২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন

-

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা রকম বিশৃঙ্খলা চলছে যুগ যুগ ধরে। সরকারি, বেসরকারি, বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল, এনজিওর স্কুল, কিন্ডার গার্টেন, ক্যাডেট কলেজ, আলিয়া ও কওমি মাদরাসা ইত্যাদি নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নানামুখী শিক্ষা নিয়ে যে নাগরিকরা তৈরি হচ্ছে তাদের চিন্তা-ভাবনা, মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ সব কিছুই বিভিন্ন ও বিচিত্র। অনেক ক্ষেত্রে তফাৎটা ‘আকাশ ও পাতালের’। ফলে শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য, একটি এককেন্দ্রিক জাতি গড়ে তোলা, সেটি কেবল ব্যাহতই নয়, হচ্ছে সুদূরপরাহত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। তৈরি হচ্ছে চরম নাস্তিক ও নিজ ধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট একটি উন্মূল জনসমষ্টি। অন্য দিকে মাদরাসায় ধর্ম শিক্ষার নামে অনেকটাই কূপমণ্ডূকতা ও বস্তুজগৎ বিচ্ছিন্ন অপুষ্ট মনন গড়ে তোলা হচ্ছে।

তার পরও যেটুকু শিক্ষা আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি, সেটুকুও কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। দশম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর যেটুকু বিদ্যাবুদ্ধি থাকবে বলে আশা করা হয়, দেখা যায় স্নাতক পাস করার পরও সেটুকু জ্ঞান সে আয়ত্ত করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার কথা না হয় না-ই বলি। এই যে আমাদের ব্যর্থতা, এর পেছনে কারণগুলো কী? সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, শিক্ষাব্যবস্থার নানা ত্রুটি, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের শৈথিল্য ইত্যাদি অনেক কথাই। অবশ্য আজকের বিষয় হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন।

গত সোমবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সরকার একটি শিক্ষা আইন করতে যাচ্ছে শিগগিরই। প্রস্তাবিত এই আইনে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত টাকা টিউশন ফি থাকবে তা ঠিক করে দেবে সরকার। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার অনুমোদিত হতে হবে। অনুমোদন ছাড়া কোনো রকম বেতন বা অন্যান্য ফি গ্রহণ করা যাবে না। এই বিধানের ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্ষেত্রেও ফি নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

আমরা জানি, এই বেতন ও ফি নির্ধারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কী ভয়ানক নৈরাজ্য চলছে। যার যেভাবে ইচ্ছা বেতন ও ফি নির্ধারণ ও আদায় করছে। কখনো কখনো এসব বেতন ও ফি’র হার এতই বেশি যে, অভিভাবকরা হিমশিম খেয়ে যান। শিক্ষকদের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এর কারণ। শিক্ষা এখন অন্যতম বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা সেটিকে হাতিয়ার করে অভিভাবকদের ‘পকেট কেটে’ নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন। বিশেষ করে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজের বেতন, ভর্তির ফি এবং পরীক্ষার ফি নির্ধারণের প্রবণতা লক্ষ করলে এই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। অনেক গরিব পরিবারের ছেলেমেয়ে শুধু অত্যধিক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেউ কেউ ফি দিতে ব্যর্থ হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত বেতন ও অন্যান্য ফি নির্ধারণ না করতে অনেক সময়ই সরকার নির্দেশ জারি করেছে। তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। শিক্ষা যে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং টাকা দিতে পারুক বা না পারুক তাকে শিক্ষাদান ও পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে, এই স্বাভাবিক চেতনাটিই আজ সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে।

এখন সরকার শিক্ষা আইন করে এসব অনিয়ম, নৈরাজ্য রোধের উদ্যোগ নিয়েছে। খসড়া আইনের ৩৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা স্তরের সব সরকারি, বেসরকারি ও সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। এ ছাড়া খসড়া আইনে নোট-গাইড ও প্রাইভেট টিউশন বা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধের কথাও বলা হয়েছে। নোট-গাইড এবং কোচিং যে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে মারাত্মক রকমের অন্তরায় সে বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আলোচিত হয়েছে এবং সরকারও এগুলো বন্ধ করার জন্য নানা উদ্যোগ বিভিন্ন সময় নিয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পূর্ব অনুমোদন লাগবে। ইচ্ছে হলেই যে কেউ খেয়াল-খুশিমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ব্যবসায় শুরু করবেন- তেমন সুযোগ আর থাকবে না। আমরা জানি, বর্তমানে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে। একটি দৈনিকের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশে চালু আছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নাকি অন্তত ৫০ হাজার। কেউ কেউ ‘ট্রেড লাইসেন্স’ দিয়ে স্কুল চালাচ্ছেন। কেউ বা এনজিওর নামেও পরিচালনা করছেন স্কুল-কলেজ। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি অনুমতিপ্রাপ্ত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হবে। বিদেশী পাঠ্যক্রমে পরিচালিত স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, মাদরাসা স্থাপন বা পরিচালনা বা বিদেশী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে শাখা স্থাপন বা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হবে।

অতিরিক্ত ফি আদায়, নোট বই, গাইড বই, মেড ইজি, প্রাইভেট টিউশনি, ইচ্ছে হলেই স্কুল খুলে বসা- এসব নৈরাজ্যকর কার্যক্রম এবার যদি আইন করে বন্ধ করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় কাজ হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা খসড়ায় বলা হয়েছে। সেটি হলো, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডির হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের স্কুল-কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি করার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও কিভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটে, তা পুরো জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদ তাদের নির্ধারিত এখতিয়ারের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। এতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ও পাঠদান ব্যাহত হয়। খসড়া শিক্ষা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা কমিটি বা চেয়ারম্যান নির্ধারিত এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন প্রশাসনে বা পাঠদানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। হস্তক্ষেপের কারণে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে কোনো অনিয়ম বা পাঠদান বাধাগ্রস্ত হলে কমিটির চেয়ারম্যান দায়ী হবেন। এই দায়ে কমিটি বাতিল বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারবে সরকার। এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পরিষদের প্রধানের সুপারিশে বা নির্দেশে বাধ্য হয়ে অযোগ্য দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার মান কোথায় যাবে সেটা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যেকোনো বেসরকারি স্কুলের নিয়োগ কার্যক্রম খতিয়ে দেখলেই এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।

একবার রাজধানীর একটি শীর্ষস্থানীয় স্কুলের বার্ষিক অভিভাবক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বক্তৃতায় ভুল শব্দ ব্যবহার করেন। আর ক্লাস সিক্সের এক ছাত্র তার পাশের বন্ধুকে বলছিল, ম্যাডাম যে শব্দটা বললেন সেটা কিন্তু ঠিক নয়। সে সঠিক শব্দটিও বলল তার বন্ধুকে। এটি আমার নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ধারণা করি, এই প্রধান শিক্ষিকার নিয়োগও সম্ভবত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়েছে। যা হোক, পরিচালনা পরিষদের হস্তক্ষেপ বন্ধ হলে গোটা জাতি উপকৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

এ ছাড়া সরকার পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করতে যাচ্ছে। এটিও বড় ধরনের কার্যক্রম। এর অংশ হিসেবে আগামী বছর থেকেই ষষ্ঠ শ্রেণীর পড়ালেখা অবৈতনিক হচ্ছে। প্রাথমিক স্কুলের মতো ষষ্ঠ শ্রেণীতেও স্কুলের বেতন দিতে হবে না শিক্ষার্থীদের। সেটি পরিশোধ করবে সরকার। এই ফি হবে সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ কত টাকা মাসিক টিউশন ফি পরিশোধ করা হবে, তা অংশীজনের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।

দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক, এটা সবার জানা। কিন্তু সেই সুবিধাটি পাওয়া যায় শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেই। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের যে কোনো মান নেই সেটা সবাই জানেন। এই সুযোগটিই নেয় বেসরকারি স্কুলগুলো। পাঁচ শ’-হাজার টাকার নিচে কোনো স্কুলে টিউশন ফি নেই। এমনকি কোনো কোনো স্কুলে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। এগুলো কোনো স্বাভাবিক সামাজিক অবস্থার নির্দেশক নয়। সরকারের অবশ্যই এসব দেখার দায়িত্ব আছে।

আমরা চাই, নতুন শিক্ষা আইন দ্রুত পাস করে অবিলম্বে কার্যকর করা হোক।


আরো সংবাদ



premium cement