২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইরানে হামলার অজুহাত খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প ও রুহানি - ছবি : সংগ্রহ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর ভয়াবহ চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। ইরানের প্রধান রফতানি পণ্য তেল যাতে কোনো দেশ কিনতে না পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ইরানের বাণিজ্য, ব্যাংক লেনদেন, জাহাজ নির্মাণ এবং তেল রফতানি একসাথে বন্ধ করে দিয়ে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চলছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ব্যাপকতর।

অবশ্য কয়েকটি দেশ ইরানের তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করবে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, তুরস্ক ও চীন। ইউরোপের প্রধান দেশগুলোও নৈতিকভাবে ইরানের পক্ষেই আছে এবং সর্বশেষ মার্কিন হুমকির প্রেক্ষাপটে ইরানের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনো প্রকাশ্য উদ্যোগ নেয়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন মধ্যযুগীয় সম্রাটের মতো ঘোষণা করেন, ইরানি নেতাদেরকে নিজে থেকে ফোন করে তার সাথে কথা বলতে হবে। তারপর দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে।’ ইরান ট্রাম্পের এই ‘রাজকীয় ফরমান’ পত্রপাঠ নাকচ করে দেয়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন আকস্মিকভাবে তেহরানের বিরুদ্ধে অব্যাহত শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেন। তিনি পারস্য উপসাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর ঘোষণা দেন। পরে সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমারুবিমান বি-৫২ মোতায়েন করা হয়।

জন বোল্টন বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো সুস্পষ্ট কারণ দেখাননি। তবে তিনি ইরান এবং বিশেষ করে ইরানের রাষ্ট্রবহির্ভূত মিত্রগোষ্ঠী ও ‘ভাড়াটে’ বাহিনীগুলোকে উদ্বেগের একমাত্র কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এই গোষ্ঠীগুলো সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও গাজাসহ বেশ কয়েকটি সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে গভীরভাবে জড়িত এবং এরা যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, ইরান সরকারের তেল ও অন্যান্য রফতানি শূন্যের কোঠায় এনে তাকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে চাইছেন ট্রাম্প। লক্ষ্য একটাই, সে দেশে সরকার বদল। ইরান এতে ভীত হওয়ার বদলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ২০১৫ সালের ছয় জাতি পরমাণু চুক্তির অংশবিশেষ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন শুরুর কথা ঘোষণা করেছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, কিছু দিন আগে আমেরিকা ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর জবাবে ইরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন বাহিনীকে ‘সন্ত্রাসী’ অভিধা দেয়। বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত, ইরাকে যে পাঁচ হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে, তারা যেকোনো সময় ইরানপন্থী ইরাকি মিলিশিয়াদের আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ রকম সামান্য কোনো ঘটনা থেকেই এ অঞ্চলে বড় রকমের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।

আসলে যুক্তরাষ্ট্র এমন চেষ্টা করে চলেছে, যাতে ইরানের ওপর হামলার একটা অজুহাত পাওয়া যায়। আর ইরানের সাথে সম্পর্কিত যেকোনো শক্তির পক্ষ থেকে মার্কিন ও তাদের মিত্রদের স্বার্থের ওপর কোনো রকম হামলা হলেই তারা অজুহাতটি পেয়ে যাবে।
সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, পারস্য উপসাগরে সৌদি আরবের একাধিক তেল ট্যাঙ্কারের ওপর হামলা হয়েছে এবং সেগুলোর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই হামলার দায় ইরানের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে বলে উল্লেখ করে ইরান এরই মধ্যে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

ইরানের ওপর যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করা ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরো কতগুলো ক্ষেত্রে গায়ের জোরে কাজ করে চলেছেন। এর মধ্যে আছে ভেনিজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা, চীনের ওপর বাণিজ্যযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া এবং উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের সিনাজুরি সফল হয়নি। ভেনিজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সরকারের পতন হয়নি। চীন তার পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ঠিক সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন পণ্যের ওপর। উত্তর কোরিয়ার সাথে সমঝোতার একটি উদ্যোগ অনেক আগেই নস্যাৎ হয়ে গেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যত্র আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের বেশির ভাগই একমত যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ট্রাম্পের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের পেছনে মূলত কাজ করছে ২০২০ সালের নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ।

২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজয়েরও আগে থেকে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে ইরানের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু গত দুই বছরের কর্মকাণ্ডে মার্কিন ভোটাররা তার ওপর হতাশ। আগামী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তাই তার এমন কিছু ইস্যু দরকার, যাতে দ্বিতীয় মেয়াদে তার বিজয় নিশ্চিত হয়। তার যুদ্ধংদেহী আচরণ সেই ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে।

তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ কিছুটা ভিন্ন। বিশেষ করে ইরানের ক্ষেত্রে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে রাজনৈতিক খেলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাফল্য সেভাবে ধরা দিচ্ছে না। ইয়েমেনে হাউছি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের বোমা হামলা কেবল বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি করতে এবং আন্তর্জাতিক নিন্দা অর্জনে সফল হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটরা সৌদি আরবকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সহায়তা ও সহযোগিতা করার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছেন। তারা এখন সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিতে চান। সিরিয়ায় অব্যাহত সঙ্ঘাত ইরানকে হুমকি দেয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হতে পারে। সিরিয়ায় চলমান দ্বন্দ্বের জন্য ওয়াশিংটন মূলত ইরানকেই দায়ী করছে। ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সিরিয়ায় ঘাঁটি তৈরি করেছে এবং মস্কো-সমর্থিত বাশার আল-আসাদের শাসনের প্রতি অনুগত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে মার্কিন-সমর্থিত বিদ্রোহীরা অব্যাহতভাবে পরাজয়ের মুখে পড়ছে।

কিন্তু এসব আঞ্চলিক রাজনীতির বাইরেও আরেকটি বড় কারণ রয়েছে ইরানকে ধ্বংস করতে চাওয়ার পেছনে। আমাদের ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মুসলিম, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো শক্তি যেন না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি ইসরাইলের সাথে একটি সুদূরপ্রসারী চুক্তি সম্পাদন করেছেন ট্রাম্প। ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ হিসেবে উল্লিখিত চুক্তিতে পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি মাত্র রাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আর গাজা ও পশ্চিম তীরের একাংশ নিয়ে এমন একটি ফিলিস্তিনি করদরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, যেটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর আওতাধীন থাকবে এবং এ জন্য ইসরাইলকে ট্যাক্স দেবে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন দেশের স্বপ্ন চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়া হবে।

এই চুক্তি যাতে ফিলিস্তিনিরা মেনে নেয় সেজন্য চাপ সৃষ্টি করছেন সৌদি যুবরাজ এবং তার মিত্রদেশগুলো। কিন্তু আল-কুদস মুক্তি ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার ইরান এই চুক্তির বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেটি ট্রাম্প, নেতানিয়াহু, সৌদি যুবরাজসহ সবাই খুব ভালো করে জানেন। সুতরাং যেকোনো উপায়ে হোক, ইরানকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরান নীতি আসলে সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত। তবে মার্কিন কংগ্রেস ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর অনুমতি দেয়নি এবং এ মুহূর্তে আরেকটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে ট্রাম্প তার মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকেও প্রত্যাশিত সাড়া পাননি। পরে আপাতত লেজ গুটিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তা কত দিনের জন্য সেটাই একন দেখার বিষয়।

আমাদের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলবে বা আন্তরিকভাবে ইরানের পাশে দাঁড়াবে- এমন কোনো শক্তি বিশ্বে নেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন- ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানি, যারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইরানের মিত্র তারা মূলত ইরানের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতিতে, অর্থনৈতিক সম্পর্কে এবং ধর্মে। সুতরাং ইরানের প্রকৃত বিপদে তারা কার্যকরভাবে সামনে এগিয়ে আসবে, এমনটা আশা করা বাহুল্যমাত্র।

মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও চাচ্ছেন, ইরান তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা চালাক। পম্পেও বলেছেন, ইরান এখন হামলার মেজাজে রয়েছে। যেকোনো সময় এই হামলা হতে পারে। যদি তারা তৃতীয় পক্ষ যেমন মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মাধ্যমেও হামলা চালায়, তাহলে আমরা তার জন্য সরাসরি ইরানের নেতৃত্বকে দায়ী করব।’ যুক্তরাষ্ট্র যে ইরানে সামরিক হামলা চালানোর অজুহাত খুঁজছে পম্পেওর বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট।
সর্বশেষ গত সোমবারও ট্রাম্প ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যুদ্ধ চাইলে ইরান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে ট্রাম্প আবার এমনও বলেছেন যে, ইরান যখন প্রস্তুত থাকবে তখনই যুক্তরাষ্ট্র ওই দেশটির সঙ্গে আলোচনায় বসবে। যুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হযেই যে ট্রাম্প এমন সুর নরম করেছেন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আর ইরান ট্রাম্পের হুমকিতে খুব ভয় পেয়েছে, এমন নয়। ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি জাতীয় পর্যায়ে সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন। যেকোনো বিজাতীয় হামলা থেকে একটি জাতির সবচেয়ে বড় রক্ষাকবজ হলো সেই জাতির নিবিড় ঐক্য ও সংহতি। এর পাশাপাশি ইরান হয়তো খুব দ্রুত পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের প্রয়াস চালাবে। শক্তির বিপরীতে শক্তিই হতে পারে ইরানের আরেকটি ব্রহ্মাস্ত্র। যারা শক্তির ভাষায় কথা বলে তাদের সাথে কথা বলার জন্য নিজের শক্তি অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। সম্ভাব্য সব ধরনের হুমকি-ধমকি এবং বিপদাশঙ্কা উপেক্ষা করে ইরান সে পথেই যাবে বলে আমাদের ধারণা।

তবে ইরানের সুবিধাজনক সময়ে ট্রাম্পের আলোচনার প্রস্তাবে হাসান রুহানি বলেছেন, এখন আলোচনার উপযুক্ত সময় নয়। মনে হয় ইরান সময় বুঝেই আলোচনার টেবিলে বসবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement