২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

লাঞ্ছনার অবসানে নতুন পরাশক্তি দরকার

লাঞ্ছনার অবসানে নতুন পরাশক্তি দরকার - ছবি : সংগ্রহ

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি আবারো বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার গোলান মালভূমির ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ভূখণ্ড ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইল সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নেয়। ১৯৮১ সালে গোলান হাইটসকে নিজের অংশ বলে ঘোষণা করে দখলদার দেশটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব তা মেনে নেয়নি।

গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন গোলানের ওপর ইসরাইলের অধিকারের স্বীকৃতির ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অর্থাৎ নেতানিয়াহুকে সামনে রেখে কাজটি করা হলো দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্পের ‘বিশেষ স্নেহের নজর আছে’ এটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।

এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হলো বলে অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন। কারণ, এর আগে বেশ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্য বহু দেশ ইসরাইলের এই দখলদারি নাকচ করে আসছিল। এই নীতিগত বিরাট বাঁকবদলের পক্ষে একটি অজুহাতও খাড়া করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বলছে, ইসরাইলে আক্রমণ চালানোর জন্য ইরান ঘাঁটি হিসেবে সিরিয়াকে ব্যবহার করছে এবং গোলান হচ্ছে সেই প্রয়াসের ‘ফ্রন্ট লাইন’। এটা ট্রাম্পের নিছক অজুহাত- তাতে সন্দেহ নেই, কারণ ইসরাইলে হামলার জন্য ইরানের আরো অনেক সুবিধাজনক ফ্রন্ট লাইন আছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ লেবানন সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ চালালে অনেক ধরনের সুবিধাও ইরান পাবে।

যা হোক, আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে এই প্রথম পরিবর্তন ঘটল না। এর আগে গত বছর ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সব রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস পূর্ব জেরুসালেমে সরিয়ে এনেছেন। নিজের দূত হিসেবে মেয়ে ও জামাতাকে পাঠিয়েছেন সেই দূতাবাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়েছেন সব সময় ‘ইসরাইলের পাশে থাকার’।

কিন্তু ট্রাম্পের সর্বশেষ ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এতে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। সেটা হলো, গোলানে ইসরাইলের দখলদারি যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল কেন অযৌক্তিক হবে? কিংবা অন্য কোনো দেশ যদি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এভাবেই কোনো প্রতিবেশীর ভূখণ্ড দখল করে নেয়, তাকে বাধা দেবেন কোন যুক্তিতে?

ট্রাম্পের এই একগুঁয়ে পদক্ষেপের কারণে এমন আশঙ্কার সৃষ্টি হলো যে, গোলানের ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এখন পশ্চিম তীরকেও ইসরাইলের অংশে পরিণত করার পথ প্রশস্ত করতে পারে।
গোলান মালভূমিতে বর্তমানে ২০ হাজার ইহুদি অবৈধভাবে বসবাস করছে। আছে ২০ হাজার স্থানীয় দ্রুজ বংশোদ্ভূত সিরীয় নাগরিকও। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ দখলদারিত্বের স্বীকৃতি দিতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে ও যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও তুরস্ক, সৌদি আরব, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ ট্রাম্পের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। সৌদি আরব বলেছে, গোলান মালভূমিতে ইসরাইলি দখলদারিত্ব মেনে নেয়ার যে উদ্যোগ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন, তা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বশান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। গোলান মালভূমি একটি আরব ভূখণ্ড এবং তা আরবের অংশ হিসেবেই থাকবে।

গোলান মালভূমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। বিবিসি বাংলার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়ার পাথুরে মালভূমি গোলানের রণকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। এই মালভূমি থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে সিরিয়ার রাজধানী শহর দামেস্ক। আর এখান থেকে দক্ষিণ সিরিয়ার একটি বড় অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। সেজন্যই সিরীয় সেনাবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার এটা এক ‘আদর্শ জায়গা’।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই ‘গোলান হাইটস’ বা গোলান মালভূমি এলাকা আর কখনোই সিরিয়াকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না। এর পর প্রথমবারের মতো গোলান হাইটসে ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন তিনি। অর্থাৎ এটি ইসরাইলের অংশ- এই বার্তা দিতে চাচ্ছেন নেতানিয়াহু।

বিবিসি জানায়, ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গোলান মালভূমির মালিকানা সংক্রান্ত সর্বশেষ ভোটাভুটি হয়েছে। সেখানে উপস্থিত ১৫৩ দেশের মধ্যে ১৫১টি দেশই এ ভূখণ্ডের মালিকানা সিরিয়ার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
শুধু ফিলিস্তিন ইস্যুতে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সব সময়ই বিশ্বের সর্বত্র মুসলিমদের স্বার্থের ওপর আঘাত হানছে এবং মুসলমানদের সাধারণ মানবিক অধিকারের বিপরীতে পর্যন্ত অবস্থান নিচ্ছে। তারা কেন মুসলমানদের তোয়াক্কা করছে না? মুসলমানরা কেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না? অধিকার আদায় তো দূরের কথা, নিজের আবাসভূমিটুকুও তারা কেন রক্ষা করতে পারছে না?

আমাদের ধারণা, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বহীনতাই এর কারণ। আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো শক্তিশালী কোনো মুসলিম পরাশক্তি যদি বিশ্ব অঙ্গনে সক্রিয় থাকত, তাহলেই কেবল মুসলমানেরা অব্যাহত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, নিপীড়ন, শোষণ-বৈষম্যময় অবমাননাকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পারত। সেজন্য চাই নতুন ও সাহসী নেতৃত্ব। কিন্তু লক্ষণীয়, মুসলিম বিশ্ব থেকে কোনো বিশ্বশক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে পাশ্চাত্য। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা অজুহাতে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হলো। তার দেশটিকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হলো। মুসলিম বিশ্ব কিছুই করতে পারেনি। লিবিয়ার গাদ্দাফিরও একই পরিণতি ঘটিয়েছে তারা। আফগানিস্তানের শোচনীয় অবস্থার কথা সবাই জানেন। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর দেশটির বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে তাও চোখের সামনে। এমনকি এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের তৈরি কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি, নৈতিকতা, বাধ্যবাধকতা কিছুই মানতে চাচ্ছে না। মিসর ও আলজেরিয়ায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ইসলামী নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন হলে সেখানে সামরিক বাহিনীকে দিয়ে তাদের সহিংস পন্থায় উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে, যাতে মুসলিম বিশ্বে কোনো ইসলামপন্থী নেতৃত্ব মাথাচাড়া দিতে না পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য।

কিন্তু মুসলিম বিশ্ব যদি ঘুরে দাঁড়াতে চায়, আর সেটা যদি তারা সত্যিকার অর্থে আন্তরিকভাবে চায়- তাহলে ইসলামের আদর্শে বিশ্বাসী নেতৃত্ব যাতে উঠে আসতে পারে, সেই পথ খুঁজে বের করতেই হবে। শুধু কিছু নামধারী মুসলমানের অথর্ব নেতৃত্ব দিয়ে সেটা সম্ভব হবে না।

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ পরাশক্তি ছিল তুরস্ক। উসমানীয় (যেটাকে পাশ্চাত্য ‘অটোমান’ বলে) শাসকদের অধীনে প্রায় অর্ধেক বিশ্ব একসময় শাসিত হতো। উসমানীয় খেলাফতের সময়েই ইউরোপের বিশাল একটি অংশ মুসলিম শাসনাধীনে আসে এবং পৃথিবীজুড়ে ইসলাম এক অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যও ছিল উসমানী খেলাফতের অধীনে। তাদের ইতিহাস ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু মুসলিম শাসকদের ইসলামবিমুখতা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই উসমানী খেলাফতের পতন ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিথুয়ানিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ৩০টি পয়েন্টে সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসমানী সেনাবাহিনী অসম বীরত্ব প্রদর্শনের পরও হেরে যায়। পরবর্তীকালে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তুরস্কের আলেমদের নেতৃত্বে বর্তমান তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এরপর ইউরোপীয় দেশগুলো খেলাফতের ব্যাপারে আপত্তি করতে থাকে এবং তাদের প্রচণ্ড চাপের মুখে পয়লা নভেম্বর, ১৯২২ সালে সর্বশেষ সুলতান ওয়াহদেদ্দিনকে তুরস্ক থেকে নির্বাসিত করা হয়। অবশেষে লুজান চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর আপত্তির মুখে ২৯ অক্টোবর দেশটিকে ‘প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করা হয় এবং এভাবে ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলমানেরা নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়ে।

উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। গোটা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য এক শ’ বছর তেমন কোনো বড় সময় নয়। বর্তমানে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ এবং আদর্শচ্যুতির কারণে মুসলমানদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পারস্পরিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় অব্যাহত সঙ্ঘাতে অনেক দেশ জড়িয়ে পড়েছে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব জোট ইরানসমর্থিত হুথি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে বেসামরিক লোকজনের ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের সমালোচনার মুখে পড়েছে সৌদি আরব। এ দিকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযানে অংশ নিচ্ছে তুরস্ক। দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে তারা। ইরানও সেই লড়াইয়ে সরকারের সাথে মিলে একটি পক্ষ। অপর দিকে, ইরাকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মূলত ইরাক যুদ্ধ, আইএসের আকস্মিক ও বেপরোয়া উত্থান ইত্যাদি কারণে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের মূল যে সমস্যা, অর্থাৎ অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্ব ও আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সেটি আপাতত ধামাচাপা পড়ে গেছে।

বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আছে কার্যত শুধু ইরান ও তুরস্ক। ২০১১ সালে ইস্তাম্বুলে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তুরস্ক ফিলিস্তিন ইস্যুটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ওই সম্মেলন আরব দেশগুলোর মধ্যে এক নতুন বিন্যাসের ভিত্তি স্থাপন করেছে। এর মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের পশ্চিমা ঐতিহ্যবাহী জোটের দুই আরব নেতা জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস রীতিমতো বিদ্রোহ করেছেন। তারা সৌদি আরব ও মিসরের চরম বিরোধিতা উপেক্ষা করে ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।

সৌদি আরব ও মিসর সম্মেলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সম্মেলনে আবদুল্লাহ ও আব্বাসের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ন্যায্য-অন্যায্য সব উপায়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বর্তমানে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে কথা বলা বা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্বসম্পন্ন দেশ আছে দু’টি- ইরান ও তুরস্ক।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, তুরস্ক একমাত্র দেশ যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারে। শান্তির জন্য তুরস্কের প্রতি বিভিন্ন দেশের আস্থা রয়েছে। আর এ কারণেই তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারে। সাম্প্রতিক জনমতের প্রতিফলন থেকে বলা যায়, এরদোগান তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।

১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পর আর কোনো নেতা এত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেননি। ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে তার ক্ষমতায় প্রথম অধিষ্ঠান। তার মেধা মনন এবং সুশাসন ২০০৩ সাল থেকে তাকে জাতীয় নেতায় পরিণত করেছে। তুরস্কের গ্রামের মানুষ, সুন্নি মুসলমান ও জাতীয়তাবাদীরা তার মূল সমর্থক। তিনি তুরস্ককে পাশ্চাত্যের গোলকধাঁধা, সাম্রাজ্যবাদের অধীনতা ও কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতার নিগড় থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন।

ইউরোপের সরকারগুলো এরদোগানের প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করে না। তারা দেশটিকে তাদের ধারণামাফিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চায়। তাদের বিশ্বাস, এরদোগানের অনুসৃত ধীর ইসলামীকরণ এক সময় তুরস্ককে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। আর সেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পাশ্চাত্যের জন্য নিশ্চয়ই বন্ধুভাবাপন্ন হবে না বলেই তাদের শঙ্কা। এ কারণেই ইউরোপ তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ দিচ্ছে না আজো। কোনো কোনো ইউরোপীয় নেতা প্রকাশ্যে বলছেন, তারা ইইউতে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের উপস্থিতি মেনে নেবেন না। এ দিকে, এরদোগান নতুন রণকৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। বিভেদ ভুলে গিয়ে এরদোগান যেভাবে রাশিয়ার দিকে এগোচ্ছেন এবং রুশ সমরাস্ত্র কিনছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার বিরাট কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া মার্কিনবিরোধী ইরানের সাথে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্ক মোটেই ভালো চোখে দেখছে না মার্কিনিরা।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে তুরস্ক। অপর দিকে, মার্কিন লকহিড এফ-৩৫ এ অত্যাধুনিক বোমারু বিমানের প্রথম চালান গ্রহণ করেছে তুরস্কের বিমানবাহিনী। এটি হচ্ছে সম্ভবত বিশ্বের সেরা যুদ্ধবিমান। এরদোগানের সরকার ১০০ টি এফ-৩৫এ বিমানের অর্ডার দিয়েছে। বিমানগুলো কিনতে শত শত কোটি ডলারের চুক্তি করেছে তুরস্ক। নিঃসন্দেহে রুশ ও মার্কিন সমরাস্ত্র তুরস্কের সামরিক ক্ষমতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। তখন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তার সক্ষমতা বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-সৌদি অক্ষের বিপরীতে ইরান-তুরস্কের যে সমীকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাতে এমন মনে করার অবকাশ আছে যে, এরদোগানের সামরিক নীতি এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জনপ্রিয় অবস্থান প্রত্যাশিত শক্তিকে প্রবল করে তুলবে।

জিএফপি (গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার) র‌্যাংকিং অনুযায়ী সামরিক শক্তিতে তুরস্কের অবস্থান অষ্টম এবং মুসলিম বিশ্বের শীর্ষে। অবশ্য তুরস্কের সামরিক ঐতিহ্য অনেক পুরনো। এক সময় বিশ্বের বড় শক্তিগুলোকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করেছে তুর্কিরা। এ ছাড়া ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেশটির এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে।

তুরস্কের নিজস্ব ডিফেন্স কোম্পানিগুলো যুদ্ধবিমান, ট্রেইনার, ড্রোন বিমান, ট্যাংক, হেলিকপ্টার, যুদ্ধজাহাজ, সাঁজোয়া যান, হালকা-ভারী অস্ত্র, মিসাইল, ডিফেন্স সিস্টেম ইত্যাদি নির্মাণ করে যেগুলো ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ডের।
সব দিক বিবেচনায় অন্তত ধারণা করা যায়, যে তুর্কি জাতির হাত ধরে মুসলমানেরা এক সময় বিশ্বের অপরাজেয় পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল, আল্লাহর অদৃশ্য ইঙ্গিতে হয়তো সেই জাতির হাত ধরেই মুসলমানেরা আবারো নতুন পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement