২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জনশক্তি রফতানি অভিবাসন যেন হয় নিরাপদ

জনশক্তি রফতানি অভিবাসন যেন হয় নিরাপদ - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে আসতে পেরেছে দু’টি কারণে। একটি তৈরী পোশাক শিল্পের বিকাশ, আরেকটি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। তৈরী পোশাক শিল্প এখনো এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধানতম খাত। এর পরই রয়েছে প্রবাসীদের আয়। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, জনশক্তি রফতানির বিষয়টি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন খাতে যেমন অনিয়ম, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, বিশৃঙ্খলা চলছে; তেমনি চলছে জনশক্তি রফতানিতেও। তবে এর মধ্যেও বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিক বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। তারা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে এক রকম ভালোই আছেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়েছিল। আর বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা সোয়া কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ নেই। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার বাংলাদেশী চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে।

দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে এত মানুষের কর্মসংস্থান আমরা করতে পারছি না। সে জন্যই ভাগ্যান্বেষণে বিদেশগামী হতে বাধ্য হচ্ছে অন্তত পাঁচ-ছয় লাখ তরুণ-তরুণী। তাদের বিদেশ গমন যাতে সুষ্ঠু ও নিরাপদ হয়, তা দেখাশোনার জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় রয়েছে দেশে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রী খুব সাফল্যের সাথে কাজ করতে পেরেছেন, তেমনটা বলার সুযোগ নেই। কারণ, বিদেশে আমাদের জনশক্তি রফতানি দিনে দিনে কমে এসেছে। সরকারি হিসাব মতে, ২০১৭ সালে জনশক্তি রফতানি হয়েছে সাত লাখ ৫৪ হাজার ৭৩১ জন; যা ২০১৮ সালে কমে দাঁড়ায় সাত লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন। ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১৬ হাজার ৭৭১ জন। এই হিসাব পর্যালোচনা করে বলা যায়, ২০১৯ সালে জনশক্তি রফতানি সাত লাখের নিচে নেমে আসতে পারে। জনশক্তি রফতানির হার কমে আসার প্রধান কারণ আমাদের মতে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ক্রমাগত অদক্ষতা। যেসব দেশ আমাদের দেশের জনশক্তি আমদানি করে, তাদের সাথে যথাযথ কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেই সাথে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় জনশক্তি রফতানির প্রক্রিয়াগুলো সহজ, গণমুখী এবং দালাল ও সিন্ডিকেটমুক্ত করতে পারেনি আজো।

রফতানির প্রক্রিয়ায় গলদ থাকায় অনেক সময় দালালের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়েন বাংলাদেশীরা। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের অনেককে কপর্দকশূন্য হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়। এমনকি, অনেক বাংলাদেশীকে বিদেশে জেলের ঘানি টানতে হয়। কেউ কেউ মর্মান্তিকভাবে জীবনহানির শিকার হচ্ছেন। এমনই এক উদাহরণ, সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া। সেখানে আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক কর্মী কাজ করছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই দালাল ধরে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন পথে মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন।
মালয়েশিয়া সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। সেটা তারা করেছে রফতানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কারণে। তবে তারা নামমাত্র জরিমানায় অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত আসার সুযোগ দিয়েছেন। এর আওতায় চলতি বছর ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে কেউ জরিমানা হিসেবে ৭০০ রিঙ্গিত জমা দিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন। আর কেউ যদি এর পরও মালয়েশিয়ায় থেকে যান, তাদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে মাহাথির মোহাম্মদের বর্তমান সরকার। প্রায় এক বছর হতে চলল দেশটিতে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে অচলাবস্থা চলছে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তথা আমাদের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে অব্যাহত দুর্নীতির অবসানে তেমন কিছুই করতে পারেনি। আমরা জানি, বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। কিন্তু তারা প্রশিক্ষণ নিলেই দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। আর দক্ষতা বাড়লে তাদের বেতনও অনেক বেড়ে যাবে, তখন দেশের রেমিট্যান্স বাড়বে, পরিবারগুলো সচ্ছল হয়ে উঠবে। কিন্তু সরকার এ ক্ষেত্রে যেসব প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল, বাস্তবসম্মত নয় এবং তার কোনো প্রচার-প্রচারণাও নেই। যে জন্য বিদেশ গমনেচ্ছু তরুণেরা এসব আয়োজনের কথা সেভাবে জানতেও পারেন না। তাই শিগগির এ ক্ষেত্রে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে, এমনটি আশা করা বাতুলতা।

আমরা বরং ব্যক্তি উদ্যোগে বিদেশ গমনেচ্ছুদের জন্য কিছু ‘টিপস’ দিতে পারি, যাতে তারা প্রতারণা ও হয়রানির শিকার না হন। প্রথমত, স্বল্পশিক্ষিত বা আধা শিক্ষিত যারা বিদেশ যেতে চান তাদের উচিত হবে বৃত্তিমূলক যেকোনো একটা কাজে দক্ষতা অর্জন করা। এ জন্য কোথায় কী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, সেগুলোর খোঁজখবর নিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। এরপর আপনি যে দেশে যেতে চান, সে দেশটি সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেয়ার বিষয়। অভিবাসন যেন অবশ্যই নিরাপদ হয়, সে জন্য বিদেশে যাওয়ার আগে ভালো করে জেনে নিতে হবে কিছু তথ্য। তা না হলে প্রতারণা ও বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকবেই। প্রথমত, নিশ্চিত হোন যে, আপনি সরকারের অনুমোদন পাওয়া বৈধ কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বিদেশে যাচ্ছেন। কোন দেশে যাচ্ছেন, সেখানে আপনাকে কত টাকা বেতন দেয়া হবে, খরচের সেই টাকা কত দিনে তুলতে পারবেন, এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পেলে তবেই বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিন।

আইন অনুযায়ী, সরকারিভাবে নিবন্ধন করা ছাড়া এখন কারো বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই বিদেশ যেতে হলে আপনাকে শুরুতেই ঢাকার জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) কিংবা আপনার জেলার জনশক্তি কার্যালয়ে গিয়ে নিজের নাম নিবন্ধন করতে হবে। সারা দেশের ইউনিয়ন ও নগর তথ্য সেবাকেন্দ্রেও নাম নিবন্ধন করানো যেতে পারে। ৮০ টাকা খরচ করে বিএমইটির ডাটাবেজে নাম নিবন্ধন করা যাবে। নাম নিবন্ধনের পর আপনি বৈধ যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সরকারি লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি প্রায় এক হাজার রিক্রুটিং এজেন্সি আছে, যাদের আছে প্রত্যেকের একটি করে লাইসেন্স নম্বর। www.hrexport-baira.org এ তালিকায় গিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নাম জানা যাবে।
মনে রাখবেন, কোনোভাবেই কোনো দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়া আর কেউ চাকরির জন্য বিদেশে লোক পাঠাতে পারে না। কাজেই কোনো দালালকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হবেন না।

বিদেশে যেতে কত টাকা খরচ হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই। আপনি কোন দেশে যাচ্ছেন, কী কাজে যাচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। তবে দালালদের যত বেশি এড়িয়ে চলতে পারবেন, ততই খরচ কমবে। ঢাকায় এসে সরাসরি কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি বা ‘বোয়েসেলের’ (BOESL) মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারলে খরচ কম পড়বে। তবে খরচ কত পড়বে তার চেয়েও বেশি জরুরি, আপনি কত টাকা বেতনে যাচ্ছেন সেটি জানা। একটি বিষয় মাথায় রাখুন, যত টাকা খরচ করে যাচ্ছেন, সেই টাকা যেন অন্তত তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তুলতে পারেন। আর টাকা লেনদেন অবশ্যই ব্যাংক বা রসিদের মাধ্যমে করবেন। পারলে কয়েকজন সাক্ষী রাখবেন। রসিদ না রাখতে পারলে যত টাকাই দিন না কেন, তার কোনো বৈধতা থাকে না।

১৯৯০ সাল থেকে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও বিদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন এ দেশ থেকে। নারী শ্রমিক হিসেবে যারা বিদেশে যেতে চান তাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী- ১৮ বছরের নিচে কোনো নারী চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে পারবেন না। গৃহকর্মী ও পোশাক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বয়স ২৫ বছর হতে হবে। সরকারি একমাত্র জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘বোয়েসেল’ বিনা খরচে মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সহায়তা দেয়। কাজেই কোনো প্রতিষ্ঠান বা দালাল এড়িয়ে বোয়েসেলে যান এবং সেখান থেকে সঠিকভাবে তথ্য জেনেই বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিন।

নারীদের বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নানা রকম বিপদে পড়তে হয়। কোনো কোনো দেশে গিয়ে অনেক নারী শ্রমিক চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এগুলো পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। কাজেই ঝুঁকি নেবেন না। সব কিছু জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। আপনার বিদেশ গমন নিরাপদ হোক।


আরো সংবাদ



premium cement
নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের পরিবারে শোকের মাতম এক কার্গো এলএনজি ও এক লাখ ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বলরাম পোদ্দার কারাগারে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গাজীপুর মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি আহত কুলাউড়ায় নিষিদ্ধ পলিথিন রাখায় ২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় বাড়ল দেশে পৌঁছেই যা বললেন মিজানুর রহমান আজহারী অবৈধ বিদেশীদের বৈধতা অর্জনের সময় বেঁধে দিলো সরকার ষড়যন্ত্রে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না : এলজিআরডি উপদেষ্টা ফেসবুকে ১২ দিনের পরিচয়ে প্রেম, গণধর্ষণের শিকার কিশোরী চৌগাছায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু

সকল