পেঁয়াজ- একটি প্রাসঙ্গিক উপাখ্যান
- আবদুল আউয়াল মিন্টু
- ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:৩৩
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে হঠাৎ করে পেঁয়াজের মূল্য নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত (দেশীয় জাতের) পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২০০ টাকায় ছাড়িয়েছে। অন্য দিকে ভারত, মিয়ানমার ও মিসর থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকায়। যদিও আজকের বাজারে মুরগি ও আপেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি যথাক্রমে ১৫০ ও ১৮০ টাকায়। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে স্বল্পতা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রথমে রফতানি মূল্য বাড়ানো ও পরে রফতানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করায় স্থানীয় বাজারে সরবরাহ ঘাটতি, পেঁয়াজের উচ্চ মূল্যের প্রধান কারণ বলে বিবেচিত।
বাংলাদেশে রন্ধন প্রক্রিয়ায় পেঁয়াজ অন্যতম একটি প্রধান উপকরণ, যা মসলা হিসেবে বিবেচিত। পেঁয়াজের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাসাধারণের। এ কারণে তারা কেবল সরকারের ওপরই নয়, বরং পেঁয়াজ ব্যবসায়ী, সরকার এবং ভারতের ওপর অসন্তুষ্ট। যেকোনো খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাদের জীবন মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারতে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণত রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের কারণে আশির দশকে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে হেরে যায়, সেই সাথে বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার পরিবর্তনের কারণ ছিল। এমনকি এই অক্টোবরেও শাসক দল মহারাষ্ট্র ও হারিয়ানার রাজ্যসভায় উলেখযোগ্য সংখ্যক আসনে হেরে যাওয়ার পেছনে পেঁয়াজের উচ্চমূল্যও একটি কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে জনসাধারণের ওপর পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের পরিমাণ কতটুকু তা অনুমান করা বেশ কঠিন। কেননা, আমাদের দেশে এখন আর ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে তাদের অসন্তুষ্টি বা বিমুখভাব প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। কিছু দিন ধরে খবরের কাগজের প্রধান শিরোনামের জায়গা দখল করে রেখেছে পেঁয়াজের উচ্চমূল্য। সাধারণ জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি এ থেকেই একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পাঠকের অবগতির জন্য ১৫ নভেম্বর, শুক্রবারের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় পেঁয়াজ সম্পর্কীয় শিরোনামগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি- (ক) ডবল সেঞ্চুরি হাঁকল পেঁয়াজ; (খ) পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সংসদে তীব্র ক্ষোভ; (গ) শ্যামবাজারে অভিযান- পেঁয়াজের দাম বেশি রাখায় এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা; (ঘ) ২০০ টাকা কেজি পেঁয়াজ- ভূঞাপুরে ৫ ব্যবসায়ীর জরিমানা।
টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দৈনিক প্রথাগত সংবাদের পাশাপাশি কলাম লেখকরাও পিছিয়ে নেই। তারাও পেঁয়াজ নিয়ে নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন। বিজ্ঞ বা অনভিজ্ঞ মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন এবং কাউকে না কাউকে দোষারোপ করছেন। কেউ কেউ এটাকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তা ছাড়া পেঁয়াজের আদ্যপ্রান্ত লিখে জনগণকে অবহিত করছেন। যেমন মানবসভ্যতার প্রথম দিক থেকেই পেঁয়াজের ব্যবহার, এটা কি সবজি না মসলা, এটা কাটলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে কেন, কখন কিভাবে পেঁয়াজ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হতো, অতীতে পেঁয়াজকে কিভাবে শক্তি বুস্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো, পেঁয়াজের পবিত্রতা, পরকালে সমৃদ্ধির আশায় প্রাচীনকালে পেঁয়াজের পূজা করা, এর খাদ্যগুণ কী ও কত প্রকার, স্বাদ ও গন্ধের অপূর্বতা, গন্ধ কিভাবে দূর করবেন ইত্যাদি। একই সাথে কিভাবে কৃষককে পেঁয়াজ উৎপাদনে আরো উৎসাহ দিয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো ও সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখা যায় সেসব ব্যাপারে মতামত দিচ্ছেন। মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য বড় বড় রাজনীতিবিদরাও পিছেয়ে নেই। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা এই বলে নসিহত করছেন, ‘পেঁয়াজ খাওয়া ততটা প্রযোজনীয় কিছু নয়।’ একজন ব্যাবসায়ী ও ভোক্তা হিসেবে বাজনীতিবিদদের এ মন্তব্যের সাথে আমি মোটেই একমত হতে পারি না। তাদের চিন্তাধারা হলো ‘মাথাব্যথার জন্য ওষুধের পরিবর্তে মাথা কেটে ফেলা’। মাথা না থাকলে ভবিষ্যতে মাথাব্যথার সমস্যা থাকবে না। যেমন তারা মনে করেন, যারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে চিৎকার দেন তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিলে দেশে আর গণতন্ত্রের কোনো ঝামেলা থাকবে না। তা ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা বৃহদংশ হলো ভোগ। যদি ভোগ কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে সে অনুপাতে প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। অতএব, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কোনো ভালো চিন্তাধারা নয়।
সংবাদপত্রের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তারাও প্রতিদিনই পেঁয়াজ নিয়ে কথা বলছেন। তারা পেঁয়াজের আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়াতে উপদেশ দিচ্ছেন। বন্দর থেকে খালাসপ্রক্রিয়া, বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অবশ্য সরকারের আনুকূল্যে থাকা নামীদামি অনেক ব্যাসায়ী পেঁয়াজ আমদানির জন্য বড় বড় চালানের এলসি খুলেছেন। এমনকি বিমানে করেও আনার চেষ্টা চলছে। ভয়ঙ্কর যৌথ বাহিনীর মতো কর্মকর্তারা বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে যৌথ কমিটি গঠন করে প্রতিদিনই শহর-বন্দর-নগরের পাইকারি ও খুচরাবাজার পরিদর্শনে যাচ্ছেন। বিক্রেতাদের ‘যৌক্তিক মূল্যে’ বিক্রি করার সৎ পরামর্শ দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাও পিছিয়ে নেই। তারা পেয়াজসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে এবং এখানে-সেখানে এর-ওর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কর্মকর্তারা কোনো কোনো জায়গায় শাস্তির ভয় দেখাচ্ছেন। বহু বাজারে পেঁয়াজ বিক্রেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দিচ্ছেন। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দোকানে মূল্য তালিকা টানিয়ে দিচ্ছেন। কেউ এটাকে বলছে ‘ন্যায্যমূল্য’, কেউ আখ্যায়িত করছেন ‘যৌক্তিক মূল্য’ হিসেবে। এসব থেকে সহজেই অনুমেয়, যে পেঁয়াজের উচ্চমূল্য নিয়ে সরকার শঙ্কিত।
এখানে ‘যৌক্তিক প্রশ্ন’ হলো, পেঁয়াজের ‘যৌক্তিক বা ন্যায্যমূল্য’ কত? এই যৌক্তিক মূল্যে নির্ধারণ করার মালিক কে? সাংবাদিক, কলাম লেখক, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না ব্যবসায়ী; কারা জনদরদি হিসেবে এই মূল্যবান দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা রাখেন। তবে রাজনীতিবিদ সংবাদসেবী, কলাম লেখক, ভোক্তা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা এবং সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মাঝে এক জায়গায় মিল পাওয়া যায়। প্রায় সবার মূল্যায়ন হচ্ছে; আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী- সবাই মিলে একটা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোক্তাদের পকেট কাটার জন্য এই সিন্ডিকেট ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এটা অনৈতিক। তবে সৌভাগ্য যে কেউ এটাকে অবৈধ বলে কোনো বক্তব্য দেয়নি। ব্যবসায়ে অনৈতিক আচরণের শাস্তি কী- এ ব্যাপারে আমার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আরেকটা বিষয়; যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে এই গোষ্ঠী গড়ে হরিবোলের মতো উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকে যে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। সেটা পেঁয়াজ হোক বা কমলা হোক। এতসব লেখালেখি দেখি, বারবার বোঝার চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। কেননা, যে পণ্যের লাখ লাখ উৎপাদনকারী, কোনো রকম বাধানিষেধ ছাড়াই আমদানি করা যায় এবং শত শত ক্ষুদ্র আমদানিকারক, হাজার হাজার আড়তদার এবং লাখ লাখ খুচরা বিক্রেতা, সে পণ্য বিক্রিতে সিন্ডিকেট করে কিভাবে দাম বাড়াতে পারে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা বোধগম্য নয়। এ পর্যায়ে ‘যত দোষ- নন্দ ঘোষ’ প্রবাদবাক্যটি মনে পড়ে। কথাটা অন্যভাবে বলা যায়, পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের কারণ যাই হোক বা না হোক, সব দোষ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের। কেননা তারা মুনাফাখোর তথা নীতিহীন। তারা ভোক্তার দুর্দশার কথা না ভেবে রক্তচোষাদের মতো কেবল অতি মুনাফার পেছনে ছুটে চলেছে।
আমরা যদি অতি সাম্প্রতিক সময়ের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যেমন সরকারদলীয় কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, আবরার হত্যা, ভোলায় সংঘর্ষ, শুদ্ধি অভিযান বা রেল দুর্ঘটনা; যে বিষয় হোক, তার বিপরীতে পেঁয়াজের সংবাদ কাভারেজের দিকে লক্ষ করি তাহলে অনায়াসে বলা যায়, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছে। এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতে আরো কয়েক মাস পেঁয়াজের সংবাদ একইভাবে শিরোনামে থাকবে। এতসব লেখালেখি ভোক্তাদের জন্য অতিমাত্রায় দরদের বহিঃপ্রকাশ হলেও, বাস্তবে এসবই যেন নিঃস্বার্থবান একদল লোকের সমবেত বিহঙ্গ কূজনের (Choir) মাধ্যমে ভুক্তভোগী ভোক্তাদের সান্ত্বনা দেয়ার একটা অপচেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে এসব মন্তব্য, অভিমত, মতামত, দর্শন, পরামর্শ, কোনোটাই বাংলাদেশে প্রয়োজনমাফিক পেঁয়াজ উৎপাদন, সরবরাহ বাড়ানো কিংবা মূল্য কমাতে কোনো কাজে আসবে না।
ভাগ্যক্রমে আমি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নই। তবে একজন সাধরাণ ব্যবসায়ী হিসেবে আমি বহু বছর ধরে পেঁয়াজসহ নানা কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো এবং সরবরাহ সঙ্কট কমানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া দুই দফায় এফবিসিসিআইর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের বর্তমান কোণঠাসা অবস্থা দেখে আমি অনুশোচনা বোধ করি। অনুশোচনা কেন? তাহলে কি ব্যবসায়ী হিসেবে ভোক্তাদের প্রতি আমার কোনো দরদ নেই? আরো প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ব্যবসায়ী বিধায় আমি কি নৈতিকতায় বিশ্বাস করি না। সত্যি বলতে কি সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন ইংরেজি-বাংলা মিলে ২০-২৫টি সংবাদপত্রে চোখ বুলাই, তাতে ভোট চুরি, ব্যাংক লুট, হত্যা, খুন, গুম, ঘুষ, দুর্নীতি, সড়ক-রেল দুর্ঘটনা, শিশু নির্যাতন- এগুলো ছাড়া অন্য কিছু তেমন চোখ পড়ে না। এগুলো দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে ও শুনতে শুনতে, এখন আমাদের সমাজে কোনটা নাটক, কোনটা বৈধ-অবৈধ বা কোনটা নৈতিক, অনৈতিক বা রাজনৈতিক; সেটা বোঝার বোধশক্তির কিয়দংশ হলেও হয়তো বা ইতোমধ্যে লোপ পেয়েছে। তারপরও যখন দেখি, একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তারাই অনৈতিক কার্যকলাপ ও মুনাফাখোর হিসেবে নিত্যনিয়ত অভিযুক্ত হচ্ছেন। তাতে আমি অনুশোচনা বোধ করার কারণ খুঁজে পাই। তাই পেঁয়াজের উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা, সরবরাহ, চাহিদা, সংরক্ষণ এবং উৎপাদনে লাভ-খরচ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য বহুদিন পর আজ লিখতে বসলাম। তবে পেঁয়াজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে ব্যবসা-বাণিজ্য, মুনাফা ও নৈতিকতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যকীয় বলে মনে করি।
ব্যবসা বনাম মুনাফা
মানুষকে যেমন বেঁচে থাকার জন্য নিঃশ্বাস নিতেই হয়, ব্যবসায়ীদেরকেও টিকে থাকার জন্য মুনাফা অতি আবশ্যক। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম নৈতিকও নয়, অনৈতিকও নয়। তবে যারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্ন অবশ্যই আছে। কাজ করলে যেমন পারিশ্রমিক পাওয়া অপরিহার্য, তেমনি ব্যবসাতে মুনাফা অপরিহার্য। মুনাফা সমাজে দক্ষতা বৃদ্ধির এক অপরিহার্য মৌলিক উপাদান। এই দক্ষতা হলো অপচয় পরিহারের দক্ষতা। অন্য দিকে আবার দক্ষতা হচ্ছে উপযুক্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সঠিক পরিমাণ উৎপাদন বা আমদানি করে সরবরাহ নিশ্চিত করার দক্ষতা। মুনাফা অবশ্যই বস্তু বা জড়বাদের সাথে স¤পর্কিত। যদিও আধ্যাত্মিকতা তথা জীবনের গভীরতম অর্থ ও তাৎপর্য জড়বাদের বিপরীত হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নৈতিকতা সম্পর্কে বেশির ভাগ পাশ্চাত্য ধারণায় মুনাফা ভালো। তবে প্রচলিত মূল্যবোধের মাপকাঠিতে মুনাফার লিপ্সা ভালো নয়। চিরায়ত উদারনৈতিক সমাজের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তিতর্ক দাঁড় করানো হয়, সেসবের অন্যতম হচ্ছে- ‘ওই সমাজের অর্থনীতি মুনাফা দ্বারা পরিচালিত।’ মুনাফা মানেই লিপ্সা, তাই মুনাফা অনৈতিক। মুনাফার সাথে লোভের স¤পর্ক চিরাচরিত। সত্যি বলতে কি; লোভলালসা মানুষের জন্মগত চরিত্রের এক চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। অনেকেই মনে করেন, ব্যবসায়ীরা কেবল মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন, তারা দেশের জনগণের সামষ্টিক স্বার্থকে বড় করে দেখেন না। তারা কেবল তাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকেই বড় করে দেখেন।
পক্ষান্তরে অবাধ উদ্যোগভিত্তিক সমাজে মুনাফাই হলো ওই সমাজের চালিকাশক্তি। এই সমাজে বাজার মানের নিরিখে যদি কেউ কোনো একটা ব্যবসায় খুবই বেশি মুনাফা করতে থাকেন, তাহলে অন্য আর একজন একই ধরনের পাল্টা ব্যবসা গড়ে তোলেন- যাকে বলা যায় ‘চিরায়ত উদারনৈতিক মূলনীতিভিত্তিক তৎপরতা’। এভাবে নতুন প্রতিযোগী একই পণ্য কম দামে বা আরো উন্নতমানের পণ্য একই দামে বাজারে বিক্রি করবেন। এর ফলে বর্তমানে যারা বেশি মুনাফা করছেন তারা দাম কমাতে বাধ্য হবেন। এতে মুনাফাও কমে যাবে। এভাবে প্রয়োজনীয় কাটছাঁটের পর যে মুনাফা দাঁড়াবে, তা হবে বিনিয়োজিত মূলধন ও পরিশ্রম থেকে বাজারভিত্তিক আয়। এমনি ভাবে মুনাফা এক নিয়ামক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ প্রক্রিয়ায় সঠিক পণ্য, সঠিক পরিমাণ ও সঠিক মূল্যে আমদানি বা উৎপাদিত হয় এবং যুক্তিসঙ্গত (ন্যায্য কিনা বলতে পারব না) মূল্যে বিক্রি হয়। পক্ষান্তরে চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম; এর অর্থই হলো বেশি মুনাফা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা নীতিগতভাবে মুনাফার বিরোধী তারা মুনাফার প্রেরণা বা অভিপ্রায়কে (সড়ঃরাব) অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরেন। বহু উদ্যোক্তা যেমন মুনাফা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, তেমনি পেশাদারি সন্তুষ্টির কারণেও প্রেরণা বোধ করেন। তবে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মুনাফা অনস্বীকার্য এক আবশ্যকতা। মুনাফাবিরোধীরা অহেতুক দাবি করেন যে মুনাফা; লোভ, অবিবেচনা ও অন্যান্য অপ্রীতিকর সমস্যার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অন্য দিকে আবার ক্লাসিক্যাল উদারনৈতিকতাবাদীরা যে অর্থনৈতিক তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, সেটা হলো ‘মুনাফা মাত্র নিয়ামকের’ কাজ করে এবং নিয়ামক হিসেবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- কোন বাজারে কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদিত হবে বা কতটুকু আমদানি হবে, কে হবে ভোক্তা, কত হবে পণ্যের মূল্য? এসব কার্যক্রমের লেনদেনে উদ্বৃত্ত অর্থের কে কতটুকু পাবে, সেটাও হবে বাজারভিতিক। এসব কার্যকলাপের পথপরিক্রমায় যেকোনোটি যেমন লোভ, লোলুপ ও অবিবেচনার সাথে স¤পর্কিত হতে পারে, তেমনি আবার এসব তৎপরতার সাথে পেশাদারি সন্তুষ্টিও সম্পর্কিত। (চলবে)
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা