২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্মৃতি থেকে শিক্ষা

স্মৃতি থেকে শিক্ষা - ছবি : নয়া দিগন্ত

আজকের কলামটি কিছুটা স্মৃতিচারণমূলক। কেন যেন মনে হলো, জীবনের অনেক ঘটনা শিক্ষামূলক। অনেক ক্ষেত্রে আমি নিজে বা পরিবার চেয়েছি এক রকম, মহান আল্লাহ করে দিয়েছেন আরেক রকম। ছাত্রাবস্থায় এটা ঘটেছে, সেনাবাহিনীর চাকরি জীবনেও ঘটেছে এবং অবসর জীবনের বিগত ২২ বছরেও ঘটেছে। আজ মনে করলাম, এ রকম কিছু ছোট ঘটনার স্মৃতিচারণ করি। সেখান থেকে কোনো-না-কোনো উপসংহার বের হয়ে আসতে পারে।

এইচএসসির রেজাল্ট এবং আব্বার ইচ্ছা
১৯৬৮ সালে এইচএসসি পাস করেছিলাম চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে, কুমিল্লা বোর্ডে মানবিক বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে। যে দিন রেজাল্ট বের হয়েছিল, সে দিন আব্বা খুশি হয়ে আমাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরের মাদারবাড়িতে একটি খানকায়। সেখানে ছিলেন তখনকার আমলের সুপরিচিত শ্রদ্ধাভাজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হজরত মীর মুহাম্মদ আখতার (রহ:)। তিনি বায়তুশ শরফ নামক বিখ্যাত আধ্যাত্মিক, শিক্ষামূলক ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। বায়তুশ শরফ আর ওখানে নেই, এখন চট্টগ্রাম মহানগর দেওয়ানহাট মোড় ও কদমতলীর মাঝামাঝি ধনিয়ালাপাড়ায় অবস্থিত একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। আমার আব্বা (বর্তমানে মরহুম) এস এম হাফেজ আহমেদ, মরহুম আখতার (রহ:)-এর মুরিদ বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার ছাত্র ছিলেন। হজরত মীর মুহাম্মদ আখতার (রহ:) ১৯ বছর বয়সী ইবরাহিমকে কাছে ডেকে আদর এবং আব্বাকে সাথে নিয়ে দোয়া করেছিলেন। দোয়ার ভাষা অনেকাংশেই মনে আছে; কিন্তু আজকে তা লিখছি না।

রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল বিধায় আব্বা ইচ্ছা করেছিলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অভিজাত আমলাতন্ত্রের সদস্য হই; অর্থাৎ পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হই। এই কলামের তরুণ পাঠক যারা, তাদের জন্যই ব্যাখ্যা দিচ্ছি যে, সেকালে কেন্দ্রীয় অভিজাত চাকরিগুলোকে বলা হতো সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস এবং এর আওতায় ক্রমিক নম্বর ১-এর জন্য যে চাকরি ছিল, সেটিকে বলা হতো সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান। এর সদস্যগণকে বলা হতো সিএসপি। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমার কপালে লেখা ছিল অন্য কিছু। ১৯৬৮ সালের শেষাংশে কম থাকলেও ’৬৯-এর পুরো বছরটাই জমজমাট আন্দোলন ছিল। বন্ধুবান্ধবের সাথে মিছিলে যেতাম বা আড্ডায় বসতাম; কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ শিথিল করিনি।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অনেক বন্ধুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু বারো-চৌদ্দ মাসের মধ্যেই একে একে সবাই হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নয় বিমানবাহিনী, নয়তো চট্টগ্রামের জুলদিয়ায় অবস্থিত মেরিন একাডেমিতে চলে গেল। যারা তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, অর্থাৎ বর্তমান বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল তারা থেকে যায়। ১৯৬৮ সালে শুরু হওয়া ছাত্র-আন্দোলন ’৬৯-এ এসে ব্যাপক গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ওই সময়েই নতুন বন্ধুদের অনেকে বলেছিল, ‘ইবরাহিম তুই ভালো ছাত্র হলেও এখানে লেখাপড়া কখন শেষ হবে, তার ঠিক নেই। এসব মিছিল-মিটিং তোর কাজ না। তাই তোর অন্য বন্ধুদের মতো তুইও সেনাবাহিনীতে চলে যা।’ একপর্যায়ে আমার মনটাও সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে গেল এবং তদানীন্তন পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে যোগ দিতে মনস্থ করলাম।

কাকুলে যোগদান
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে আমরা যারা ’৬৮ সালে এইচএসসি পাস করেছিলাম, তাদের মধ্য থেকে অনেকে নভেম্বর ১৯৬৮-তে ৪৩তম পিএমএ লং কোর্সে যোগ দেয়; কয়েকজন মে ১৯৬৯-এ ৪৪তম পিএমএ লং কোর্সে যোগ দেয়; কিছুসংখ্যক নভেম্বর ১৯৬৯-এ ৪৫তম পিএমএ লং কোর্সে যোগ দিয়েছিল। আমাদের মধ্যে দু-চারজন দুই বছর মেয়াদি লং কোর্সে না গিয়ে, ৯ মাসব্যাপী ওয়ার কোর্স বা শর্ট কোর্সে যোগ দিয়েছিল; একজন জানুয়ারি ১৯৬৯-এ ১৯তম ওয়ার কোর্সে, একজন এপ্রিল ’৬৯-এ ২০তম ওয়ার কোর্সে যোগ দেয়। আমি নিজেও সংক্ষিপ্ত রাস্তা খুঁজতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দুই বছর মেয়াদি লং কোর্সে না গিয়ে, ৯ মাস মেয়াদি ওয়ার কোর্সে যোগ দেবো। তাই যথাযথ প্রক্রিয়ায় ২৪তম ওয়ার কোর্সের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম এবং ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে যোগ দিই। ৯ মাস প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমরা কমিশন পাই।

মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় আমি আমাদের কোর্সে (অর্থাৎ আমাদের ব্যাচ বা শ্রেণীতে) সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়েছিলাম, তথা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম এবং এর জন্য নির্ধারিত পুরস্কার (নাম : কমান্ডার-ইন-চিফ’স কেইন অথবা সি-ইন-সি’স কেইন) পেয়েছিলাম। দুই বছর মেয়াদি লং কোর্সের মেয়াদান্তে সর্বোত্তম ক্যাডেট হিসেবে বিবেচিত হওয়া ক্যাডেটকে যে পুরস্কার দেয়া হয় তার নাম ‘সোর্ড অব অনার’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১, পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির এ ২৩ বছরের ইতিহাসে মোট চারজন বাঙালি তরুণ এ রূপ ‘সোর্ড অব অনার’ বা ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ পুরস্কার পেয়েছিলেন; অন্যান্য বছরে তরুণেরা পশ্চিম পাকিস্তানি, প্রধানত পাঞ্জাবি ছিলেন।

প্রাথমিক ভাইভায় ব্রিগেডিয়ার ক্যায়েরনেনডার
১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের কথা। মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার আগেকার ধাপগুলো অতিক্রম করছি। সে সময়ের দু-একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করছি। প্রথম ধাপ ছিল, প্রাথমিক মৌখিক পরীক্ষা বা প্রিলিমিনারি ভাইভা। বর্তমান ঢাকা সেনানিবাসের উত্তরাংশে, যে এলাকাকে সিগন্যাল গেট বলা হয়, সেখানেই প্রধান সড়কের ওপর পশ্চিম পাশে, একটা ইউনিটের অফিসে ভাইভার স্থান নির্ধারিত ছিল। সময়মতো গিয়েছিলাম। যখন আমার ডাক পড়ল, তখন দরজায় গিয়ে বললাম, মে আই কাম ইন স্যার? জলদগম্ভীর স্বরে ইংরেজিতে বললেন, কাম ইন। এর পরে বললেন, ‘ইউ ডু নট হ্যাভ টু সিট ডাউন, অ্যান্ড ওয়েস্ট মাই টাইম। ইউ আর কর্নেল ব্রাউন্স বয়, সো গেট গোয়িং ফাইন্ড ইয়োর ওয়ে থ্রু দি আদার ডোর।’ বাংলায় ভাবানুবাদ করছি। তিনি বললেন, ‘তুমি কর্নেল ব্রাউনের ছেলে। সুতরাং তুমি এখানে বসে আমার সময় নষ্ট করার দরকার নেই; ওই দরজা দিয়ে নিজের রাস্তা খুঁজে নাও।’ যিনি বলেছিলেন তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জর্জ ক্যায়েরনেনডার। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়ই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে তাকে দেখেছিলাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল বা কর্নেল র‌্যাংকে। আমরা তার নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারতাম না এবং ‘ক্যালেন্ডা’র বলতাম। এখন ঘটনাটির মাহাত্ম্য তুলে ধরছি।

ক্যাডেট কলেজ সমাচার
১৯৫৮ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের ১০-১১ মাইল উত্তরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের (যা বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) পূর্বপাশে পাহাড়ের কোলঘেঁষে, ফৌজদারহাট নামক গ্রামের বিরানভূমিতে ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন, কিন্তু প্রথম প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম মরিস ব্রাউন। তিনি নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী এবং ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন ফেলো অব দি রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি (এফআরজিএস)। তিনি এতটাই দক্ষ ও সুপরিচিত ছিলেন যে, তার নামেই এবং তার পরিশ্রমের কারণে ওই ক্যাডেট কলেজ সমগ্র পাকিস্তানে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

১৯৬০ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই ক্যাডেট কলেজের এইচএসসি পাস করা তরুণেরা পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান করা শুরু করেন। ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং মে মাসে হয়েছিল চূড়ান্ত ভাইভা, আমরা যারা ১৯৬২ সালের জুলাইতে ওই একমাত্র ক্যাডেট কলেজে ঢুকব, তাদের। তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল বা জেলা থেকে সাড়ে চার শতাধিক ১১-১২ বছর বয়সী বালক এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল এবং চূড়ান্তপর্যায়ে ৪৭ জন নির্বাচিত হয়েছিলাম। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে আমাদের যোগদানের তারিখ ছিল ৭ জুলাই, ১৯৬২। তখনো প্রিন্সিপাল ছিলেন কর্নেল ব্রাউন; তিনি ১৯৬৫ সালের শেষাংশ পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আরো তিনটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হওয়ার কারণে ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজের নাম বদলে ‘ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ হয়’। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১২টি ক্যাডেট কলেজ আছে, যার মধ্যে তিনটি শুধু মহিলাদের জন্য। মহান আল্লাহর দয়ায় আমার একমাত্র ছেলে সৈয়দ ফজলুল করিম মুজাহিদ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ১২তম ব্যাচের সাবেক ক্যাডেট। এই মুহূর্তে আমার কনিষ্ঠতম ছোট ভাই (শিল্প-উদ্যোক্তা) সৈয়দ মুহাম্মদ নাসির উদ্দীনের একমাত্র ছেলেও কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে বর্তমানে অধ্যয়নরত এবং আমার আপন মামাতো ভাই সৈয়দ মোস্তফা রাশেদুল আনোয়ারের একমাত্র ছেলে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়নরত। ক্যাডেট কলেজে প্রবেশ করা কঠিন বটে! প্রতি ব্যাচে তথা প্রতি বছর জুলাই মাসে প্রতি কলেজে ৫০ থেকে ৫৫ জন করে কিশোর এই কলেজে প্রবেশ করে। তারা অবশ্যই মেধাবী এবং ক্যাডেট কলেজে পড়ার কারণে অধিকতর মেধাবী হয়ে ওঠে।

যারা প্রবেশ করে তারা সবাই মেধাবী হয়ে থাকে এবং যেহেতু মেধাবী, বেশির ভাগ সাবেক ক্যাডেটই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বহু সাবেক ক্যাডেটই বিদেশে উপযুক্ত লেখাপড়া ও চাকরির সুযোগ পেয়ে যায় এটা যেমন সত্য, অনেকে বিদেশে থেকে গেলেও অনেকে দেশের টানে ফিরে আসে। আমার আপন ছোট ভাই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে প্রফেসর অব নিউরো সার্জারি, জাপানে পিএইচডি করার পর সেখানে ভালো চাকরির অফার পেয়েছিলেন কিন্তু থাকেননি, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাডভান্সড ট্রেনিং করার পরও চাকরির অফার পেয়েছিলেন, কিন্তু থাকেননি। ছোট ভাই ডাক্তার মইনুদ্দীন যে যুক্তি বিদেশীদের দিয়েছিলেন, সেটি ছিল আমার পিতামাতা এবং যে দেশবাসীর টাকায় লেখাপড়া করেছি সেই দেশবাসী আমার পক্ষ থেকে খেদমত পাওয়ার প্রথম হকদার; তাই আমি দেশেই ফিরে যাবো।’ সাবেক ক্যাডেটগণের মধ্যে প্রায় সবাই প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে দেশ গড়ার কাজে অবদান রাখেন; কিন্তু এটি ‘অপটিমাম’ কি না এ প্রশ্ন অনেক সমালোচক করেছেন। যা হোক, কর্নেল ব্রাউনের গল্প বলছিলাম। সামনে উপস্থিত ইবরাহিম যেহেতু ব্রাউনের ছাত্র; সুতরাং তার আর মৌখিক ইন্টারভিউ কী নেবে, এটি ছিল ব্রিগেডিয়ার ক্যায়েরনেনডারের অনুভূতি।

আইএসএসবি ১৯৬৯ সমাচার
দু-চার সপ্তাহ পর ডাক পড়ল আইএসএসবিতে। বর্তমান ঢাকা মহানগরের এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী থেকে কাকলী মোড় হয়ে বিমানবন্দর হয়ে উত্তরা গিয়েছে। পথিমধ্যে বনানী রেলক্রসিং। ওই স্থানের ডান দিকে ঢাকা সেনানিবাসের পূর্ব অংশ অবস্থিত। ওই অংশে, সেই ১৯৬৯ সালে আর কী কী ছিল মনে নেই, কিন্তু আইএসএসবি সেখানে অবস্থিত ছিল। আইএসএসবি মানে ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড বা আন্তঃবাহিনী নির্বাচনী পর্ষদ। সেখানে কী হয় বা না হয় সেটি একসময় আমার নখদর্পণে ছিল, কারণ ১৯৭৩-এর শেষাংশে যে কয়জন তরুণ সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বা সামরিক বাহিনীর জন্য আইএসএসবির গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠাতা তরুণ অফিসারদের মধ্যে নিজেও একজন ছিলাম; তখন আমি ছিলাম ‘ক্যাপ্টেন ইবরাহিম।’ ১৯৬৯-এর অক্টোবর-নভেম্বরের কোনো এক দিনে সেখানে অবস্থিত আইএসএসবির সভাপতি বা সহসভাপতি জনৈক কর্নেল বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফ্রিদির সামনে বসেছিলাম ছোটখাটো তরুণ ইবরাহিম; আইএসএসবির অংশ হিসেবে মৌখিক পরীক্ষার জন্য।

২০ থেকে ২৫ মিনিট প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য বরাদ্দ থাকে। আমার লেগে গিয়েছিল প্রায় ৫০ মিনিট। এই গল্প- সেই গল্প; এই প্রশ্ন- সেই প্রশ্ন; ঘুরেফিরে ইশারা-ইঙ্গিতে একটাই জিজ্ঞাসা : তোমার বন্ধুরা এত আগে গেছে, তুমি কেন এত দেরিতে যাচ্ছো? ঘুরেফিরে ইশারা-ইঙ্গিতে একটাই জিজ্ঞাসা, তুমি ভালো ছাত্র, তার মানে তুমি ‘ভাসানী’ করো (পাঠক, মেহেরবানি করে বুঝে নেবেন যে, ভাসানী করো মানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের ছাত্রসংগঠন ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা এপসু অর্থাৎ ছাত্র ইউনিয়ন)। আফ্রিদি সাহেব বারবার আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন একটা অভিযোগ- আমি আর্মিতে যাচ্ছি পলিটিকস করার জন্য। অনেক কষ্টে সেই পাঠান জাতির লোক, কর্নেল আফ্রিদিকে বোঝাতে পেরেছিলাম, ছাত্ররাজনীতি করিনি এবং সেনাবাহিনীতেও এসব ঝামেলায় জড়াব না। অতঃপর কর্নেল আফ্রিদি আরেক বাহানা জুড়ে দিলেন, যেন আমি সেনাবাহিনীতে না যাই। তিনি বললেন, তোমার ওজন এত কম এবং তুমি এত হালকা-পাতলা যে, মিলিটারি অ্যাকাডেমির সেই কষ্ট কোনো মতেই সহ্য করতে পারবে না। অতএব, তুমি ইবরাহিম সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা বাদ দাও। অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম, আমি ফৌজদারহাটের ক্যাডেট এবং শারীরিক সর্বপ্রকার অনুশীলন ছয় বছর ধরে করতে করতেই বড় হয়েছি।’ চূড়ান্তপর্যায়ে কর্নেল আফ্রিদি আমাকে সুপারিশ করলেন।

মেডিক্যাল টেস্ট এবং কম ওজনের বিপদ
তিন সপ্তাহ পর শারীরিকভাবে ছোটখাটো হওয়ার সমস্যার আবারো মুখোমুখি হলাম। ছিল রোজার মাস। সঠিক দিন-তারিখ মনে নেই। বর্তমানে (২০১৮) ঢাকা সেনানিবাসের উত্তরাংশে যেখানে কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল বা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল অবস্থিত, সেখানেই এই সিএমএইচ তখনো ছিল। তখনকার সিএমএইচের পশ্চিম অংশে টিনের ছাউনি দেয়া একটি ব্যারাক বা লম্বা ঘরের এক কোনায় ছিল স্টাফ সার্জন বা অফিসারদের ডাক্তারের চেম্বার। সেখানে উপস্থিত হলাম। অনেক মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান তরুণও ছিলেন। যথাসময়ে আমার ডাক পড়ল। ডাক্তার সাহেব দেখার আগেই, তার সহকারী উচ্চতা মাপলেন, ওজন মাপলেন। উচ্চতা পেলেন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি এবং ওজন ১০৮ পাউন্ড। উচ্চতা যথেষ্ট কিন্তু ওজন সেনাবাহিনীতে ঢোকার জন্য যা দরকার, তার চেয়ে চার পাউন্ড কম। সহকারী মুদ্রিত ফর্মের মধ্যে যেখানে ফিট/আনফিট লেখা, সেখানে আনফিটে টিক মার্ক দিয়ে ডাক্তারের দিকে স্লিপটা এগিয়ে দিলো। ডাক্তার ইংরেজিতে বললেন, স্যরি, ইনক্রিজ ইওর ওয়েট অ্যান্ড দ্যান কাম অ্যাগেইন। মানে তোমার ওজন বাড়াও, এরপর আবার এসো। অর্থাৎ আবার পরীক্ষা দিও। নিজের অন্তরের ভেতরে ধপাস করে আওয়াজ হলো। চোখে অন্ধকার দেখলাম।

কারণ, একান্তই অপ্রত্যাশিত উত্তর শুনেছি। যা হোক, ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে সেনাবাহিনীর হাবিলদার বা নায়েক- এ রূপ সহকারীদের দেখতে দেখতে এবং ক্যাপ্টেন বা মেজর র‌্যাংকের অ্যাডজুটেন্ট দেখতে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ করে দিলের মধ্যে সাহস এসে গেল; মহান আল্লাহই ব্রেনের মধ্যে বুদ্ধিটা ঢুকিয়ে দিলেন। ডাক্তারকে বলেই ফেললাম, স্যার, আই অ্যাম ফাস্টিং সো আই অ্যাম লেস ওয়েইট। মানে : আমি রোজা রেখেছি ওই জন্যই আমার ওজন কম। আসলেই রোজা ছিলাম। ডাক্তার সাহেব, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের মেজর। হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উর্দু ভাষায় বলে উঠলেন : ‘আরে ইয়ে তো জবরদস্ত বেটা হায়; রোজা-ভি রাখতা হ্যয়; ইসসে সব হোগা।’ অর্থাৎ, এই ছেলে তো বেশ ছেলে, রোজাও রাখে, এ সব পারবে।’ মেজর সাহেব হুকুম দিলেন চার পাউন্ড বেশি লেখো। আমার ওজন লেখা হলো ১১২ পাউন্ড এবং আমাকে ফিট ঘোষণা করা হলো। এই ছিল পরীক্ষাগুলোতে উত্তরণের ধাপ। মহান আল্লাহ চেয়েছিলেন। তাই কর্নেল আফ্রিদি চূড়ান্তপর্যায়ে নরম হয়ে আমাকে পাস ঘোষণা করেছিলেন। মহান আল্লাহ চেয়েছিলেন; তাই ডাক্তার সাহেব চার পাউন্ড ওজন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

মহান আল্লাহর চাওয়া
এই কলামের উপরের অংশে, পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে আমার ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছি। যেহেতু আমি সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়েছিলাম বা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম, সেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ অনুযায়ী, আমাকে নিজের ইচ্ছা তথা নিজের পছন্দের ক্যান্টনমেন্ট এবং নিজের পছন্দের সেনাবাহিনীর ইউনিটে চাকরি করার সুযোগ দেয়া হলো। এটা হলো প্রথম স্থান অধিকারকারীর প্রতি সম্মান। আমি চয়েস বা পছন্দ বলেছিলাম, জয়দেবপুরে (বর্তমানের গাজীপুর সদর) অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সেই মোতাবেক, সরকারি আদেশ দেয়া হয়েছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ বিকেলে জয়দেবপুরে উপস্থিত হয়েছিলাম। পরবর্তী সাত মাস আমিই ছিলাম ব্যাটালিয়নের কনিষ্ঠতম অফিসার। রেওয়াজ অনুযায়ী, আমি ছিলাম ব্যাটালিয়নের ইন্টেলিজেন্স অফিসার, তথা আইও। যে বাচ্চা অফিসারটি আইও হয়, সে বহিরাঙ্গন কাজের বা বহিরাঙ্গন অনুশীলনের বেশির ভাগ সময় অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসারের সান্নিধ্যে থাকে। অতএব আমিও সেই সুবাদে কাছে-কাছে থাকতে পারতাম এবং অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম সময়ের আগেই।

১৯ মার্চ ১৯৭১, আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, আমাদের ব্যাটালিয়ন তথা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, আমি সেই সময়টিতেও, বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানকারী অধিনায়কের পাশে পাশে ছিলাম। সে আমলের জয়দেবপুর রাজবাড়ি থেকেই আমরা সবাই একসাথে, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, অনেকবার রণাঙ্গনে সাক্ষাৎ শত্রুর গুলি থেকে মহান আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন। মহান আল্লাহ সাহস দিয়েছিলেন, বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছি। ওই সম্মান দেশবাসীর কাছে থেকে আজ অবধি পাচ্ছি। বড় সিএসপি যদি হতে যেতাম অথবা বড় অধ্যাপক যদি হতে যেতাম, তাহলে সম্মান কিভাবে আসত বা কতটুকু আসত, সেটি আমার পক্ষে অনুমান করা কঠিন।

পুনঃপ্রার্থনা : আল্লাহর সহায়তা চাই
এই সংক্ষিপ্ত কলামে কতটুকুই বা বলা যায়? যতটুকু বললাম, তার থেকে অনেক বেশি বলা হলো না; হয়তো আরেক দিন বলব। এ মুহূর্তেও মহান আল্লাহর দয়া অতীব প্রয়োজনীয়। দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রাজনীতির অঙ্গনে সরকারি মহল ও বিরোধী মহল তথা উভয় মহলই চিন্তায় আছে অথবা কারো কারো মতে দুশ্চিন্তায় আছে। আমি যেহেতু একজন রাজনৈতিক কর্মী, দেশের কল্যাণ চাই, জনগণের কল্যাণ চাই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কল্যাণ চাই, আমার পার্টির কল্যাণ চাই, সেহেতু আমিও চিন্তা করছি এবং পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই যাচ্ছি। নিজের জোট ও নিজের দলের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করছি, সরকারের পদক্ষেপগুলো মূল্যায়ন করছি। আশা করছি, সঠিক পথ পাবো অর্থাৎ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবো না। এখানেও মহান আল্লাহর দয়া খুবই প্রয়োজন। আমি এক রকম চাইতে পারি, আমাদের দল বা আমাদের জোট এক রকম চাইতে পারে, কিন্তু দেশের জন্য ও আমাদের জন্য যেটা ভালো, আমরা সেটাই চাই এবং সে সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহই দেবেন। মহান আল্লাহর সিদ্ধান্ত, দ্বীন ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত নিয়মে বা মাধ্যমেই দিলের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে আসে। আগামী কলামে দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি


আরো সংবাদ



premium cement