২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নির্বাচন তো হলো, জনগণ কী পেল?

-

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দু’বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দীর্ঘ দিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্যাংককের হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দলের একজন শীর্ষনেতা ও বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী এবং মর্মান্তিক জেলহত্যাকাণ্ডের অন্যতম শিকার মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে তার পরিচয় একসময় ছিল অনেকটা দলীয় বলয়ে সীমিত। তবে ‘১/১১’-এর পরে দলের একজন শীর্ষনেতা হিসেবে দলনেত্রীর সপক্ষে দৃঢ়ভূমিকা পালনের সুবাদে আশরাফ জাতীয় রাজনীতিতে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।

তার অত্যন্ত মারাত্মক অসুস্থাবস্থা সত্ত্বেও এবার সংসদ নির্বাচনে তাকে নৌকা মার্কার প্রার্থী করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী চেয়েছেন, তার আসনটি যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। এমনকি বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে আমি নিজে আশরাফুল ইসলামের পক্ষে প্রচারকাজ চালাব।’ আশরাফ এবারো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বৃহস্পতিবার অন্যদের সাথে তিনি শপথ নিতে পারেননি বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায়। পরে শপথের জন্য স্পিকারকে চিঠি দেয়া হয়েছিল তার পক্ষ থেকে। সে দিন রাতেই তিনি চিরবিদায় গ্রহণ করেন। আমরা তার মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিজনের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো ভদ্র ও বিনয়ী রাজনীতিকের মৃত্যুতে পরপর তৃতীয় দফায় সরকার গঠনে ব্যস্ত, আওয়ামী লীগের সবার মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে স্বাভাবিকভাবে। এর পাশাপাশি, ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের আজগুবি কাজকারবার এবং অবিশ্বাস্য ফলাফল, তথা শোচনীয় বিপর্যয় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বিরোধী দলের সব নেতাকর্মী-সমর্থককে নিদারুণ বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে, যা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বহুল প্রত্যাশিত এ নির্বাচনের দিকে শুধু দেশবাসী ও জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনই নয়, আন্তর্জাতিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থাগুলোও অধীর আগ্রহে নজর রেখেছিল। কার্যত একতরফা ও নিয়ন্ত্রিত এই নির্বাচনের ঘোষিত ফল দেখে তারা বিস্মিত এবং অনেকেই বিক্ষুব্ধ। অবশ্য কূটনীতির সৌজন্যবশত তাদের অনেকের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে বিজয়ীদের। সরকারি প্রচারযন্ত্র এটাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরার পরও নির্বাচনে যে ব্যাপক অনিয়মের সচিত্র সংবাদ মিডিয়ায় এসেছে, তা অনপনেয় কলঙ্ক হিসেবে থেকে যাবে।

বিরোধী জোটের দাবি মোতাবেক, এ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল কিংবা পুনঃনির্বাচন না হোক, দেশের সচেতন ও গণতন্ত্রকামী নাগরিকরূপে আমাদের প্রত্যাশা- বিজয়ী দল ও জোট এবং নতুন সরকারসহ ক্ষমতাসীন মহলের সবাই দেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করে, জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে নিষ্ঠা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখবেন। তারা যদি বিশেষ করে নির্বাচনী অঙ্গীকার বিস্মৃত হয়ে আগের মতো অবাঞ্ছিত ভূমিকা রাখতে থাকেন, তাহলে যত শিগগির ‘দেয়ালের লিখন’ পাঠ করা হবে, ততই মঙ্গলজনক।

ত্রিশ তারিখের অভিজ্ঞতা
ভোটের দিনেও অফিস করতে হবে বলে সকালে একেবারে শুরুতেই নিজের ভোটটা দিয়ে সুদূর মতিঝিলের উদ্দেশে যাত্রা করব। এটা মনস্থ করেছিলাম আগেই। ভোটকেন্দ্র বাসার কাছে। অতএব, শীতসকালে ভিড় জমার আগেই অল্পসময়ে সহজেই ভোটটা দিতে পারব ভেবেছিলাম। ৮টায় ভোট দেয়া শুরু। এর কিছুক্ষণ আগেই একজন খবর দিলো ভোটারদের লম্বা লাইনের। শীতের মধ্যেও মানুষের ভোট দেয়ার এত আগ্রহ তাদের সচেতনতার ইঙ্গিত দেয়। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম ভোটকেন্দ্রের উদ্দেশে।

গেটে পৌঁছার আগেই দেখি, পাড়ার পরিচিত কেউ কেউ শুরুতেই ভোট দিয়ে ফিরে আসছেন। রাস্তায় জটলা ও হইচই। পাশের দোকানগুলোতে চা-পান-সিগারেটসেবীদের ভিড়। ভোটকেন্দ্রের গেটের বাইরে একটা ভবনের গায়ে ভোটারদের সুবিধার্থে কেন্দ্র ও বুথের উল্লেখ করা কাগজ সেঁটে দেয়া হয়েছে। ভোটার তার সিরিয়াল নম্বর দেখে সহজেই যাতে ভোট দিতে পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। তবে জানতাম না যে, অনেকেই এবার ভোটার স্লিপ পাননি কোনো প্রার্থীর লোকজন থেকে। তাহলে তারা কী করে জানবেন, তাদের কার ভোটার নম্বর কত? আমাদের বাসায় ভোটের আগের দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা ছাপানো ভোটার স্লিপ দিয়ে গেছেন। এমনকি, ভোটার যে হয়নি বা হতে পারেনি, ভোটার তালিকায় তার নাম ওঠার ব্যবস্থা করেছেন তারাই।

বোঝা গেল, দলটি ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট এবং ভোটার বানানোর কাজে কত বেশি মনোযোগী ও পারদর্শী। অবশ্য তাদের প্রতিপক্ষ যেভাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হামলা-মামলায় ‘দৌড়ের ওপর’ ছিলেন, তারা ভোটারের সাথে যোগাযোগ করা দূরের কথা, ‘ইয়া নাফসি’, ‘ইয়া নাফসি’ করেও কূল পাননি। আরো লক্ষ করার বিষয়, এত দিন দলের ইশতেহার বা নির্বাচনী অঙ্গীকারকে নির্বাচনের সময় সবচেয়ে কম দাম দিয়ে আসছিলেন প্রার্থীরা। এবার দাম সবচেয়ে বেশি পড়ে গেছে খোদ ভোটারের। এ জন্যই বিভিন্ন আসনে ভোটার স্লিপ পৌঁছানোর গরজ/সৌজন্যও আর দেখানো দরকার মনে করা হচ্ছে না।

ভোটকেন্দ্রে ঢোকার পথে দেখলাম, নৌকা মার্কার লোকজন বুকে প্রতীক লাগিয়ে বীরের বেশে হাঁটাহাঁটি করছেন। তবে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ প্রতীকের কোনো নামগন্ধও টের পেলাম না। নির্ধারিত কেন্দ্র ও বুথের দিকনির্দেশনা মোতাবেক নির্দিষ্ট জায়গায় লাইনে দাঁড়ালাম। সে অনুযায়ী একটা বড় বিল্ডিংয়ের চারতলা, তেতলা, এরপর দোতলায় গেলাম। কিন্তু আমার বুথের খোঁজ পাওয়া গেল না। একাধিকবার জিজ্ঞেস করলাম ডিউটিরত পুলিশদের। তাদের কেউ বলেন, ‘এ দিকে যান’; কেউ বলেন, ‘না, এই কেন্দ্র না, ওদিকে দেখুন।’ বেশ কিছুক্ষণ কেবল বিভিন্ন তলার ওপর-নিচ করলাম বুথের নির্দিষ্ট রুমের সন্ধানে। পুলিশ হদিস দিতে না পেরে হতাশ। এর মধ্যে একটা রুমে ঢুকলাম, তালিকায় আমার ভোটার নম্বরের মিল দেখে। সেখানে দায়িত্বরত মহিলা তার সামনে রাখা ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার এক জায়গা হাত দিয়ে ঢেকে রেখে কুইজের কায়দায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন তো, আপনার বাবার নাম কী?’ বললাম যথারীতি।

শুনে তিনি বললেন, ‘না, তালিকায় এই নাম্বারের ভোটারের সাথে মিল নেই।’ অতএব, ফিরে এলাম সেখান থেকে। এত হয়রান হতে হলো, তাই ভোটই দেবো না ভাবছিলাম। এমন সময় সঠিক বুথের খোঁজ পেয়ে দীর্ঘ ভবনটির অন্য অংশে দোতলায় উঠলাম। মনে হলো, সেখানে আমিই পয়লা ভোটার। যিনি আঙুলে কালি লাগাবেন, তিনি কিছুক্ষণ ধরে নখের পাশে এমনভাবে কালো রঙ লাগালেন যেন, তুলি বুলিয়ে ছবি আঁকছেন। লম্বা এক ব্যালট নিয়ে পর্দাঘেরা জায়গায় ঢুকলাম। সেটা ভাঁজ করতে গিয়ে টের পেলাম, অনেকে তাড়াহুড়ো করে কিংবা সঠিক নিয়ম না মেনে ব্যালট পেপার আড়াআড়ি ভাঁজ করবেন। এতে সেটি নষ্ট হয়ে যাবে এবং যথাসময়ে বাতিল বলে গণ্য হবে। ব্যালটই নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। এটা কিভাবে কত ভাঁজ দিতে হবে, তার সচিত্র প্রচারণা প্রয়োজন ছিল।

বাসায় ফিরে এবার অফিসের পথ ধরলাম। বের হতে না হতেই রাস্তায় মানুষের ভিড়ের মধ্যে একের পর এক কয়েকটা দামি গাড়ির বহর এসে থামল। নামলেন সে আসনে ক্ষমতাসীন দলের বিত্তবান প্রার্থী। তিনি আগে থেকেই এমপি। একসময় রাজনৈতিক তৎপরতা থাকলেও অসুস্থতার দরুন এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। এবার ইলেকশনে তার নমিনেশনের খবরে দলের ভেতর ও বাইরের অনেকে অবাক হয়েছেন। অপর দিকে, যারা মনোনয়ন প্রার্থী হয়ে বছরের পর বছর তৎপর ছিলেন, তারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী একেকটা উপদলের সমর্থনপুষ্ট। এ অবস্থায় দলের ঐক্য বজায় রেখে প্রার্থীকে জেতানোর জন্য সেই এমপিকেই আবার দাঁড় করানো হলো।

যা হোক, নির্বাচনের দিন সকালে এই এমপি পদপ্রার্থীর গাড়িবহর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অত্যাধুনিক এই গাড়িগুলোর পেছনে নির্বাচন কমিশনের স্টিকার লাগানো গাড়ি দেখা গেছে। কমিশন ভালো করেই জানে, নির্বাচনের দিন কোনো কোনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। তবুও সুযোগ পেলেই কিছু যান রাস্তায় নামতে দেখা যায়।

কয়েকটা নির্বাচনী আসনের এলাকা হেঁটে কিংবা রিকশায় পার হয়ে সে দিন গন্তব্যে পৌঁছি। পথে পথে নির্বাচনের তোড়জোড় দেখা গেলেও কোথাও ধানের শীষের কোনো প্রচারণা ও তৎপরতা চোখে পড়েনি। এমনকি একটা পোস্টার বা ব্যানারও না। তবে হাতপাখা ও বাঘসহ কয়েকটি প্রতীকের প্রার্থীর লোকজন অবাধে তৎপরতা চালাতে পেরেছেন।

দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে শীতের মিঠে রোদে অনেকদূর হেঁটে পৌঁছলাম সেগুনবাগিচা। শিল্পকলা একাডেমির ভোটকেন্দ্রের বাইরে তখন বহু মহিলা তাদের ভোটার নম্বর খুঁজছেন। পরে একপর্যায়ে, ফার্মগেটে রিকশা থেকে নেমে একটা নির্বাচনী ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখা গেল, নেতাকর্মীরা বিরিয়ানির প্যাকেটের সদ্ব্যবহার করছেন। কারো কারো মুখে মুরগির রান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সে দিন রাজধানীর কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রের বাইরের রাস্তা দিয়ে সেনা-র‌্যাব-বিজিবির গাড়ি সারি বেঁধে টহল দিতে দেখা গেছে। তবে কেন্দ্রের ভেতরে কী ঘটছে, তা ঠাহর করা তাদের পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। ঊষবপঃরড়হ ঊহমরহববৎ ও উড়পঃড়ৎ যারা, তারা দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই বুথের ভেতরে ত্বরিতবেগে যথেচ্ছ সিল মারা কিংবা বাক্সে ব্যালট ঠেসে দেয়ার কাজ সারিয়ে ফেলেন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না এসব অপকর্ম। কারো এমন বুকের পাটা নেই যে, ক্যাডারদের নামে কোনো কর্মকর্তা কিংবা বাহিনীর কাছে নালিশ করে।

মাহাথির ও মালয়েশিয়া সিনড্রোম
পরপর তিনবার জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রায় সময় বলে থাকেন, তাদের সরকার বাংলাদেশকে মালয়েশিয়ার মতো উন্নত করে তুলবে এবং তারা দলের নেত্রীকে ‘বাংলাদেশের মাহাথির’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। সম্প্রতি সে দেশে ডা: মাহাথির মোহাম্মদের (৯৩) নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। পতন ঘটেছে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের কাণ্ডারি দল ‘আমনো’র নেতৃত্বাধীন সরকারের। জাতীয়তাবাদী দলটি দেশের স্বাধীনতার পর থেকে একনাগাড়ে ৬০ বছর ক্ষমতাসীন ছিল। তবে জনগণ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়ে মাহাথিরকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে। তার জোটের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব (যিনি অদূরভবিষ্যতে সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের কথা) ও প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইবরাহিম ‘কিভাবে গণতন্ত্রের বিজয় ঘটে’ শীর্ষক নিবন্ধ লিখেছেন। ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে এটি প্রকাশিত হয়েছে এবার নববর্ষের প্রথম দিবসে।

আনোয়ার ইবরাহিম বলেছেন, সংলাপ এবং বহুত্ববাদের শক্তি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাকে আশাবাদী করে তুলেছে। তার দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলের বিরুদ্ধে প্রদত্ত, সাম্প্রতিক গণরায়ের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সমাজ উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে সরকার প্রচণ্ড ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল। ওই দলের শাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ‘নির্বাচনী সামন্তবাদ’। ভোটারদের একটা বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের সাথে। ওই সরকারের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বেপরোয়া দুর্নীতি, যা উন্নয়নের সুফলকে করে দিয়েছিল ম্লান।

মাহাথিরের নেতৃত্বে নির্বাচনে প্রত্যাশিত বিজয় অর্জন করায় এখন কুয়ালালামপুরে সরকার পরিচালনা করছে পাকাতান হারাপান জোট। এর প্রভাবশালী শরিক পার্টি কিয়াদিলান রাকইয়াতের প্রধান হলেন আনোয়ার ইবরাহিম। তিনি বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘নতুন জোট সরকার সংস্কার আনতে ওয়াদাবদ্ধ। এর মাধ্যমে পরিপক্ব, ন্যায়ভিত্তিক, ইনসাফকেন্দ্রিক ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের কর্মসূচির একটি বিষয় হলো, দুর্নীতির অবসান ঘটানো। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন এবং মুক্ত মিডিয়া, সেই সাথে সক্রিয় সিভিল সোসাইটি থাকা আবশ্যক। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা এবং সম্পদ ও পরিষেবার সুষম বণ্টনের স্বার্থেই এগুলো দরকার। গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার আরেকটি দিক হলো- সম্প্রদায়গত সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে, মালয়েশিয়ার সব মানুষের জন্য মেধাভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য ব্যবস্থা কায়েম করা।’

এগুলো শুধু মালয়েশিয়ার একনেতার কথা নয়, যেকোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের যারাই সুশাসন ও মানবিক সমাজ চান, তাদের অনুভূতি ও ভাবনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। কথা হলো, যারা বাংলাদেশে মাহাথির মোহাম্মদের মতো আরেক নেতা বা নেত্রীর নেতৃত্বে এ দেশকে মালয়েশিয়ার মতো উন্নত করতে চান, তারা কি শুধু উন্নয়ন চাচ্ছেন, নাকি একই সাথে গণতন্ত্র তথা আইনের শাসনও কামনা করেন? তারা কি কেবল জাতীয় সম্পদ, তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট মনে করেন, নাকি সম্পদের ন্যায্য বণ্টন, সমাজে ইনসাফ কায়েম করা এবং শোষণ-বৈষম্যের অবসানও তাদের কাম্য?

চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ
‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।’ যারা নির্বাচনী বিজয়ের হ্যাটট্রিক করেছেন, সে দল তাদের পরপর তৃতীয় মেয়াদে জনস্বার্থের নিরিখে আগের চেয়ে উন্নত পন্থায় ও প্রশংসনীয়ভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারলে দেশ ও জাতির কল্যাণ নিশ্চিত হবে। অন্যথায়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই। এ দেশে সাধারণত যারা দ্বিতীয় মেয়াদে একই পদে নিযুক্ত হন, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেজেগোবরে অবস্থায় বিদায় নেন। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। সাধারণত দীর্ঘ দিন একই কাজে নিয়োজিত থাকলে বাড়ে অভিজ্ঞতা, যার সুফল হিসেবে দেখা যায় প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। আবার অনেকে অতিআত্মবিশ্বাস বা বেপরোয়া মনোভাব থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেন।

বিশেষ করে যখন কোনো দল প্রায় একচেটিয়া জয় পেয়ে যায় এবং সংসদে থাকে না কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল আর রাজপথে থাকে না বিরোধী দলের জোরালো আন্দোলন, তখন সরকারের মনে করা উচিত নয় যে, বিভিন্ন বাহিনী নামিয়ে ডাণ্ডা দিয়ে সব ঠাণ্ডা করে, আমলাদের মাধ্যমে দেশ চালানো যাবে নির্বিঘেœ। এভাবে চললে দৃশ্যত সব ঠিকঠাক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে দায়িত্ববোধের ঘাটতি বেড়ে যায়, দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে আর অনিয়ম বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। তখন দল, সরকার আর রাষ্ট্র একাকার হয়ে সবগুলোই দুর্বল হতে থাকে। এ অবস্থা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক কামনা করতে পারে না। তাই নতুন সরকারকে এসব ব্যাপারে সতর্ক থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিমাফিক একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সার্বিক প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। এ নির্বাচনই শেষ নয় এবং এ সরকারই শেষ সরকার নয়। এটা ভুলে আত্মপ্রসাদে ডুবে থাকলে তা বুমেরাং হতে পারে।

দেশবাসী এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উন্মুখ ছিল। একই সাথে ছিল সন্দিহানও। নির্বাচন আসলেই কি হবে? হলেও, তা কি নির্ধারিত সময়ে হতে পারবে? নির্বাচন না হলে দেশে কী ঘটতে পারে? বিএনপিসহ ২০ দল কি নির্বাচনে অংশ নেবে? যদি নির্বাচন যথাসময়ে হয়, ভোটাররা কি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, বিনা হুমকিতে অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সক্ষম হবে? আর বিএনপি জোট নির্বাচনে এলে তারা কি হামলা-মামলার শিকার হতে থাকবে, নাকি বিনাবাধায় প্রচারণা চালাতে পারবে? এসব প্রশ্নের জবাব ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষ। পত্রিকায় সবাই দেখেছেন, কেউ কোনোমতে ভোট দিয়েছেন, কেউ দিতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন আর কেউবা ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাননি। মোট কথা, পরিবেশ অনেকটাই ছিল অনিরাপদ। প্রচারণার মতো ভোটাভুটিও প্রায় একতরফা দেখা গেছে। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পরিণতি হয় নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। তাই ২০১৯ সাল কেমন যাবে, জনগণের ভাগ্যে কী ঘটবে, ক্ষমতাসীনেরা সাধারণ মানুষকে এখন বেশি পরোয়া করবেন, নাকি অনেক নেতাকর্মী-সমর্থক আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবেন? এসব ব্যাপারে ভবিষ্যৎই বলতে পারে। মানুষ এত আশঙ্কার মধ্যেও আশাবাদী হতে চায়। কারণ, ‘আশা কুহকিনী’ জেনেও মানুষকে সে ‘আশায় বসতি’ গড়তে হয়। যদি সরকার ও জাতীয় নেতৃত্ব জনগণকে হতাশ করে, তারা যাবেন কোথায়?

পাঁচ বছর পরপর যে নির্বাচন হওয়ার কথা, গণতন্ত্র নির্বাসনে যাক বা না যাক, সে নির্বাচন যেনতেনভাবে হলেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্ধারিত সময়ে। এবারের নির্বাচন সম্পর্কেও গানের সুরে বলা যায় না, ‘আসি আসি করেও সে যে কেন এলো না।’ নির্বাচন এসেছিল; চলেও গেছে। কিন্তু জনগণ পেয়েছে কিংবা পাবে কী?

যারা জিতেছেন ক্ষমতার বলয়ে থেকে, তাদের কেউ মন্ত্রী, কেউ ‘যন্ত্রী’ হবেন। নানান কোটা ও কমিটি আছে; বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধার সমাহার ও সমন্বয় ঘটবে। কিন্তু যারা ভোটার, সেই গণমানুষেরা- মেহনতি জনগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবীরা কী পাচ্ছেন? নির্বাচন উপলক্ষে এক দিনের সালাম-কালাম ও কোলাকুলিই কি যথেষ্ট? বলা যায়, তারা পেলেন বহু প্রতিশ্রুতি আর রঙিন কথার ফুলঝুরি। আমরা কি গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার এখনকার সরকার থেকে আশা করতে পারি না যে, তারা নির্বাচনী ওয়াদাগুলো পূরণে কোনো ত্রুটি রাখবেন না। সেটাই যে বঞ্চিত জনগণের পরম পাওয়া।


আরো সংবাদ



premium cement