২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভিন্নমত, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম

- ফাইল ছবি

সুচিন্তিত বিবেচনার মাধ্যমে ভিন্ন চিন্তাধারাকে সহনীয় পর্যায়ে স্থান দেয়ার নাম পরমতসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রের সব শ্রেণী, পেশা, দলমত ও সব ধর্মের অনুসারীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনও এর অন্তর্ভুক্ত। এটি গণতন্ত্রের অন্যতম নিয়ামকও। কোনো সমাজে ভিন্নমতের অনুশীলন ও চর্চা না হলে সে সমাজকে সভ্য ও গণতান্ত্রিক বলার সুযোগ থাকে না। যে সমাজে ভিন্নমতের কদর নেই, সেখানে গণতন্ত্রও নেই। দার্শনিক ভলতেয়ায়ের ভাষায়, ‘আমি তোমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি জীবন দিতেও কুণ্ঠিত নই।’ মূলত এটিই গণতন্ত্র ও সভ্যতার মানদণ্ড।

জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার বিষয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের অতীতে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত ছিল না; এখনো নয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণার একটা অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতা অতীতে আমরা লক্ষ করেছি। The Newspaper (Announcment Of declaration) Act-1975 মাত্র চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধের ঘটনাও কারো অজানা নয়। এ ছাড়াও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য অতীতে প্রণীত হয়েছিল নানা ধরনের কালাকানুন। অবশ্য ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের অব্যাহত দাবির মুখে আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা অনুযায়ী জরুরি ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সংশোধন ও ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারা বাদ দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছিল।

তবে পরিতাপের বিষয় যে, পরে নানা ধরনের কালাকালুন প্রণয়নের মাধ্যমে সে অবস্থার বিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে। ফলে গৃহীত আইনগুলোর মৌলিকত্ব আর টিকে থাকেনি। উল্লেখ করা দরকার যে, বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা ১৯৯৯ সাল থেকে হলেও এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারছে না বরং তাদের পদচারণা একটা সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যেই রয়ে গেছে। ফলে সর্বাধুনিক এই গণমাধ্যমটি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না।

অবশ্য বর্তমান সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৩ এর খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ সর্বসাধারণের মতামতের সুযোগ দেয়ায় একটা নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, সরকার যে বিষয়েই বিধিপ্রণয়ন করছে বা করেছে তা তাদের ক্ষমতার অনুকূলেই করা হচ্ছে। দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বড় ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিপ্লব ঘটিয়েছে বলা যায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা মোটেই ইতিবাচক নয়।

আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়ায় গণতন্ত্রের পথচলাও কণ্টকমুক্ত থাকেনি। ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতন্ত্রের অনুষঙ্গগুলোও ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। অভিযোগ উঠেছে যে, শুধু ভিন্নমতের কারণে গত ১০ বছরে সরকার এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একই কারণে ৩৫ লাখ মানুষকে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে এক লাখ আট হাজার চৌদ্দটি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সরকার এবং সরকারদলীয় লোকজনদের হাতে নিহত হয়েছে এক হাজার ৫২৬ জন। গুম হয়েছেন ৭৮১ জন। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি মহাসচিব এমন তথ্য প্রকাশ করলেও সরকার তাদের এই দাবি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

আমাদের দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা রুশোর কথায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে রাজি হননি। তার ভাষায়, জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন নিজেদের স্বার্থে। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে, যেহেতু গণতন্ত্র বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী দিয়ে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সেহেতু গণতন্ত্র কখনোই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা নয়। কারণ প্রত্যেক জাতিরাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপণ্ডিত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য-অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। তাই বেশির ভাগ লোকের শাসন অর্থই অযোগ্য লোকের শাসন। গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে এসব কথা শ্রুতিকটু মনে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও উদার গণতন্ত্র চর্চার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরও এখনো আমাদের গণতন্ত্র ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে নির্বিঘœ করা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যৎসামান্যই বলতে হবে। মূলত শাসনকাজে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সে সমাজ আর গণতান্ত্রিক থাকে না। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ বেশ প্রাসঙ্গিক। তার ভাষায়, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’

মূলত আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণের শাসনের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগটা একেবারেই সর্বসাম্প্রতিক নয়। নিকট অতীতে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থারও গুরুতর অবনতি ঘটেছে। জনগণের ভোট দেয়ার অধিকারটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার। সে কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেয়া সম্ভব ছিল। এটাই ছিল প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজ্যগুলোর আয়তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। ঘটেছে প্রাচীন যুগের নগর রাষ্ট্রের বিলুপ্তি।

বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে সব জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে, জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের মুখপাত্র এবং তাদের অভিমতকে জন-অভিমত বলে মনে করা হয়। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি।

বাংলাদেশে সাংবিধনিকভাবেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে। তাই এ দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই এর যথাযথ প্রয়োগটা বারবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও আমরা এখনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই আমাদের দেশের নির্বাচনগুলোয় জনমতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে না বলে জোরালো প্রশ্নেও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের রাজনীতির সাথে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সাথে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।

সঙ্গত কারণেই প্রচলিত গণতন্ত্রের সুবিধাভোগীদের দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাবার তেমন অবকাশ থাকছে না। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে বেশ আগেই। ক্ষমতাসীনদের একটি বৃহৎ অংশ জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরিবর্তে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকছেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, বিদেশ ভ্রমণ, করমুক্ত গাড়ি আমদানি আর রাজউকের প্লট নিয়ে। নিজেদের স্বার্থেই একই রাস্তা বারবার বানানো হয়, একই ড্রেন প্রতি বছর কাটা হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রতিবাদের সুযোগটাও বেশ সমস্যাসঙ্কুল। মূলত দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অনুপস্থিতির কারণেই রাষ্ট্রের কোনো ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই। সঙ্গত কারণেই পুরো দেশটাই এখন ‘মগের মুলুক’-এ পরিণত হওয়ার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনার অভাবেই এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সুশাসনের আশাবাদটা আজো আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে।

সন্দেহ নেই যে, অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে। আর এ সুযোগ যেখানে থাকে সেখানে জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। আর এটিই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মতপ্রকাশের বা সঠিক রায় দিতে ভুল করলেও সেটি গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা এখন ভোটদানের অধিকার শুধু নয় বরং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছি। অনাকাক্সিক্ষতভাবে গণমাধ্যমগুলোকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মহড়াও প্রত্যক্ষ করছি।

সে ধারাবাহিকতায় দেশের একটি প্রাচীন সংবাদপত্র অফিসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্রে ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়টি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আসলে এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন মোটেই উল্লেখ করার মতো নয়। পত্রিকা অফিসে সন্ত্রাসী হামলা ও সম্পাদক গ্রেফতার সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অথচ টেকসই গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই।
smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement