সুশাসনের নমুনা
- জসিম উদ্দিন
- ২৯ মে ২০১৯, ২০:৩৮
দেশে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ, এমনটি সরকারের নেতাকর্মীরা বলে বেড়াচ্ছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে উন্নয়নটাই বড়, এমন ধারণা থেকে সরকারপক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়। সেই সরকারকে জনগণের প্রতিনিধি হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমান সরকার এবার জোর দিয়েছে সুশাসনের ওপর। কেউ খারাপ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হম্বিতম্বি করছেন। এমন একটা সময় সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় করছে, যখন পুরো সমাজ রাষ্ট্রে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ থেকে দুর্নীতির সর্বব্যাপী চিত্রের কিছুটা দেখে নেয়া যেতে পারে।
দুই মাসেই ভাগ্য খুলল সংসদ সদস্যের
একটি পত্রিকা এর প্রথম পাতায় এক নির্বাচিত সংসদ সদস্যের ভাগ্য কিভাবে অলৌকিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তা লিখেছে।
সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) থেকে আসেন রেজাউল করিম। নির্বাচনী হলফনামায় তার পেশা লেখা ছিল ব্যবসা ও সাংবাদিকতা। আয়ের উৎস বলা হয়েছে কৃষি ও ব্যবসা। কৃষি খাত থেকে বছরে আসে তিন হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে বছরে আয় দুই হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে তার কাছে নগদ জমা টাকা ৩০ হাজার। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ৩০ হাজার টাকা। একটি মোটরসাইকেল আছে, তার মূল্য ৫০ হাজার টাকা।
সংসদ সদস্য হওয়ার দুই মাসের মাথায় ৩৪ লাখ টাকা দামের গাড়ি কিনেছেন তিনি। পত্রিকাটি এলাকাবাসী সূত্রে জানায়, রেজাউল করিমের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা-বুলেটিনের শাজাহানপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। পত্রিকাটির সম্পাদক জানান, শুরু থেকে রেজাউল পত্রিকাটির শাজাহানপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। মাসে তাকে এক হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেয়া হতো। এখন আর সংবাদ পাঠান না, যোগাযোগও নেই। তাই সম্মানী ভাতাও দেয়া হয় না।
পত্রিকাটি অনুসন্ধান করে জেনেছে, এই সংসদ সদস্য শাজাহানপুর এলাকার ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি কেনার টাকা নিয়েছেন। ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘শুনেছি স্থানীয় অবৈধ কিছু ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন।’ এ বিষয়ে সংসদ সদস্য পত্রিকাটিকে বলেন, ‘কোনো ইটভাটার মালিক তো পাগল হয়ে যাননি যে আমাকে টাকা দেবেন। এটি প্রপাগান্ডা।’ তিনি দাবি করেন, গাড়ি কেনার পুরো টাকা তার এক বন্ধু উপহার হিসেবে দিয়েছেন। হঠাৎ কেন উপহার দিলেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর খুশি হয়ে উপহার দিয়েছেন।’ ওই বন্ধুর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেননি। ফোন নম্বর চাইলে তা-ও দেননি।
এই সংসদ সদস্য সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সদস্য নন। জাতীয় পার্টি থেকে ভাগ্যক্রমে ফাঁকা আসন থেকে তিনি জিতে এসেছেন। এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের কিছু করার আছে কি না সেটি দেখা যেতে পারে। কারণ, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ক্ষমতাসীন দল থেকে কোনো চাপ আসবে না। সুযোগটি দুদক নিতে পারে তাদের ভাবমর্যাদার স্বার্থে।
বিয়ে না করেই যৌতুকের অভিযোগে জেলে
একটি ইংরেজি পত্রিকা খবরটি শুরু করেছে এভাবে, ‘হঠাৎ একদিন তিনি জানতে পারলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছে। যৌতুকের এক লাখ টাকা তার বাবা দিতে না পারায় স্ত্রীকে তিনি অত্যাচার করেন।’ বরিশাল কোতোয়ালি থানার পুলিশ ১৫ এপ্রিল যখন সাজ্জাদুল হককে গ্রেফতার করে, তখন তিনি আকাশ থেকে পড়েন। এরপর তাকে আট দিন জেলে থাকতে হয় এমন এক অপরাধে, যে ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।
ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল-৪ এ মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরকারী ২৬ বছরের রুনা কেরানীগঞ্জের আরশিনগরের মুজিবর রহমান ও সাহিদা বেগমের কন্যা। ঠিকানা দেয়া হয় বাসা-৫, রোড-১, ব্লক-বি। প্রতিবেদক আরশিনগর সরেজমিনে গিয়ে কমপক্ষে ৪০ জনের সাথে কথা বলেন। ব্লক-বি নামে আবাসিক এলাকা রয়েছে এমন কেউ জানাতে পারেননি। রোড-১ এ পাওয়া গেল ২০টি বাসা। রুনা নামের কেউ বসবাস করেন, এমন খবরও দিতে পারেননি কেউ।
আদালতে বিয়ে নিবন্ধন সনদ দাখিল করা হয়। তাতে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জের রুনার সাথে সাজ্জাদের বিয়ে হয় ১০ মার্চ ২০১৫ সালে। ঢাকার লালমাটিয়া মোহাম্মদপুর থেকে গোলাম কিবরিয়া নামে এক কাজী এ সনদ ইস্যু করেন। এ নামের কোনো কাজী ২০১৫ সালে এ এলাকায় কাজ করেছেন, এমন কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মামলায় রুনার আইনজীবী মো: খায়রুল আমিন। পত্রিকাটির পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ওই দিন এ ধরনের কোনো মামলা তিনি দাখিল করেননি। তিনি জানান, কেউ হয়তো নকল রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করে তার স্বাক্ষর জাল করে এ মামলা দাখিল করেছেন। তিনি রুনা নামে কাউকে চেনেন না। পত্রিকাটি এটি নিশ্চিত হতে পারেনি, কে আসলে মামলাটি দায়ের করেছেন আর তার প্রতিনিধিত্ব কে করেছেন।
২০১৫ সালে ঠিক এ ধরনের একটি ওয়ারেন্ট ইস্যু হয় তার বাবা মাসুদুল হকের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ বেবি আকতার নামে এক নারীর। যৌতুক দাবির অভিযোগ এনেছেন আদালতে। সেই যাত্রায় তার বাবা আগাম জামিন নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অপরাধীরা সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায় না। দেশে এমন ঘটনা বহু। অন্য দিকে একজন মানুষ অপরাধ করেছেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকার পরও তিনি আটক হয়ে জেল খাটছেন। বিচারব্যবস্থার এমন বড় দুর্বলতা যেখানে একজন নির্দোষ লোক বিনা অপরাধে শাস্তি পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে যারা এ অপকর্মটি করছে, তাদের টিকিটিও ছোঁয়া যাচ্ছে না। এমন অসম্ভবের দেশ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
চাকরিদাতা সাহিনুর
২০ মে একটি ইংরেজি দৈনিক চাকরিপ্রাপ্তির ওয়ানস্টপ সার্ভিসের খবর দিচ্ছে। একসময়ের রিকশাচালক সাহিনুর মিরপুর ডিওএইচএসে তার অফিস স্থাপন করে এই সুবিধা দিচ্ছেন। তিনি নিজে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আর পড়াশোনা নিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি।
তার অফিসের নাম মেহজাবিন প্রপার্টিস লিমিটেড। অফিসের ভাড়া ১৮ হাজার টাকা। আর তার অধীনস্থ কর্মচারীদের বেতন এক লাখ টাকা। প্রাইভেট ব্যংক, রাজস্ব বোর্ড, কারা অধিদফতর ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিনি নিয়োগপত্র দিয়েছেন অনেককে। এর বাইরে মেডিক্যালে ভর্তিও তিনি করিয়ে দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ২০০ চাকরিপ্রার্র্থীকে নিয়োগপত্র দিয়েছেন তিনি।
এসব চাকরিপ্রার্থীরা নির্ধারিত অফিসে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। প্রতারিত কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। পুলিশ সাহিনুরকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে, তিনি একটি ব্যাংকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ জোগাড় করেন নিজের জন্য। এই সূত্রে কিছু লোকের চাকরি জোগাড় করতে সমর্থ হন। এর কিছু দিন পর তিনি প্রতারণার ব্যবসাটি খোলেন।
তার ব্যবসার টার্গেট হচ্ছে মফস্বল এলাকার সরল বেকার যুবকেরা। এ জন্য তিনি কিছু দালাল নিয়োগ করেন উত্তরবঙ্গ ও খুলনা এলাকায়। তাদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীরা তার অফিসে পৌঁছলে তিনি তাদের ইন্টারভিউ নেন। ইন্টারভিউতে ফেল করলে তাদের কাছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দণ্ড হিসেবে আদায় করেন। তাদের আসতে বলেন কিছু দিন পর। এবার তারা পরীক্ষায় পাস করলে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলেন।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি নিয়োগপত্র তৈরি করে ডাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এসব নিয়োগপত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বাক্ষর ও সিল দেয়া হতো। দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা তিনি এ জন্য প্রতারণার মাধ্যমে আদায় করেন। এসব কথা বেরিয়ে আসে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে। আশার ব্যাপার, প্রতারককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। প্রতিদিন জাতি এ ধরনের হাজারো প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সেসব প্রতারণার শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা চুপচাপ থাকছেন। তাদের প্রতিকার পাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। এটি কি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষণ?
jjshim146@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা