সর্বস্তরে বাংলার আশা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়!
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৫৯
আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি হলো ‘ভাষার মাস’। এ মাসজুড়ে চলে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সারা বছর এ মেলার জন্য বইপিপাসুরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এ মাসেই ঢাকাসহ দেশের সব বিভিন্ন শহরে বইমেলাসহ ভাষাসংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে অবশ্যই বাংলা একাডেমির বইমেলা। কারণ, একুশের মেলা সামনে রেখেই বেশির ভাগ প্রকাশক নতুন বই প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে, ঢাকায় সারা বছর যত বই প্রকাশ পায়, তার ৯০ শতাংশই আসে এই মেলার সময়। এ জন্য লেখকদের লেখালেখি, পাণ্ডুলিপি তৈরি এবং বই প্রকাশের ব্যবস্থা করার দিকে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে। বই প্রকাশের সাথে জড়িত প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী ও অলঙ্কারিক, ছাপাখানা, কাগজের দোকানদার, বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সবারই আগ্রহের মিলন ঘটে এক বিন্দুতে। আর পাঠক ক্রেতাদের তো কথাই নেই। এই একটি মাস সামনে রেখে তারা প্রস্তুতি নেন প্রিয় লেখকের নতুন বা প্রিয় বইটি সংগ্রহ করার। মেলায় উপস্থিতি এবং নানা রকম নতুন বই নেড়েচেড়ে দেখার মধ্যেও যে আলাদা সুখবোধ তা তারা পূরণ করেন একুশের মেলায়। সেজন্যই এই মেলা আমাদের প্রাণের মেলা; আমাদের মিলনমেলা।
বাংলা একাডেমির এই মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। তবে এর কিছু প্রাক-ইতিহাস আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করা হয়। সেটিই বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা। এতে ভারতের কিছু প্রকাশনা সংস্থা, বাংলাদেশের কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকায় অবস্থিত কয়েকটি দূতাবাস অংশ নেয়। মূল আয়োজক ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তখনকার প্রধান এবং কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন। তবে এই বইমেলার আরো আগে ১৯৬৫ সালে সরদার জয়েনউদ্দীন তখনকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন। বাস্তবিক অর্থে সেটিই ঢাকার সর্বপ্রথম বইমেলা।
১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক মনজুরে মওলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সূত্রপাত করেছিলেন। কিন্তু সে বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মেলা হতে পারেনি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৪ থেকে যথারীতি মেলা শুরু হয়। প্রথমবার আয়োজনে মাত্র ২৫-৩০টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেয়। সেই মেলা এখন বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। এই মেলা এখন শুধু বাংলা একাডেমিতে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বইমেলা শুধু বইমেলা নয়, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে আয়োজন করা হয় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠান। তাতে দেশী-বিদেশী লেখকরা অংশ নেন। এ ছাড়া এই মেলার সময়ই ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ দেয়া হয়।
অর্থনীতির বিচারেও এই মেলা খুব ছোট নয়। প্রতি বছর মেলায় চার শতাধিক প্রকাশকের আনুমানিক হাজার পাঁচেক বই প্রকাশ পায় এবং ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্প সাক্ষরতার দেশে এটি মোটেই উপেক্ষা করার মতো নয়। আশার কথা, প্রতি বছরই প্রকাশক বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, বইয়ের বিক্রিও বাড়ছে। উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, ছড়া, মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ভ্রমণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সায়েন্স ফিকশন, রহস্য, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, অনুবাদ, নাটক, সঙ্গীত, রাজনীতি, রম্য এবং ধর্মসহ বিবিধ বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ করে থাকেন প্রকাশকরা। এতেই বোঝা যায় বই লেখার পরিসর এবং ক্ষেত্র যথেষ্ট বেড়েছে।
বইমেলার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বইয়ের ব্যবসা নয়। একটি মননশীল ও জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞান আহরণের ও তার ভিত্তিতে জীবনবোধ গড়ে তোলাই বইমেলার আসল উদ্দেশ্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পায়, সেই লক্ষ্যেই বিশ্বজুড়ে বইমেলার আয়োজন করা হয়। আমাদেরও এ আয়োজনের বড় উদ্দেশ্য আমাদের লেখক, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গবেষকরা যেন নিজেদের মেধা, মনন ও চিন্তাভাবনা পাঠকদের জানাতে পারেন, সবার মাঝে এর বিস্তার ঘটাতে পারেন। পাশাপাশি থাকে বইয়ের ব্যবসায়িক দিকটি। একটি বিষয় লক্ষণীয়, এই মেলার নাম হচ্ছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। নামেই স্পষ্ট, এর সাথে জড়িয়ে আছে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন আমাদের অগ্রজরা। এখন বাংলা ভাষার মর্যাদা, এর স্বকীয়তা রক্ষা, এর অবাধ চর্চা এবং বিশ্বজুড়ে একটি প্রধান ভাষা হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের। মেলার নামটি আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
কিন্তু বাংলা ভাষার এখন কী অবস্থা? একুশের অঙ্গীকার ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানে স্পষ্ট করে লেখা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত বাংলা সর্বস্তরে চালু হয়নি। এমনকি আদালতের একাধিক নির্দেশ থাকার পরও নিছক দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠানের নামের সাইনবোর্ডও আমরা বাংলায় আজো লেখাতে পারিনি। অফিস-আদালতে এক ধরনের আধাখেঁচড়া বাংলা চালু করেছি। কারণ, অফিস-আদালতে যারা বাংলা লিখবেন, তাদের স্কুল-কলেজে বাংলা ভাষাটি যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়নি। চাকরির বাজারে ইংরেজির দাপট এখনো অনেক বেশি এবং তা দিন দিন আরো জোরালো হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিপুল বিস্তার, ইংরেজি ভাষ্যে পাঠ গ্রহণ ইত্যাদি এ জন্য দায়ী। আমরা যদি ঢাকা শহরের অভিজাত বইয়ের দোকানগুলোতে খবর নিই, তাহলে জানতে পারব বছরজুড়ে যত বাংলা বই বিক্রি হয়, তার প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক ইংরেজি বই এখন বিক্রি হচ্ছে এ দেশেই। বলা দরকার, একটি বাংলা বইয়ের দাম যদি গড়ে দেড় শ’ টাকা হয় তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করা একটি ইংরেজি বইয়ের দাম গড়ে পাঁচ শ’ টাকার বেশি। এসব বই কিনছে রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম, যারা বাংলাদেশকে বিকৃত উচ্চারণ করে ‘ব্যাংলাদেশ’ বলে।
বাংলা ভাষাকে জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। দেশের সরকারপ্রধান বাংলায় জাতিসঙ্ঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের বড় গৌরবের এই ভাষা নিজভূমিতেই কতটা অবহেলার শিকার, তার হাজারো নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তক খুললে শিশুদের জন্য ভুল বানান আর ভুল বাক্যের বিপুল সংক্রমণ চোখে পড়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বেশির ভাগ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণদক্ষতা। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদ্যাপীঠ থেকে ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানানে মাতৃভাষা শিখছে। উপরন্তু, মহাবিপদ হয়ে উঠেছে হিন্দি ভাষার সিরিয়াল এবং হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন ও অন্য অনুষ্ঠানগুলো। শিশুর ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা বাড়াতে শহরের বাংলাভাষী অনেক মা-বাবাই আজ ঘরে অনবরত ভুলভাল ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। ফল হচ্ছে, শিশুরা কোনো জিনিসের বাংলা নাম শেখার পরিবর্তে শিখছে ইংরেজি নাম। আজ বাংলা ভাষা এফএম বেতার ও টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রভাবে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে একটি মিশ্র ভাষারূপ অর্জনের পথে। কেউ কেউ এই জগাখিচুড়ি ভাষার নতুন নামকরণেরও প্রস্তাব করছেন। বাংলা ভাষার স্বকীয়তা আজ বিরাট হুমকির মুখে। যে দেশ ও জাতি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নিয়ে অহঙ্কার করে, সে দেশে মাতৃভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করার কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি নেই, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে? সুতরাং ভাষা আন্দোলনের এই দেশে বাংলা সর্বস্তরে কোনোকালে প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন আশা বোধহয় পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
ইংরেজি শেখা নব্য অভিজাত শ্রেণীর কথা আপাতত স্থগিত রেখে আমরা বরং বাংলা ভাষার চর্চার বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারি। বাংলা ভাষার চর্চাকারী কারা? মূলত শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিকরাই বাংলা ভাষার নিয়মিত চর্চাকারী। কিন্তু কতজন শুদ্ধভাবে এ ভাষাটি লিখছেন, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, বাংলা একাডেমির মেলায় যেসব বই প্রকাশ পায় তার এক বৃহদংশই নিম্নমানের। বানান ভুল থেকে শুরু করে বাক্য গঠনের ভুল প্রায় ৯০ শতাংশ বইয়ের বৈশিষ্ট্য। এমনকি, যে লেখকের চিন্তারও দৃশ্যত শৃঙ্খলা নেই তাদের বইও প্রকাশকরা নির্বিচারে প্রকাশ করে মেলায় হাজির করছেন। কবিতা হয় না অথবা ছন্দ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, এমন সব কবির লেখা বইয়ে বাজার সয়লাব। এর পেছনে প্রকাশকদের অনৈতিক বাণিজ্যের গভীর সম্পর্ক আছে। এটি এখন সবারই জানা যে, লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনেক প্রকাশক তার অর্বাচীন লেখকের বইটি প্রকাশ করেন। একই অবস্থা দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতারও। দেশের প্রধান দু-চারটি দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর কথা বাদ দিলে বেশির ভাগ পাতায় প্রতি সপ্তাহে সাহিত্যের নামে যেসব ‘রাবিশ’ প্রকাশ করা হয়, সেগুলো আর যাই হোক ভাষা বা সাহিত্যের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না। এসব সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদকদের কোনো লেখার ভুল বাক্য বা ভুল বানান শুদ্ধ করারও যোগ্যতা নেই। সম্পাদনা তো আরো পরের কথা। প্রসঙ্গত বলতে হয়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজনও লেখক বা কবির আবির্ভাব ঘটেনি যিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে মেধার উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি জাতীয় অহঙ্কার, যেটিকে আমরা ‘বাঙালির হাজার বছরের সেরা অর্জন’ বলি, সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এখন পর্যন্ত একটি মহৎ উপন্যাসের জন্ম হয়নি। তাহলে গলদ কোথায়?
ভাবার সময় কি হবে কারো?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা