শোষণমূলক আইন ও বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ২০:৩০
‘জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইড; জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বেরিড’- আমরা প্রায়ই এ ধরনের উদাহরণ দিয়ে থাকি। আমাদের দেশের আইনের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের জীবন অবসান হয়; কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হয় না। এ দেশের আইনের ভিত্তি মূলত ব্রিটিশ আইন এবং সেই আইনের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশরা আইন করেছিল শোষণ এবং শাসনের জন্য। শাসন করতে না পারলে শোষণ করা যায় না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ কিংবা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বহু দিন পরও আমরা সেই আইনের পুরনো কাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি।
আজো ১৮৮২ সালের আইন দিয়ে ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর কোম্পানি/ব্যাংকিং আইন ১৯১৩ সালের। কোম্পানি আইনের যেসব ধারা রয়েছে, সে কারণে ট্রাস্ট এখনো শেয়ার মার্কেটে অংশ নিতে পারে না। ফলে ওইসব ধারাকে উপেক্ষা করেই ট্রাস্টকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হচ্ছে।
এমনকি, ছোটখাটো ব্যাপারেও আমরা ব্রিটিশদের অনুকরণ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের বিচারকদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, আমরা যদি তাদের ড্রেসকোড দেখি, দেখা যাবে, গ্রীষ্মকালেও তাদের মাথায় ‘উইগ’ পরে থাকতে হয়। এটা হয়তো ইংল্যান্ডে শীতপ্রধান দেশে সম্ভব। কিন্তু আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান এ দেশে কেন? ব্রিটিশদের অনুসরণ করে আমাদের বিচার বিভাগে শীতের ও গ্রীষ্মের ছুটি দেয়া হয়। অথচ আমাদের সংস্কৃতি ও প্রকৃতি বলে, এই ছুটি হওয়া উচিত ঈদের সময় বা রমজানের সময়। আইন বিভাগকে স্বাধীনতা দেয়ার কথা বলা হলেও কেউ প্রশ্ন তোলে না আমাদের আইন ও আইনব্যবস্থা আধুনিক বাংলাদেশের জন্য কতটুকু উপযোগী? কিংবা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আইন করা হয়েছে কিনা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আইনগুলোতে সময়ের বিবর্তনে হয়তো কিছু প্রান্তিক পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনের মৌলিক চেতনা ও শোষণের মানসিকতা পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ এতে নেই। আইন সংস্কারের কথা বলা হলেও আমাদের চিন্তাভাবনা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আইনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
আমরা যখন উন্নয়নের কথা বলি, মনে হবে এর সাথে শুধু অর্থনীতি জড়িত। আসলে তা নয়। আইনশৃঙ্খলা, রাজনীতি, সামাজনীতি- সব কিছুই জড়িত এর সাথে। উন্নয়নের সাথে আইনের নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে খুব কম বলা হয়েছে। আদালতের বিরুদ্ধে যখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা বিভিন্ন ‘ওয়াচডগ’ সংস্থা দুর্নীতির অভিযোগ তোলে, তখন বিচলিত হওয়ার কারণ থাকে বৈকি। কারণ বাংলাদেশে দুর্নীতিই উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রধান বাধা।
আমাদের প্রধান বিচারপতিকেও আইনজীবী বা বিচারকদের সমাবেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উপদেশ দিতে হচ্ছে। আইনকে দলীয়করণের অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগের সামান্যতম সত্যতা থাকলেও সাধারণ মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। আমাদের বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা সম্পর্কে যারা অবহিত, তারা জানেন, একটি রিট কেস শুরু করে তা শেষ করা কতটা কঠিন। আবার মামলার চাপে বিচারকরা কখনো কখনো একটি মামলার কিছু অংশ শুনে আরেকটি মামলার শুনানি শুরু করেন। আইনের পরিভাষায় একে বলে ‘আংশিক শুনানি’ ধরা হয় পরদিন বা পরে বিচারক আবার শুনবেন। কিন্তু এরই মধ্যে মামলার বেঞ্চ বা আদালত যদি বদল হয়ে যায়, তাহলে নতুন বিচারক প্রায়ই ওই আংশিক শুনানিকে আমলে নেন না। যে বিচারব্যবস্থা আংশিক শুনানির অনুমতি দেয়, সেখানেই আবার এটাকে অস্বীকার করা হয়। একে ‘বিচারপদ্ধতির অপচয়’ বলা চলে। এটা শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই শিক্ষার্থী ঝরে যাওয়ার মতো। এই বৈপরীত্যের কারণে ভুগতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। তবে বিচারককে যে ভুগতে হয় না, তা নয়। ফলে আমাদের রিট মামলাগুলো নিষ্পত্তির কোনো সময়সীমা নেই। মামলার গুরুত্ব নির্বাচনের কোনো বিধানও নেই। অনেক বিচারক রায় দেয়ার আগ মুহূর্তে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। তখন বিচারপ্রার্থীর সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে আংশিক শুনানি যে একেবারে খারাপ, তা কিন্তু নয়। কারণ কোনো বিচারকের পক্ষে একটি মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনে রায় দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আংশিক শুনানিব্যবস্থা বহাল রেখেই আমাদের দেশের বিচারিক পদ্ধতির অপচয় কমানো উচিত।
বর্তমান বিচারপদ্ধতির আরেকটি বিড়ম্বনা হলো ‘স্টে’ বা স্থগিতাদেশ। অবশ্য এটা সাংবিধানিক অধিকার। এর প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলতে চাই, এই সুযোগে অনেক সময় অপরাধীরা আইনের হাত এড়িয়ে চলার সুযোগ পায়। এতে বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ বাড়ে। আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েও ‘স্টে’ নিয়ে আদালতে সময় প্রার্থনার যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাতে অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত রায় হয় না। ফলে আদালতে মামলার পাহাড় শুধু উঁচুই হচ্ছে। এটা আসলে পদ্ধতির দোষ। প্রক্রিয়া যেভাবে চলে, বিচারকরাও সেভাবে চলেন। এটাও বিচারিক পদ্ধতির অপচয়। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশই স্থগিতাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। এ দেশেও রায় ঘোষণার সময়সীমা বেঁধে দেয়ার নিয়ম করা হলে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার অবসান হতে পারে। ফলে মামলাজটও থাকবে না। আমাদের দেশে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইনজীবীদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা চালু করা উচিত। যে আইনজীবী যত দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারবেন, তার জন্য তত প্রণোদনামূলক পুরস্কার থাকবে।
আসলে শোষণ ও শাসনের জন্য যে আইন তৈরি করা হয়েছিল, তার কিছু প্রান্তিক পরিবর্তন দিয়ে জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু করা যাবে না। প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন। ‘আমূল পরিবর্তন’ বলতে আমি নতুন করে আইন তৈরি করাকে বুঝাচ্ছি। নতুন করে তখনই আইন করা যাবে যখন পুরনোটি আর কার্যকর থাকবে না। এ রকম প্রচণ্ড সাহসী পদক্ষেপের পূর্বশর্ত হলো, বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই অবৈধ ঘোষণা করা। আজকে যদি আকস্মিকভাবে সব আইন বিলোপ করে দেয়া যায়, তাহলে কী হবে? তখন আমরা চিন্তা করব, আইন ছাড়া কোনো সভ্য দেশ ও সমাজ চলতে পারে না। তাহলে আমাদের চলার উপযোগী, আমাদের চিন্তাচেতনার ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আমাদের জাতির প্রয়োজন মেটাতে পারে এ রকম আইন কি হবে? এটা একটি হাইপোথিসিস হতে পারে। এ ধরনের হাইপোথিসিসের ওপর গবেষণা করলে আমরা বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তির একটি ফলপ্রসূ উপায় হয়তো খুঁজে পাবো।
আমাদের বিচারব্যবস্থার আরেকটি ঘাটতি হলো, বিচারাধীন মামলাগুলোর অগ্রগতি মনিটর করার কোনো ব্যবস্থা না থাকা। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, রায় হয় না। এ জন্যও ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের আইন দায়ী। জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য এই আইন পরিবর্তন করতে হবে। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের আইনব্যবস্থা অবশ্যই ইসলামী আইনের ভিত্তিতে হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। সমাজ ও সংস্কৃতির দাবিও এটা। ব্রিটিশরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন তারাও রাতারাতি নিজেদের আইনব্যবস্থা এ উপমহাদেশে চালু করেনি। তারা মুসলিম আইনগুলো বোঝার চেষ্টা করেছে। ১৯৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর তিনি মুসলমানদের আইনব্যবস্থা বোঝার জন্য হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত আইনগ্রন্থ ‘হেদায়া’ ইংরেজিতে অনুবাদের নির্দেশ দেন। কয়েক বছর পরিশ্রমের পর গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন চার্লস হ্যামিলটন। ইংলিশ বার-এ যারা প্র্যাকটিস করতে চাইতেন, তাদের কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ‘হেদায়া’ গ্রন্থটি অন্তর্ভুক্ত করেছিল ব্রিটেনের কাউন্সিল অব লিগ্যাল এডুকেশন। ব্রিটিশরা মুসলিম আইন আত্মস্থ করেছিল মুসলমানদের শাসন ও শোষণ করার জন্য। পাশাপাশি, মুসলিম আইনের অনেক কিছু ব্রিটিশ আইনের মৌলিক অংশেও পরিণত হয়েছিল। কারণ, এর চেয়ে উত্তম কিছু তাদের কাছে ছিল না। তাহলে আমরা কেন সেই সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন করব না?
আমরা সব আইনকে যদি এক মুহূর্তে বাতিল করে দেই, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে শূন্যস্থান সৃষ্টি হবে বলে মনে হবে। আসলে তা কিন্তু নয়। মানবসৃষ্ট আইনতো বেশি দিন আগে চালু হয়নি। লিখিত কোনো সংবিধান ছাড়াই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চলছে কনভেনশনের ওপর ভিত্তি করে। আমাদের সমাজের দীর্ঘ ঐতিহ্য ও কনভেনশন রয়েছে। রয়েছে সামাজিক প্রথা ও দর্শন। আমাদের রয়েছে ইসলামী আইন ও জীবনব্যবস্থার সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। রয়েছে ঐশ্বরিক চিরন্তন আইন। তাহলে মানবসৃষ্ট আইন বিলোপের পর কিছু সময়ের জন্য আমরা কনভেনশন ও ঐশ্বরিক আইনের ওপর নির্ভর করব। তখনই আমাদের সমাজের উপযোগী ও সংস্কৃতিমুখী আইন বেরিয়ে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস বলেছিলেন, ‘আপনাদের এমন সব অধিকার আছে যেগুলো সব ধরনের সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই আপনারা পেয়েছেন। মানুষের আইন দিয়ে এসব অধিকার বাতিল বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারণ এ সব অধিকার ধরিত্রীর সবচেয়ে বড় আইনপ্রণেতার কাছ থেকে আপনারা লাভ করেছেন।’
আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিচারকদের জবাবদিহি থাকতে হবে। তবে উপযুক্ত কর্তৃত্ব নির্বাচন করতে হবে এ জন্য। সেই কর্তৃত্বের অপব্যবহার রোধের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আমরা ন্যায়পালের কথা বলছি। কিন্তু আইন জটিলতামুক্ত না হলে তিনিও ন্যায়বিচার করতে পারবেন না। এ জন্যই প্রয়োজন আইনের সংস্কার।
আমাদের গ্রাম বা তৃণমূলপর্যায়ে যেসব বিচারব্যবস্থা রয়েছে যেমন, পঞ্চায়েত- সেগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে কিছু বিচারকার্যক্রম তাদের হাতেও ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এর সাথে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, মসজিদের ইমাম ও তৃণমূলপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করা যেতে পারে। আসলে, জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্যই মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
বলছি, মানুষের উপকারের মনোভাব নিয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য আমরা যদি নিজেদের আইনগুলো পরিবর্তন করতে পারি, তাহলেই আমরা জনগণকে ক্ষমতায়নের যে কথা বলছি, তখনই প্রকৃত অর্থে তাদের ক্ষমতায়ন করা হবে। তখন তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার-কেন্দ্রবিন্দু হতে পারবে আমাদের বিচারব্যবস্থা।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা