২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতের ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষয়রোগ’

-

সাংবিধানিক শাসনের বিচ্যুতি ‘রাষ্ট্রের ক্ষয়রোগ’ হিসেবে গণ্য। ক্ষয়রোগ যেমন ব্যক্তির জীবনী শক্তির বিনাশ করে, ঠিক তেমনিভাবে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল দুর্বল করে দেয়। মূলত সংবিধান লঙ্ঘন করে কখনো সুশাসন ও গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যায় না বরং তা জাতিসত্তার অপমৃত্যুর অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এমনটিই ঘটছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। এ জন্য কখনো ধর্ম, কখনো বর্ণ, আবার কখনো মানুষের বোধ-বিশ্বাসকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। পদদলিত করা হচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবতাকে। আবার এসব করা হচ্ছে ধর্মের নামেই- যা কোনো গণতান্ত্রিক, সভ্য ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়।

ইদানীং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে বলে সচেতন মানুষ মনে করছেন। দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ মনে করা হলেও সর্বসাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে তার প্রতিফলন প্রশ্নাতীত হয়নি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার। সে ধারাবাহিকতায় গোমাতার মর্যাদা রক্ষার নামে মানবতাকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে; ‘জয় শ্রীরাম’কে বানানো হয়েছে জাতীয় স্লোগান। মুসলিম আমলের স্থাপনা ও সংখ্যালঘুদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে। দেশকে মুসলিমশূন্য করার জন্যই কথিত এনআরসির অপব্যবহার শুরু হয়েছে। মূলত অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সারা দেশেই সৃষ্টি করা হচ্ছে উগ্রবাদী উম্মাদনা।

সম্প্রতি বিশ্ব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের অবতারণা হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি প্রদত্ত এক রায়ে মোগল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই রায়ে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার কথা বলা হলেও তা ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, ঘোষিত রায়ে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পরিবর্তে উগ্রবাদ ও অন্ধবিশ্বাস আনুকূল্য পেয়েছে। সেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আইনের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়নি বলে সচেতন মহলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভারতের আধ্যাত্মিক নেতা ও পণ্ডিত স্বামী অগ্নিবেশের বক্তব্য থেকে। তার ভাষায়, ‘বাবরি মসজিদ-রামমন্দির ইস্যু কোনো ধর্মীয় ইস্যু নয় বরং এটি একটি হীন রাজনৈতিক ইস্যু। এমন অপরাজনীতি বন্ধ হলেই বরং দেশের সব ধর্ম, মত ও পথের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কিন্তু রাজনীতিকদের তা মোটেই পছন্দ নয়। তাদের দরকার ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ভোট বাগানো; আখের গোছানো।’

বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির বিতর্কের একজন জোরালো সাক্ষী হচ্ছেন আধ্যাত্মিক গুরু স্বামী অগ্নিবেশ। তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বলেছেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক আগমুহূর্তে বিষয়টির একটি সমঝোতার চেষ্টা হয়েছিল। প্রস্তাবে উগ্রবাদীদের জানানো হয়েছিল যে, বাবরি মসজিদের পৌনে তিন একর জমির পরিবর্তে রামমন্দির নির্মাণের জন্য তারা মসজিদের পাশেই ইচ্ছামতো ৭০ একর পর্যন্ত জমি গ্রহণ করে সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে যেতে পারেন। এই প্রস্তাবের বিপরীতে ভারতের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি বলেছিলেন, বাবরি মসজিদের মিম্বর তথা যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব খুতবা দেন ঠিক সেই জায়গায় ভগবান রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। তাই মন্দিরটা সেখানেই হতে হবে। লালজীর কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, ১৫২৮ সালে মোগল সেনাপতি মীর বাকি কি রামমন্দির ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? তুলসী দাসের ‘রাম রচিত মানস’, গুরু গোবিন্দ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও বিবেকানন্দের লেখনীর মধ্যে কোথাও সে কথার সমর্থন পাওয়া যায়? এমনকি ছত্রপতি শিবাজী মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে সারাজীবন যুদ্ধ করেই কাটিয়েছেন। তিনি কখনো বলেছেন রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ বানানো হয়েছে? এসব প্রশ্নে লালজী নিরুত্তরই থেকেছেন।

ভারতীয় রাজনীতিতে উগ্রবাদের উত্থান দেশটির রাষ্ট্রীয় চরিত্রকেই বদলে দিয়েছে। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদ। বিষয়টি শুধু বাবরি মসজিদকেন্দ্রিক নয় বরং এই উগ্রবাদী মাতমের পরিসর অনেকটাই বিস্তৃত। এসব ক্ষেত্রে আইন, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদাবিষয়ক ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ওই অঞ্চলটিকে পুরোপুরি ভারতভুক্ত করা হয়েছে।

সম্প্রতি আসামের এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ভারতীয় নাগরিক। কথিত এনআরসির সে দেশ থেকে মুসলিম বিতাড়নের পরিকল্পনা স্পষ্ট তা ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। তাদের ভাষায়, ‘এনআরসি থেকে বাদ পড়া মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। আর হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা অভিবাসী।’ তবে এ কথার স্ববিরোধিতাও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের আরেক নেতার বক্তব্য হচ্ছে, ‘এই রাজ্যে বহু অনুপ্রবেশকারী এসেছেন বাংলাদেশ থেকে।’ আসামের পর পশ্চিম বাংলায়ও এনআরসি করার জিকির শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। পশ্চিম বাংলার বিজেপি সভাপতি দিলিপ ঘোষ তো বলেই দিয়েছে, সেখানে এনআরসি হলে বাদ যাবে দুই কোটি মানুষ। আর এখানেই এনআরসির মাজেজা খুবই পরিষ্কার। তাজমহল নিয়ে উগ্রবাদী ষড়যন্ত্র দীর্ঘ দিনের। হিন্দু ইতিহাসবিদ পি এন ওক ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করা ‘তাজমহল : দ্য ট্রু স্টোরি’ গ্রন্থে এই সৌধকে ‘তেজো মহল’ ও একটি হিন্দু মন্দির দাবি করেছেন। তার মতে, সম্রাট শাহজাহান এটি দখল করে সেটিকে পরে তাজমহল নাম দিয়েছেন। উগ্রবাদীদের দাবির মুখে তাজমহলের অভ্যন্তরের ‘তাজ মসজিদ’-এ শুধু জুমাবার ছাড়া নামাজ পড়া ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেছেন ঠিক তার বিপরীত কথা। তার মতে, ‘‘....তাজমহল তৈরি হওয়ার আগে সেখানে হিন্দু শাসক জয় সিংয়ের একটি ‘হাভেলি’ ছিল। শাহজাহান এই হিন্দু শাসক জয় সিংয়ের কাছ থেকে হাভেলিটি কিনে নেন। এ নিয়ে একটি ‘ফরমান’ জারি করা হয়েছিল। সেটি এখনো আছে।’’

অবশ্য সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে বাবরি মসজিদবিষয়ক ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়, যা ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষয়রোগকে একেবারে অনিরাময়যোগ্য করে তুলেছে বলেই মনে হচ্ছে। ঘোষিত রায়ে দলিল-প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত, আইনকানুনের প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করছেন সে দেশেরই প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও আইনবিদরা।

তাহলে কোন যুক্তিতে বাবরি মসজিদের এ স্থান তুলে দেয়া হলো হিন্দুদের হাতে তা কারো কাছেই বোধগম্য হচ্ছে না।

কোনো দেশ ও জাতিসত্তা সামনের দিকে এগোতে চাইলে শাসনপ্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই ধর্ম, বর্ণ, মত, পথ নির্বিশেষ সব মানুষকে এক জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে উগ্রবাদ ও বিভাজনের রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। আর এভাবে জাতিকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে দেশটি কোন গন্তব্যে পৌঁছতে চাচ্ছে তা কারো কাছেই বোধগম্য নয়।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা নবনির্মিত ওয়ামি কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যুদ্ধবিরতির মার্কিন চেষ্টার মধ্যে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসাকর্মী নিহত অস্বস্তিতে ক্রেতারা : কমিয়ে দিতে হচ্ছে কেনাকাটা গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪৪ হাজার ছাড়াল আমরা মানুষের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে সম্মান করি

সকল