সংরক্ষিত মহিলা আসন
- ড. আব্দুস সাত্তার
- ২২ নভেম্বর ২০১৯, ২০:৩৮
সংরক্ষিত আসনের ইংরেজি হচ্ছে Reserved seat. এর বাংলা অর্থ হচ্ছে- ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত আসন। ‘সংরক্ষিত আসন’ বললে সবাই বোঝেন, বাসে মহিলা যাত্রীদের জন্য কয়েকটি আসন খালি রেখে দেয়া। অর্থাৎ ওই আসনগুলোতে পুরুষ যাত্রী বসতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের দেশে এটা মানা হয় না। ফলে দেখা যায়, সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলোতেও পুরুষ যাত্রীরা বসে থাকেন। বাসে পর্যাপ্ত আসন খালি থাকা সত্ত্বেও মহিলাদের আসনগুলোতেও পুরুষ যাত্রীরা বসে থাকেন। এমনও দেখা যায় যে, মহিলারা দাঁড়িয়ে আছেন আরা পুরুষরা মহিলাদের আসনে বসে আছেন। অনেক সময় দেখা যায় মহিলাদের কেউ কেউ ছোট ছোট শিশু নিয়ে উঠেছেন। এক শিশু কোলে, এক শিশু পাশে নিয়ে, দাঁড়িয়ে থেকে মহিলা যাত্রী অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করছেন। তবুও সংরক্ষিত মহিলা আসনে বসা পুরুষরা আসন ছাড়ছেন না! স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে অনেক সময় মহিলা আসনে বসা পুরুষদের সাথে তারা তর্কে লিপ্ত হন। এরূপ পরিস্থিতিতে কখনো কখনো পুরুষ যাত্রী অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কখনো কখনো ঝগড়া সত্ত্বেও তারা আসন ছাড়েন না। গোঁয়ার্তুমি করে পুরুষরা বসেই থাকেন। যারা বাসে যাতায়াত করেন তারা লক্ষ করেছেন, কোনো কোনো বাসের ভেতরে লেখা থাকে- মহিলা, শিশু এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য সামনের ৯টি আসন সংরক্ষিত।’ এর চেয়ে বেশি কিছু লেখা থাকে না। ফলে কোন ৯টি আসন সংরক্ষিত, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয় না। আরো লক্ষণীয় হলো, সংরক্ষিত ৯টি আসনই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত নয়। যদি সমানভাবে চিন্তা করেন, তাহলে তিনটি আসন মহিলাদের জন্য, তিনটি আসন শিশুদের জন্য আর তিনটি প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য। কিন্তু সাধারণত প্রায় সবাই ভাবেন যে, বাসের ৯টি আসনই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। কারণ বাসে প্রতিবন্ধী যাত্রী সাধারণত ওঠেন না। আর শিশুরা একা বাসের যাত্রী হয় না। বাবা-মাও শিশুদের একা ছেড়ে দেন না। বাংলাদেশের নিয়মকানুন, যা জনগণকে পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়, তার কোনো কোনোটিকে উদ্ভট মনে হয়। যেমন- শিশুদের জন্য বাসের আসন সংরক্ষণ। কারণ ‘শিশু’ বলতে অতি অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েকেই বোঝানো হয়। তারা একা একা ভ্রমণে বের হয় না। তাহলে কেন শিশুদের জন্য আসন ‘বরাদ্দ’ রাখা হলো?
বেশ কিছু দেশ ভ্রমণকালে দেখেছি- বাসে বা ট্রেনে সংরক্ষিত আসনগুলো রাখা হয় বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য। মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ২০০৬ সালে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ছয় মাসের জন্য। উদ্দেশ্য, অতি দরিদ্র থেকে কিভাবে কোরিয়া সম্পদশালী দেশে পরিণত হলো, তা দেখা এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যায়, সে সম্পর্কে পরামর্শ নেয়া। এশিয়ার বহু দেশ থেকে আমার মতো অনেককে সে সময় কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদেশে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। রাজধানী সিউলের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হয়েছে আমাকে। কোরিয়ায় যাতায়াতের জন্য ট্রেনই প্রধান যান। ৫ মিনিট পরপর পাওয়া যায় ট্রেন। তারপরও বেশির ভাগ সময়ে বগিগুলো যাত্রীতে পূর্ণ থাকে। প্রায় সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যাতায়াত করেছি। একদিন কেনাকাটার জন্য একজন মহিলা অফিসার আমাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। উঠে দেখি, প্রচণ্ড ভিড়। যাত্রীরা ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরাও দাঁড়ালাম। হঠাৎ অফিসার আমাকে বললেন- ‘স্যার, এখানে বসুন। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, ছয়জন যাত্রী বসতে পারে এমন এক দীর্ঘ আসনের পাশে লেখা রয়েছে, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। ছয়জনের পুরো আসনই খালি। সবাই ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কেউ বসছেন না। অফিসার বললেন, এ আসন আপনার জন্যই, বসুন।’ কিছুটা বয়স্ক হিসেবে বসলাম এবং আসন খালি আছে দেখে তাকেও বসতে বললাম। আমার আহ্বানকে সম্মান জানিয়ে তিনি বসলেন এবং পরক্ষণেই দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন- স্যার, এ আসন আপনার মতো বয়স্ক যাত্রীদের জন্য, আমার জন্য নয়। এ কথা বলে তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন মহিলা হয়েও। এ কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিলাম আর ভাবছিলাম, বাংলাদেশ হলে কী হতো? অসংখ্য যাত্রী দাঁড়িয়ে যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না, সেখানে ছয়-সাতজন বসবার মতো আসন পুরোটাই খালি, অথচ কেউ বসছেন না। একটি দেশের মানুষ কতটা সভ্য হলে, কতটা শিক্ষিত হলে এবং আইনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল হলে এমনটি ঘটতে পারে, এটা তারই একটা দৃষ্টান্ত। কোরিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডরমিটরিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই সুবাদে বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ঘোরার সুযোগ পেয়েছি। এখান থেকে ট্রেনে যাতায়াত করেছি কোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনে। কোরিয়া ইউনিভার্সিটিতেও সর্বত্র ঘুরেছি। ঘুরেছি অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু কোথাও বিশৃঙ্খলা কিংবা অশান্ত পরিবেশ দেখিনি। দেখিনি ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির নামে পঙ্কিলে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনা। ট্রেনে কিংবা বাসে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিগোচর হয়নি। সবই চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭, এই দুই বছর আমেরিকা সরকারের ফুলব্রাইট গ্র্যান্টের অধীনে ওয়াশিংটন ডিসি এবং নিউ ইয়র্কে ছিলাম উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে। এ দুই বছর বাসে ও ট্রেনে যাতায়াত করেছি। কিন্তু কোথাও বিশৃঙ্খলা কিংবা সঙ্ঘাত দেখিনি। বরং বাসের ব্যবস্থাপনা আর শৃঙ্খলা দেখে বিস্মিত হয়েছি। বাসে ড্রাইভার ছাড়া আর কোনো লোক নেই। নির্দিষ্ট স্টেশনে বাস থামলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাসের সামনের ও পেছনের দরজা খুলে যায়। সামনের দরজা দিয়ে যাত্রীরা ওঠেন এবং পেছনের দরজা দিয়ে যারা নামার, তারা নামেন। সামনের দরজা দিয়ে যারা ওঠেন তারা কোথায় যাবেন সে দূরত্ব অনুযায়ী নিজেরাই ভাড়ার টাকা ড্রাইভারের পাশে বাক্সে ফেলে পেছনে গিয়ে আসন গ্রহণ করেন। ড্রাইভার তাকিয়েও দেখেন না, কে কত টাকা দিচ্ছেন বাক্সে। ভাড়া নিয়ে বচসা হওয়ার কোনো দরকারই নেই। সবাই চলেন বিশ্বাস ও নীতি আদর্শ মেনে। এ ব্যবস্থাপনার কথা কি কেউ কল্পনাও করতে পারবেন আমাদের দেশে? কখনো না। কারণ যারা লুটপাটে বিশ্বাসী, পরের ধনে পোদ্দারি করতে অভ্যস্ত, যারা খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল দিতে পারঙ্গম, তারা বিশ্বাসও করতে চাইবে না যে এমন ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও থাকতে পারে।
বিদেশে জেব্রাক্রসিং সম্পর্কে গাড়িচালকরা ভীষণ সচেতন। জেব্রাক্রসিংয়ের সামনে গেলেই চালক গাড়ির গতি কমিয়ে দেন- সেখানে মানুষ থাকুক বা না থাকুক। এ অভ্যাস তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে অভ্যস্ত করে তোলে। কারণ জেব্রাক্রসিয়ের ওপর রাস্তা পারাপাররত কোনো মানুষকে যদি কোনো গাড়ি ধাক্কা দেয়, জখম করে কিংবা দুর্ঘটনার কারণে কোনো মানুষের মৃত্যু ঘটায়, তাহলে ক্ষতিপূরণ দিতে দিতে নাকি গাড়ির মালিক নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে কিংবা নিঃস্ব হওয়ার উপক্রম হয়। ফলে চালকরা সবসময় সতর্কভাবেই গাড়ি চালাতে হয়। বাংলাদেশে এটা ভাবাই যায় না। এ দেশে রাস্তার পাশে দোকান বা ঘরবাড়িতে গাড়ি ঢুকে মানুষ হত্যা করলে কিংবা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের চাপা দিলে এমন কি দুই বাসের মধ্যে ফেলে মানুষকে পিষে মারলেও কোনো শাস্তি হয় কি?
টোল আদায়ের সময় রাস্তায় জট কিংবা দীর্ঘলাইন সৃষ্টি হওয়ার সংবাদ প্রায়ই পাওয়া যায় বাংলাদেশে। বিদেশে দেখেছি রাস্তায় টোল আদায়ের স্থানটিকে মূল রাস্তার কয়েক গুণ চওড়া করে অনেক বুথ বসানো হয়, যাতে টোল আদায়ের সময় রাস্তায় যানের জটলা না হয়। কোরিয়ায় দেখেছি, মুহূর্তেই টোল দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। গাড়িকে এজন্য অপেক্ষাই করতে হয় না। ফলে যান চলাচলে স্বাভাবিক গতি বজায় থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। রাস্তায় অসংখ্য পুলিশ কিন্তু কোনো কাজই ঠিকভাবে হতে দেখা যায় না। বিদেশে রাস্তায় পুলিশ দেখা না গেলেও সব কাজ চলে স্বাভাবিক নিয়মেই। রাস্তায় লাল, হলুদ, সবুজ বাতি মেনে চলেন সবাই; কেউ আইন ভঙ্গ করেন না। কিন্তু বাংলাদেশে আইন মানার বালাই নেই। আইন মানানো এবং রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য নতুন আইন জারি করা হয়েছে। প্রচার মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে এ নিয়ে। টিভিতে টকশোতে বিজ্ঞজনেরা এসব আইনের পক্ষে ও বিপক্ষে কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের কাছ থেকে আইন অমান্য করার শিক্ষাও পাচ্ছেন যান চালকরা। তাদের কারণেই চালকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কোনটা মানবেন আর কোনটা মানবেন না। কারণ রাস্তায় দেখা যায় লাল বাতি জ্বলে থাকলেও পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। অথচ সবাই জানেন লালবাতি জ্বলার অর্থ হলো, অপেক্ষা করা; গাড়ি থামিয়ে সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ঘটছে উল্টোটাই। রাস্তায় বিশৃঙ্খলা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক চালক দ্রুত যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে অবৈধভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন! আইন না মানার অদ্ভুত মানসিকতায় যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। অরাজকতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যেই পাস করা হয়েছে নতুন আইন।
ইন্টারনেটে দেখলাম, বাসে মহিলাদের আসনে পুরুষ যাত্রী বসলে ৫০০০ টাকা জরিমানা করা হবে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মহিলাদের আসনে বসা নিয়ে প্রায়ই জটিলতা সৃষ্টি হতে দেখা যায়। তবে কোন কোন আসন মহিলার জন্য, কোন কোন আসন প্রতিবন্ধীর জন্য আর কোনগুলো শিশুদের জন্য, তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তাহলে পুরুষ যাত্রী মহিলাদের আসনে বসেছেন কি না তা সহজেই নির্ধারণ করা যাবে এবং জরিমানা করাও সহজ হবে। তা না হলে কেউ যদি বলেন, মহিলাদের আসনে বসিনি; বসেছি শিশুর আসনে, কিংবা বসেছি প্রতিবন্ধীর আসনে, তাহলে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে কী করে? শুধু আইন তৈরি করলেই হবে না। আইন প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে, যাতে মানুষ আইন মানতে বাধ্য হয় এবং আইনের প্রতি হয় শ্রদ্ধাশীল।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা