছে সেখানে।

গুলের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয় ২০১৬ সালে। তখন আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমার ফ্লাইট ছিল ইস্তাম্বুল হয়ে। ভাবলাম, তুরস্কে যখন যাচ্ছি তখন একটু সাক্ষাৎ করে যাই। তিনি দেশে ছিলেন না, জেদ্দা গিয়েছিলেন। আমার বার্তা তার কাছে পাঠানো হলো। গুল তখন ওআইসির পাঁচ বিজ্ঞ ব্যক্তির একজন নির্বাচিত হন। যখন কোনো গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়, তখন ওআইসি পাঁচজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে ডাকে। গুল তাদেরই একজন ছিলেন। সেই বৈঠক উপলক্ষে জেদ্দা ছিলেন তিনি। আমার হাতে সময় ছিল না। পরদিনই চলে আসব। গুল দেশে ফিরে আসেন। আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ইস্তাম্বুলে তার বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমরা কথা বলি। আমাদের আলোচনায় ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকের প্রসঙ্গ আসে। গুল বললেন, তুরস্কেও ইসলামী ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। তিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদ। তাই পুরোদস্তুর অর্থনীতিবিদ নিয়োগ দিয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ইসলামের লেনদেনের আইনগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার জন্য শক্তিশালী ম্যাকানিজম তৈরি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে আজো হয়নি। এ ধরনের ম্যাকানিজম তৈরির জন্য আমি অনেক দেনদরবার করেছি, অনেক কথা বলেছি। বহুবার গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং আইন হয়নি। তুরস্কেও যে আলাদা আইন করা হয়েছে তা নয়। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনেই আলাদা নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে ইসলামিক ব্যাংকিং পরিচালিত হয়। সেটি বাংলাদেশে নেই। যদিও বাংলাদেশে প্রথম ইসলামিক ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। তুরস্কে ক্যাশ ওয়াক্ফও চালু করেছে শুনে কিছুটা আপ্লুত হই। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল। তাই এটা হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সব কিছু করা যায়। বাংলাদেশেও পার্লামেন্টে ইসলামিক ব্যাংকিং আইন পাস করানো গেলে দেশের চেহারাই পাল্টে যেত। গ্রামীণ ব্যাংককে যদি আইনি স্বাধীনতা না দেয়া হতো, তাহলে একটানা ২৭ বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে এক হাতে ব্যাংকটি পরিচালনা করা সম্ভব হতো না।

আসলে বড় হতে হলে, ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে চাইলে, কী কী গুণ অর্জন করতে হয় সেটি আমি গুলের কাছে শিখেছি। তার রয়েছে অত্যন্ত উদার ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, কোমল মন, হাসিভরা মুখ, অহমিকা থেকে মুক্ত, উঁচু আসনে আসীন হওয়ার পরও শিক্ষককে সমান মর্যাদা দিতে ভুলেননি। আমার মতো আরেক দেশের কাউকে তিনি মনে না রাখলেও পারতেন, কিন্তু সেটি করেননি। আমাদের দেশের কোনো কোনো নেতার সাথে যখন এসব গুণ তুলনা করি, তখন বিপরীত চিত্রই মানসপটে ভেসে ওঠে, যা আমাকে খুবই পীড়া দেয়।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
বিনা শর্তে দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়ল শ্রমিকরা রেমিট্যান্স বাড়ায় দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে শরণার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দক্ষিণ সুদান সরকারকে বিরোধ নিষ্পত্তির নোটিশ এস আলম গ্রুপের, নইলে আন্তর্জাতিক সালিশির হুমকি একনেকে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার ১০ প্রকল্প অনুমোদন সালাহর চমকে উড়ল লিভারপুল ডেঙ্গুতে আরো ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১৭২ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী চীন সখীপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩ নাসিরনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১১০০ সেনা হতাহত হয়েছে : দাবি সিউলের

সকল