পেঁয়াজ- একটি প্রাসঙ্গিক উপাখ্যান
- আবদুল আউয়াল মিন্টু
- ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৪২
[৩]
উন্নত বৈশিষ্ট্যের বীজ বনাম উৎপাদনশীলতা
কৃষি উৎপাদনশীলতার মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে বীজের গুণগত মান। যদি বীজের গুণগত মান ভালো না হয় তাহলে জমির উর্বরতা যতই ভালো হোক কিংবা অন্যান্য উপকরণ যেমন শ্রম, সার, পানি, কীটনাশক ইত্যাদি যতই মানসম্পন্ন হোক কিংবা পরিমাণে যত বেশি ব্যবহার করা হোক; ফলন কখনো ভালো হবে না। আবাদ বাড়িয়ে মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। তবে ফলন বৃদ্ধির পুরোটাই নির্ভর করে উচ্চমানসম্পন্ন বীজের ওপর। টেকসই ফলন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন ভালো বৈশিষ্ট্যযুক্ত বীজ যেমন- রোগবালাই প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন ধরনের জৈব ও অজৈব পীড়ন সহনশীল বীজ। একরপ্রতি উচ্চফলনের অর্থ কেবল অধিক উৎপাদনই নয়, বরং স্থিতিশীল সরবরাহ। এর ফলে পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে। তা ছাড়া একরপ্রতি ফলন বেশি হলে বাজারে দাম কম হলেও গড়ে কৃষকের আয় বেশি হবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
উৎপাদনশীলতার তুলনামূলক চিত্র
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ একর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। প্রতি একরে ফলন ৪ টন। বীজের মান নিয়ে আরো অধিকতর আলোচনার আগে নির্বাচিত কয়েকটি দেশে প্রতি একরে পেঁয়াজ ফলনের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি।
যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একরপ্রতি ফলন তুলনা সমীচীন নয়। কেননা সেসব দেশে সবজির মানে পেঁয়াজের চাষ হয়ে থাকে। এই জাতের পেঁয়াজ আকারে বেশ বড়, পানির পরিমাণ অনেক বেশি, ঝাঁজ নেই বলেই চলে এবং ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না। তবে বাংলাদেশে প্রতি একরে ফলন পাকিস্তান বা ভারতের চেয়ে কম হওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ প্রতি একরে ফলন কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ টন হওয়া বাঞ্ছনীয়। অগ্রসরমান প্রযুক্তির এই যুগে এটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা
বাংলাদেশে মোট পেঁয়াজের ৮১ শতাংশই নিম্নোক্ত ১০ জেলাতে উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি পাবনা এবং তারপর ফরিদপুর ও রাজবাড়ী। মোট আবাদকৃত জমির ৭৯ শতাংশ এই ১০ জেলাতেই।
২০১৬-২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলাসমূহ-
সারণি থেকে বোঝা যায় যে রাজশাহী, ঝিনাইদহ ও মাদারীপুরে একরপ্রতি ফলন ৫ টন, পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা জেলায় গড়ে ৪.৫০ টন এবং রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জে ফলন ৩ টনের কম। দেশে একরপ্রতি গড় ফলন ২০১৮ সালে ছিল মাত্র ৩.৬৬ টন, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে পেঁয়াজের মোট চাহিদার পরিমাণ ছিল মোটামুটি ২৯ লাখ টন, যার মধ্যে ১৮ লাখ টন (বিবিএস) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং ১১ লাখ টন (বাংলাদেশ ব্যাংক) আমদানি করা হয়। আমদানির ৯০ শতাংশ উৎস ভারত। একর প্রতি ফলন ৬ টন হলে দেশের মোট চাহিদা মেটাতে মাত্র ৪,৯০,০০০ একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হতো। অর্থাৎ বর্তমানে আবাদকৃত জমিতে উচ্চফলনশীল ও উচ্চমানের বীজ ব্যবহার করে পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কৃষকদের ব্যবহৃত বীজ নিম্নমানের হওয়ার কারণে ফলন কম। তাই দিন দিন পেঁয়াজের ঘাটতি বাড়ছে।
উৎপাদনশীলতা বনাম মোট উৎপাদন
পেঁয়াজ কিংবা যেকোনো কৃষি ফসলের উৎপাদন দু’টি উপায়ে বাড়ানো যায়, জমি আবাদের পরিমাণ বাড়িয়ে অথবা একরপ্রতি ফলন বাড়িয়ে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পেঁয়াজের মোট উৎপাদন ২০০০ গুণ বেড়ে ৯০,০০০ টন থেকে ১৮,৩০,০০০ টনে দাঁড়িয়েছে। বড় ধরনের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে আংশিকভাবে আবাদ বাড়িয়ে ও আংশিকভাবে প্রতি ইউনিট (একর) জমিতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে। উৎপাদন বৃদ্ধির ৫০ ভাগ অবদান রেখেছে জমির আবাদ বৃদ্ধি করে এবং অবশিষ্ট ৫০ ভাগ অবদান রেখেছে একরপ্রতি ফলনের বৃদ্ধি। জমির স্বল্পতা বিধায় প্রয়োজন হলো কম সম্পদ ও উন্নত উপকরণ ব্যবহার করে, একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া। বীজ হচ্ছে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, উৎপাদন বাড়ানো ও কৃষকের আয় বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বীজের চাহিদা ও বীজ উৎপাদনের সমস্যা
সাধারণত প্রতি একর জমি চাষে ৩ থেকে ৩.৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। এই হারে ৪,৫০,০০০ একর জমি চাষে দেশে মোট ১৩০০ টন বীজ প্রয়োজন। অনুমানভিত্তিক বলা যায়, কৃষক নিজে ৭০০ টন বীজ উৎপাদন করে নিজেই ব্যবহার করেন। কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত ৭০০ টন বীজ অঙ্কুরোদগম ও প্রাণশক্তির দিক থেকে নিম্নœমানের। স্থানীয় কোম্পানিগুলো সব মিলে মাত্র ১০০ টন ভালো মানের বীজ সরবরাহ করে। অবশিষ্ট ৫০০ টন বীজ বৈধ বা অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদের দুই তীরে কৃষকরা সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এই বীজ দিয়ে ছিটানো পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন। অপর দিকে মেঘনা ও পদ্মা অববাহিকার কৃষকরা চারা তৈরি করে রোপণ করে। আমদানিকৃত বীজ থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজের মূল্য কম পাওয়া যায়। মূল্য কম পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে; এ ধরনের পেঁয়াজ সবজি মানের এবং এগুলো সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না। এক দিকে এই পেঁয়াজ ভোক্তাদের কাছে তেমন পছন্দনীয় নয়। অন্য দিকে সংরক্ষণ করা যায় কেবল অল্প সময়ের জন্য। তাই ফসল তোলার পরপরই কৃষকরা তা কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশে ভালো মানের পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে বেশ কিছু সমস্যা আছে। যেমন পেঁয়াজ গাছে ফুল আসা থেকে পরাগায়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকতে হবে এবং দিন ও রাতের তাপমাত্রা তিন সপ্তাহ কাছাকাছি থাকতে হবে। ওই সময়কালে দিন ও রাতের সময়ের ব্যাপ্তি প্রায় সমান হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, পরাগায়নের জন্য যথাসময়ে সঠিক পরাগবাহী নিশ্চিত করা। সাধারণত মৌমাছি হলো পেঁয়াজের পরাগবাহী। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যথাসময়ে পর্যাপ্ত মৌমাছি পাওয়া যায় না। অথবা ওই সময় মৌমাছি অন্য ফসলের ফুলের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কয়েক বছর আগে ফরিদপুর অঞ্চলের বীজ উৎপাদকরা অভিযোগ করছিল যে তাদের পেঁয়াজ ফুলে খুবই কমসংখ্যক মৌমাছি আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাইলখানেক দূরে চাষিরা জিরা চাষ করছেন। পেঁয়াজ ফুলের পরিবর্তে জিরা ফুলের ক্ষেতে মৌমাছিরা ভিড় জমাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ধরনের নিত্যনতুন সমস্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। অতএব, কেবল উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য নয়, বরং বর্তমান স্তরের উৎপাদনশীলতা ধরে রাখার জন্য কৃষিবিজ্ঞানীদের এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, সমাধান করতে এগিয়ে আসতে হবে।
পেঁয়াজ উৎপাদনের খরচ ও মুনাফা
আইএফপিআরআই ও পিআরএসএসপি কর্তৃক ২০১৩ সালে পরিচালিত ইন্টিগ্রেটেড হাউসহোলড জরিপ থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যয় ও নিট মুনাফা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সেই জরিপ অনুযায়ী, প্রতি একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে নগদ ব্যয় হয় ৩৮,৭৬১ টাকা (জমি ভাড়া ও কৃষক পরিবারের শ্রম ব্যয় ছাড়া) যা পূর্ণাঙ্গ হিসাব যোগ করলে দাঁড়ায় ৫৪,১৪৬ টাকা। এই হিসাবে তখন প্রতি একর পেঁয়াজ চাষ থেকে (শুধু নগদ ব্যয়কে আমলে নিলে) নিট মুনাফা হয় ৩৫,১৯৭ টাকা এবং সামগ্রিক খরচকে (জমি ও পারিবারিক শ্রম) আমলে নিলে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় একরপ্রতি ১৯,৮১২ টাকা। [চলবে]
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা