২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং অশান্ত কাশ্মির

-

জাতীয় ভোটার দিবসের আগের দিন গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে হয়ে গেল অনেকটা ভোটারবিহীন মেয়র নির্বাচন। বৈরী আবহাওয়ার মাঝে, সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতাপুষ্ট ভোটারা অনাগ্রহবোধ করায় এবং মেয়র পদে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায়, এ নির্বাচন আকর্ষণ হারিয়েছিল আগেই। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিলেও এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটি দৃশ্যত ‘সাজানো আনুষ্ঠানিকতা’য় পর্যবসিত হয়। বৃষ্টিবাদলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন ও ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল।

ফলে গোলযোগের সম্ভাবনাহীনতা নিশ্চিত করেছিল ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’। আলোচিত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুজনিত কারণে, ঢাকা উত্তর সিটির এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের আতিকুল ইসলাম ছাড়াও জাতীয় পার্টির প্রার্থী, প্রখ্যাত ব্যান্ডশিল্পী শাফিন আহমেদসহ কয়েকজন প্রার্থী ছিলেন মেয়র পদে। এ দিক দিয়ে তাত্ত্বিকভাবে নির্বাচনটিকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয়তো বলা চলে। তবে দেশের মূল বিরোধী দল এবং তাদের জোট আগেই এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় এটা কার্যত জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণীয় হতে পারেনি। এদিক দিয়ে এই নির্বাচন আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন।

আমার বাসার কাছেই ভোটকেন্দ্র। কাগজকলমে অনেক ভোটার। গত সংসদ নির্বাচনের দিনও এখানে শত শত মানুষের ভিড় আর লাইন দেখা গেছে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র নির্বাচনের দিন সকাল ৮টার পরে ও অনেকক্ষণ কোনো ভোটার দেখা গেল না। এরপর অফিসে চলে আসি। মেয়র নির্বাচনের তেমন তোড়জোড় আর হাঁকডাক না থাকার সুযোগে কয়েকটি বাস-মিনিবাস সকাল থেকে রাস্তায় চলতে পেরেছে। ফলে যাত্রীদের সুবিধা হয়েছে। এ অবস্থায়, রাইড শেয়ারে মোটরবাইক যারা চালান, তারা বেশি আয় করতে পারেননি। তেমন চাহিদা বাড়েনি রিকশারও। এবার মেয়র নির্বাচনের দিন ভোট দেয়ার গরজ বোধ না করে কিংবা ভোটের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে অনেকেই সকাল থেকে যথারীতি দোকানপাট চালু রেখেছিলেন।

রাজধানীর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অফিসে যাওয়া-আসার পথে কোথাও নির্বাচনী আমেজ দেখিনি। দু-এক জায়গায় ঝোলানো কিছু পোস্টার এবং ভোটারলিস্ট নিয়ে দু-চারজনকে বসে থাকতে দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এসব ‘সাজানো’ ব্যাপার, নিছক লোক দেখানো। আর ‘পাতানো’ নির্বাচনের সন্দেহ ও অভিযোগ তো আছেই। দুপুরে বাসায় ফেরার পথেও কোথাও নির্বাচনী ব্যস্ততা নজরে আসেনি। একজন নাগরিকের মন্তব্য ছিল, ‘সাবালক ভোটাররা ভোট না দিলে নাবালকদের (শিশুকিশোর) প্রক্সি দেয়ার সুবিধা হয়।’ এই ‘প্রক্সি’র মানে কী, তা বলার প্রয়োজন নেই।

এ পরিস্থিতি জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনকে বাহ্যিকভাবে প্রহসন বানালেও মূলত গণতন্ত্রের জন্য ট্র্যাজেডি। শোকাবহ, দুঃখজনক, মর্মান্তিক অথবা বেদনাদায়ক ঘটনা ট্র্যাজেডিরূপে গণ্য। আমাদের দেশে ইলেকশনের ‘ডক্টর’ আর ‘ইঞ্জিনিয়ার’রা নির্বাচন থেকে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে যে প্রহসন মঞ্চস্থ করে আসছেন, তা দেখে সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা হাসেন। তবে এ হাসি আনন্দের নয়, আফসোসের। হাসি অনেক ক্ষেত্রে বেদনার ব্যঙ্গাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হয়তো এ জন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন, ‘আমারে পাছে বুঝিতে পারো, তাইতো এতো লীলার ছল;/ বাহিরে যার হাসির ছটা, ভেতরে তার চোখের জল।’ এই অশ্রু যে কারণে, তা হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ট্র্যাজিক পরিণতি। এ ক্ষতি অপূরণীয় এবং এটা কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।

আগেই ধারণা করা গেছে, ভোটার ভোটকেন্দ্রে যান বা না যান, নির্বাচনের ফলাফলে দেখানো হবে অমুক এত হাজার বা এত লাখ ভোট পেয়েছেন। তা না হলে হয়তো নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, সরকার- কারো মানসম্মান অক্ষুণœ থাকে না। যেভাবেই হোক, বাক্সে ‘সম্মানজনক’ সংখ্যক ব্যালট থাকা চাই। সেটা আগের রাতে হোক আর পরের দিনে হোক। ‘আমার ভোট আমি দেবো’ কার্যত বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না বাধাবিপত্তির কারণে। এখন তার কারণ মূলত হতাশাজনিত অনীহা ও অনাগ্রহ। দুটোই গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থী। এ অবস্থায় তারাই অবাধে তৎপর থাকে যাদের মনের কথা হলো, ‘আপনার ভোটও আমি দেবো।’ এবার ভোট কেউ দেননি, ‘ভোট দিয়ে কী লাভ’ গোছের হতাশা থেকে। কেউ কেউ ভোট দিতে যাননি সংসদ নির্বাচনে প্রহসন (প্রতারণা+কারচুপি+সন্ত্রাস) দেখে; আর কেউবা আগেই নিশ্চিত ছিলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলই জিতবে প্রায় ফাঁকা মাঠে।’ বড় কথা হলো, বিএনপি না থাকায় ভোট জমেনি, ভোটার আসেনি।

মেয়র নির্বাচনের পর মহাজ্ঞানী মহাজনদের অমিয় বচন শোনা গেছে। একজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী নেতা ও জাঁদরেল মন্ত্রীর ভাষায়, ‘এবার ঢাকায় মেয়র নির্বাচনে বড় কোনো দল অংশ না নেয়ায় ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম।’ প্রশ্ন হলো, তা হলে কি ক্ষমতাসীন দলটিও একটি ছোট সংগঠন? সে দলটিকে এই নেতারাই বলেছেন, ‘দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’ তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থকের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র ভোট দিয়েছেন বলেই কি মন্ত্রীপ্রবর স্বীকৃতি দিলেন? আরেক নেতা উল্টাপাল্টা ও আবোলতাবোল কথার জন্য আলোচিত। তার আবিষ্কার হলো, বিরোধী দলের জনসমর্থন নেই, তাই তারা মেয়র ইলেকশনে নেই।’ বিরোধী দলের একজন প্রবীণ নেতা বলেছেন, জনগণ বিগত জাতীয় নির্বাচনের মতো এবার স্থানীয় নির্বাচনও প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘মোক্ষম’ উক্তি শুনিয়েছেন বিতর্কিত সিইসি। তার সাফ কথা, ‘পরাজিতরা বলে থাকেন- নির্বাচন ভালো হয়নি। তবে নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ এ কথা শুনে কে হাসবেন আর কে কাঁদবেন নাকি রেগে যাবেন, তা পাঠকদের নিজস্ব ব্যাপার। এটা অনস্বীকার্য, এবার সংসদ নির্বাচনকালে জাতি দেখেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন কেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে।

মেয়র নির্বাচনের পর দিনের পত্রিকা দেখলেই বোঝা যায়, নির্বাচনটা কিরূপ ছিল। একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার প্রধান ছবির ক্যাপশন ছিল, ‘মেয়র পদে উপনির্বাচনে এই ভোটকেন্দ্র সারা দিনই ছিল প্রায় ফাঁকা। অলস দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা।’ ছবিটি উত্তরার একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। নিচে লিড নিউজের শুরুতে বলা হয়, ‘আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল না। ভোটের দিনও দেখা গেল না ভোটারদের তেমন উপস্থিতি।’ পাশেই সংবাদ শিরোনাম : ‘ভোটারের অপেক্ষায় ছিল ভোটকেন্দ্র’। এদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারানোর প্রকাশ ঘটেছে এ নির্বাচনে।’ সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় ভোটারবিহীন একটি কেন্দ্রের ছবি দিয়ে হেডিং দিয়েছে, ‘নজিরবিহীন অনুপস্থিতি মেয়র ভোটে।’ যখন এটাই বাস্তবতা, তখন সিইসি ভোটারদের কম উপস্থিতির দায় ছাপালেন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এটা শুনে মনে হতে পারে, নির্বাচন কমিশনের কোনো দায় নেই; ব্যর্থতা নেই। ক্ষমতাসীন দলের দু’নম্বর নেতার মতে, ‘শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।’ এটা পড়ে একজন ঢাকাবাসী বললেন, যে ক’জন ভোট দিতে গেছেন, তারা না গেলে আরো ‘শান্তিপূর্ণ’ হতো মেয়র নির্বাচন।

কোনো কোনো সংবাদপত্রের ‘চালাকি’ (যা আসলে বাস্তবতা আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস) মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়নি। যেমন, সরকারের পছন্দনীয় একটি দৈনিক সংবাদপত্র হেডিং করেছে, ‘বড় ব্যবধানে জয় পেলেন আতিকুল’। প্রধান বিরোধী দল বা জোট অংশ নিলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে যদি এমন ফল হতো, তাহলে বলা যেত, ‘সত্যিই, বিজয়ী দল খুব জনপ্রিয়।’ পত্রিকাটি হাতেগোনা ভোটারের স্বল্পতা ধামাচাপা দিতে বলেছে, ভোটার উপস্থিতি ‘প্রত্যাশার চেয়ে কম’। তবে যে যা লিখুক বা বলুক, ঢাকার ইতিহাসে কেবল নয়, এ দেশের ইতিহাসেও এমন জনশূন্য মেয়র নির্বাচন আর হয়নি।

এহেন পরিস্থিতিতে শুক্রবার ছিল ‘জাতীয় ভোটার দিবস।’ সরকারি উদ্যোগে শোভাযাত্রা বের হয়েছে, আলোচনা সভারও আয়োজন ছিল। প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘আমি ভোটার হবো’, ‘১৮ বছর বয়স হলে ভোটার হোন’। কথা হলো, যদি ভোটই দেয়ার পরিবেশ না থাকে এবং ভোট দিতে বাধা আসে, তা হলে ভোটার হওয়ার আগ্রহ থাকবে কি? এ জন্যই একজন প্রবীণ রাজনীতিক বলেন, ‘মানুষ যেখানে তার ভোট দিতে পারে না, সেখানে ভোটার দিবস পালন করা হাস্যকর।’

কাশ্মির : বঙ্গবন্ধু : বর্তমান যুদ্ধাবস্থা
কাশ্মির শুধু আমাদের এ উপমহাদেশে অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ নয়, বিশ্বে ফিলিস্তিন ইস্যু ছাড়া এতবড় রাজনৈতিক সমস্যা আর নেই। কথা হলো, কাশ্মির ইস্যুতে বাংলাদেশ কী অবস্থান নেবে? আমরা কি ‘ভারতবান্ধব’ সরকারি নীতির কারণে দিল্লির ধামা ধারণ করব, নাকি জাতীয় স্বার্থকে নিরাপদ রাখব স্বাধীন দেশ হিসেবে যুক্তিসঙ্গত দূরত্ব বজায় রেখে? নয়া দিগন্তে সাবেক সেনাপ্রধানসহ কয়েকজন সাবেক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার অভিমত প্রসঙ্গক্রমে প্রণিধানযোগ্য।

কাশ্মির ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, বিশেষত এই সময়ে, বাংলাদেশের স্থপতি এবং আমাদের স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মর্তব্য। তার দল এখন বাংলাদেশে ক্ষমতায় এবং তার প্রিয়কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তারা মরহুম নেতার আত্মজীবনী ও রোজনামচাকে দৃশ্যত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে থাকেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২২৯ পৃষ্ঠায় কাশ্মির প্রসঙ্গে তার মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে; যা বিশেষ করে তার দল এবং সে দলের সরকারের কাশ্মিরসংক্রান্ত পলিসির ভিত্তি হওয়া উচিত। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু মুজিব পিকিং-এ (বর্তমান বেইজিং) অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে প্রেরিত প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তিনি ছাড়াও এ টিমে ছিলেন আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ। শেখ মুজিব শান্তি সম্মেলনে বক্তৃতা করেছিলেন বাংলা ভাষায়। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের মনোজ বসুও (বিখ্যাত বাঙালি লেখক) বাংলায় বক্তৃতা দেন।

শান্তি সম্মেলনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মির নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরে একটা যুক্ত বিবৃতি দেয়া হয়েছিল। তাতে ভারতের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছিলেন, গণভোটের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। এতে কাশ্মির সমস্যা সব প্রতিনিধির সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম।’

আজও এই বক্তব্য অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্ববহ। আমরা সঙ্ঘাত নয়, সংলাপের পথে সমঝোতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। সন্ত্রাস-সহিংসতা কিংবা স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অবমাননা কিছুতেই কাম্য নয়। ভারতের আবেদনে ১৯৫০ সালে কাশ্মিরে গণভোটের আয়োজন করার যে অপরিহার্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতিসঙ্ঘ, তার মাধ্যমে কাশ্মিরি জনগণের আকাক্সক্ষা অবিলম্বে প্রতিফলিত হোক। এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রধানত দিল্লির দায়িত্ব। কাশ্মিরে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ গণভোট ৬৮ বছরেও সম্পন্ন করতে পারেনি বিশ্বসংস্থা- এর চেয়ে লজ্জাকর ও গ্লানিপূর্ণ ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?

কাশ্মিরে কিছু দিন আগে অভাবনীয় হামলায় ৪০ জনের মতো ভারতীয় সিআরপিএফ (আধাসামরিক বাহিনী) সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এর পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। আজন্ম পরস্পর বৈরী দেশ দুটির সরকারপ্রধানদের হুঙ্কার-পাল্টা হুঙ্কারের সাথে সঙ্গতি রেখে উভয়ের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতির ‘সাজ সাজ রব’ গোটা উপমহাদেশেই গভীর উদ্বেগ-আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ, ভারত ও পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই রাষ্ট্র, যারা এই কাশ্মির ইস্যুতে আগেও একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এতে দুই দেশই বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে। তবে মূল ইস্যু, তথা কাশ্মির সঙ্কটের সুরাহা হয়নি বিন্দুমাত্রও।

এখন দুই দেশই পারমাণবিক বোমার অধিকারী। অতএব, যুদ্ধ লেগে গেলে তার ক্ষতি কেবল তাদের মাঝে সীমিত থাকবে না। দারিদ্র্য-দুর্নীতিকবলিত গোটা অঞ্চলেই এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শুধু দুর্ভোগ বাড়াবে। ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পরকে দেখিয়ে দেয়ার হুমকি আর ‘হাতা গোটানোর’ প্রেক্ষাপটে ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ২৬ তারিখে ভারতের এক ডজন যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র বিমানঘাঁটি থেকে উড়াল দেয়। বিমানগুলো উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মির, আজাদ কাশ্মিরের আকাশ পেরিয়ে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। এরপর দেশটির উত্তরপ্রান্তে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বালাকোট জঙ্গলে সর্বাত্মক হামলা চালায়। এলাকাটি পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমানার ৮০ কিলোমিটার ভেতরে।

এটা সেই ঐতিহাসিক বালাকোট যেখানে ১৮৩২ সালে বিখ্যাত মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ‘স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিখ-ইংরেজ যৌথবাহিনীর সাথে লড়ে শহীদ হয়েছিলেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারির প্রচণ্ড হামলায় ‘জয়শ-ই-মোহাম্মদ’ সংগঠনের কয়েকটি জঙ্গিশিবিরে এক হাজার কেজি বোমাবর্ষণ করে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার দাবি করেছে ভারত সরকার। এতে নাকি আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ যোদ্ধার মৃত্যু হয়। তবে আলজাজিরা বলেছে, ফাঁকা জায়গায় ভারত এই হামলা চালিয়েছে। এমনকি, ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বালাকোটে নিহত জঙ্গির সংখ্যা নিয়ে সন্দিহান।

এ দিনের হামলার ঘটনার ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরবিরোধী দাবি করেছে। ভারতের ভাষ্য মতে, পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান তাদের বাধা দিতে এসে ব্যর্থ হয়ে পালিয়েছে। আর পাকিস্তান বলেছে, ভারতীয় যুদ্ধ বিমানবহর ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে গেছে। পরদিনই পাকিস্তান দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং একটির পাইলট ধরা পড়েছেন। সে দিন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র কমিটির সাথে বৈঠকে বসেছিলেন। নিজেদের বিমান শত্রুর হাতে বিধ্বস্ত হোক আর বিমানচালক আটক হোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘ভারত এখন নিরাপদ হাতেই রয়েছে।’ এ দিকে আটক ভারতীয় যোদ্ধাপাইলটকে শুক্রবার ভারতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘অভিনন্দন’ নামের এই বিমান সেনা পাকিস্তানকে অভিনন্দন জানান তার সাথে চমৎকার আচরণের কারণে।


আরো সংবাদ



premium cement