প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, না প্রহসনের নির্বাচন !
- আলফাজ আনাম
- ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:২৩
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না তা নিয়ে যে সংশয় ছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপে কোনো ফল আসেনি। ‘শূন্য হাতে’ বিরোধী জোটকে নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে। জোটের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি দেয়া হয়েছিল; কোনোটিই মেনে নেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী জোটের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল- হয় নির্বাচন বর্জন করা কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া। দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
বলা যায়, নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। জোট গঠনের আগেই অবশ্য বিএনপি ও অন্যান্য দলের নেতারা বলেছিলেন, নির্বাচন বর্জনের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে একতরফা নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হবে না। ফলে সরকার ছিল অনড় অবস্থানে। অপর দিকে বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন না করে নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে যাচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে আন্দোলনের এই কৌশল কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।
অতীতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। এরপর ‘এক-এগারো’র ঘটনা ঘটে। বিরোধী দল যদি নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ না পায় কিংবা নাগরিকদের ভোট দেয়ার সুযোগ বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে সে নির্বাচন কোনোভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনের মাঠে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এর আগে এ কারণে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ক্ষমতাসীন দলের সাজানো প্রশাসন ও পরিকল্পনার মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন মডেলে হবে, তা নিয়ে এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা চলছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশ নেয়ার পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হচ্ছে না, তা এখন নিশ্চিত। আওয়ামী লীগ দাবি করে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল বলে তখন একতরফা নির্বাচন করতে হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সে সময় ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৭টিই নির্বাচন বর্জন করেছিল।
কেউ হয়তো এবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। কিন্তু নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কি না, হলেও তা সহিংসতায় রূপ নেবে কি না- সেসব প্রশ্ন এখন মানুষের মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন ধরনের নির্বাচনের মডেল আবিষ্কার করেছে, যেখানে ভোটকেন্দ্রগুলো বাইরে থেকে ছিল সম্পূর্ণ ‘শান্তিপূর্ণ’, কিন্তু ভেতরে বিরোধী দলের কোনো এজেন্ট ছিলেন না। ফলে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ট, পুলিশ ও আনসার মিলে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ ব্যালট বাক্স ভরার দায়িত্ব সেরেছে। এমন কৌশল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অনুসরণ করা হতে পারে। তার আলামত এখন স্পষ্ট।
বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বারবার বলছেন, ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে হবে, যাতে আগের নির্বাচনের মতো কৌশলে কেন্দ্র দখলের মতো ঘটনা না ঘটে। এমনকি কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও সারা দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
তাদের নামে নতুন করে মামলা দেয়া হয়েছে। আগে থেকেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ৯৩ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ধরনের একটি মামলার তালিকা সংলাপের সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। এই তালিকা ধরে কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সংলাপ শেষ হওয়ার ১০ দিনের মধ্যে ২০ জেলায় অন্তত ১০০টি নতুন মামলা হয়েছে। ‘গায়েবি’ এসব মামলায় ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। এসব রাজনৈতিক মামলার আসামিরা আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন নতুন করে যেভাবে ধরপাকড় শুরু হয়েছে, তাতে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ভয় পাচ্ছেন। এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কিংবা গ্রেফতার করে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী নিজে সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিরোধী দলের দাবিগুলো নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু তার ওপর আস্থা রাখার মতো এখন পর্যন্ত কোনো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। বরং নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ধরপাকড় ঘিরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ততই বাড়তে পারে। ঐক্যফ্রন্টের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচন কমিশনকে কিছুটা হলেও নিরপেক্ষ ভূমিকায় নিয়ে আসা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন এখন নির্বাচন কমিশনের অধীন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের কোনো নির্দেশ দেয়া হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা বলে- নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার বাইরে স্বাধীন কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না।
এবারের নির্বাচনে নানা মাত্রায় যে ক্ষমতার দাপট শুরু হবে, তা মোকাবেলার মতো শক্তি নির্বাচন কমিশনের নেই। ফলে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশনকে বড় ধরনের জটিলতায় পড়তে হতে পারে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য নানা উপায়ে এমপিরা তাদের ক্ষমতা দেখাবেন। আবার যেসব এমপি ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাবেন না, তারাও এমপি থাকবেন। তারা কিভাবে নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে মোকাবেলা করেন, তা দেখার বিষয়। ক্ষমতাসীন দল এখন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মাঝে এমন বার্তা দিতে পেরেছে যে, নির্বাচনে তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। ফলে ক্ষমতাসীন দলের টিকিট পেলে এমপি হওয়া যাবে, এমন প্রত্যাশা এখন বহু সমর্থকের মধ্যে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র কেনার হিড়িক থেকে তা বোঝা যায়। আসনপ্রতি মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১৬ থেকে ১৭ জনে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলের মধ্যে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও প্রতিটি আসনে নানা পেশা ও মতের মানুষের মনোনয়নপত্র কেনার হিড়িক পড়েছে। অনেকটা লটারির মতো ‘যদি লাইগ্যা যায়’ অবস্থা।
নায়িকা, গায়িকা, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে এক-এগারোর ক্ষমতাধর জেনারেলও মনোনয়নপত্র কিনেছেন। কেউ নবীন অবস্থায় সংসদে আসতে চান, আবার কেউ বুড়ো বয়সে শেষ আশা পূরণ করতে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন; যদি তিনি আশা পূরণ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তো সবার আশা পূরণ করা সম্ভব হবে না। কেউ ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যাবেন; আবার কেউ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা করবেন। ফলে সহিংসতা যে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের প্রার্থীদের মধ্যে হবে এমন নয়; ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও তা হবে। ইতোমধ্যে রাজধানীতে দুই মনোনয়নপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দু’জন মারা গেছেন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এমন খবর বাড়তে থাকবে।
নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে গৃহদাহ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে ঐক্যফ্রন্ট ভোটের রাজনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা নিতে পারে। এ জন্য দরকার জনগণকে ভোটের মাঠে নামানো। ভোটারের উপস্থিতি যত বাড়বে, বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের কৌশল হবে ভয়ভীতির মাধ্যমে ভোটার উপস্থিতি কমানো। একই সাথে ভোটকেন্দ্রে একাধিক এজেন্ট দেয়া বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ হবে। বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের দৃঢ় মনোবল ছাড়া নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন। কারণ, নির্বাচনের আগে শুধু পুলিশ নয়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকেও হুমকির মুখে পড়তে হবে, যাতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে তারা সক্রিয় হতে না পারেন।
ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়নি। কোনো নির্বাচনে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ বা পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে সে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বহুবার প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শুধু শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিল।
সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তিনি নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। এটাও ছিল আরেক প্রহসন। এই সুযোগ নিয়ে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট ছাড়া এমপি হয়েছেন। ভোট ছাড়া এমপি হওয়ার এই আকাক্সক্ষা ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এখন আগামী নির্বাচন আরেকটি প্রহসন হবে কি না, তা নির্ভর করছে আসলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কি না, তার ওপর। সেই পরিবেশ নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
alfazanambd@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা