নির্বাচন কমিশন ও সরকারে অস্থিরতা
- আলফাজ আনাম
- ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৩৮, আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৪৪
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যেন বেশি অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। কারণ, এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার বাইরে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর নির্বাচন কমিশনারদের কথায় ও কাজে ক্ষমতাসীনদের আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন ঘটছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হঠাৎ করে তার অবস্থান বদল করে বলেছেন, ‘ডিসেম্বর মাসে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে’ এমন কোনো কথা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। নির্বাচনের তফসিল কবে ঘোষণা হবে- এটা এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে- এটা আমরা বলিনি।
সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কথা বললেও গত ২৭ সেপ্টেম্বর বগুড়া জেলা প্রশাসন আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। তবে ভোটগ্রহণের সময় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আশা করি, নভেম্বর মাসের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন কমিশনের সচিবও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনিও গত ২৮ আগস্ট বলেছিলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি চলছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে নিজ কার্যালয়ে তিনি এ কথা জানান। নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের স্কুল শুরু হয়ে যাবে। সে সময় নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তা ছাড়া, ডিসেম্বরের শেষ দিকে শিক্ষার্থীদের ছুটি থাকে।
নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসে সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে থেকে। গত ৫ সেপ্টেম্বর তিনি এক সভায় বলেছিলেন, ২৭ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। এই তারিখ তিনি নির্বাচন কমিশনের সাথে আলাপ করে জেনেছেন বলে ওই সভায় উল্লেখ করেন। এর পরদিন সিইসি মন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ভোটের তারিখ ঘোষণা করে ঠিক করেননি। নির্বাচন কমিশনের সাথে অর্থমন্ত্রীর কোনো কথা হয়নি।’ এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা হতে পারে। পরদিন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের কাছে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসির সাথে আলোচনা না করেই ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ইসির কাজ। আর ইসি এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি।
সরকারের মন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনারদের পরস্পরবিরোধী এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। নির্বাচন কমিশনের আগেই সরকারের মন্ত্রীরা নির্বাচনের তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করছেন। তবে সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেভাবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা তারা বলেননি বলে জানালেন, তাতে মনে হচ্ছে এ বছর নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর আগে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এ ছাড়া বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের সায় নেই। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ভারতও চায়, নির্বাচনে যাতে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মহলের চাপ উপেক্ষা করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করা এখন সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়; যদিও বিরোধী দল আসুক বা না আসুক, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন করার প্রবল আকাক্সক্ষা রয়েছে। কিন্তু যেকোনো কারণে হোক, সম্ভবত ডিসেম্বরে নির্বাচন হচ্ছে না।
২.
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো ন্যূনতম পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি। তবে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গঠন শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল প্রথম দিকে এমন ঐক্য প্রক্রিয়াকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন তীব্র বিরোধিতার পথ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপির সাথে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিসহ পাঁচ দফা দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। একসাথে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। একই সাথে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটও অটুট আছে।
বিএনপির সাথে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব এবং ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে এ ধরনের জোট ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। সে সময় ১৪ দলীয় জোটকে সম্প্রসারিত করে মহাজোট গঠন করা হয়েছিল যেখানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়াও ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং অব: কর্নেল অলি আহমদ যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির সাথে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি। ২০ দলীয় জোটে জামায়াত প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ২০ দলীয় জোটের বাইরে যে ঐক্য প্রক্রিয়া চলছে, তাতে জামায়াত কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এ ক্ষেত্রে দলটি যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আগামীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে দেবে। এখন ক্ষমতাসীন দল অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে।
জোটের রাজনীতির এই নানামুখী মেরুকরণে ক্ষমতাসীন দলের মিত্রদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। গত সপ্তাহে রাজনীতিতে জোর গুঞ্জন ছিল, সিঙ্গাপুরে ড. কামাল হোসেনের সাথে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বৈঠক হয়েছে। অবশ্য পরে জাতীয় পার্টির নেতারা এ খবর নাকচ করে দিয়েছেন। তবে জাতীয় পার্টির ওপর সরকারের আস্থার অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল এখন এরশাদ ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে। নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রী রাখার ব্যাপারে রওশন এরশাদ তালিকা তৈরি করছেন। আর এ নিয়ে এরশাদ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের ভূমিকা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সঙ্কট রয়েছে। এ কারণে আগের কৌশলে এরশাদের পরিবর্তে রওশনকে জাতীয় পার্টির মূল ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চায় সরকার। এতে এরশাদকে চাপে রাখা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের এই কৌশলে এরশাদ ক্ষুব্ধ হলেও এখন অনেকটা অসহায়। তবে আগামী দিনে রাজনৈতিক হাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এরশাদের বদলে যাওয়া যে স্বাভাবিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৩.
নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলন ঠেকাতে সরকার নানা ধরনের ফ্রন্ট খুলছে। গত সপ্তাহে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্দোলন হলে কোটা আবার ফিরিয়ে আনা হবে। এরপর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ব্যানারে কয়েকটি সংগঠন কোটা ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। জনা ত্রিশেক তরুণ রাজধানীর শাহবাগ মোড় দিনের পর দিন অবরোধ করে রাখছে। পুলিশের উপস্থিতিতে তারা রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান গ্রহণ করে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এদের সমর্থন দেয়ার কথা ঘোষণা করে। সরকারের ইঙ্গিতে এই তরুণরা মাঠে নামলেও রাস্তা বন্ধ করে অবরোধের ঘটনায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান এই আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আবার পরিবহন শ্রমিকরাও নতুন করে রাস্তায় নেমেছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোরদের আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইনে ড্রাইভারদের শাস্তির যে বিধান করা হয়েছে, তা পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পরিবহন শ্রমিকেরা। এই আন্দোলনের পেছনে পরিবহন শ্রমিক নেতা ও নৌপরিবহন মন্ত্রীর সমর্থন আছে বলেই ধরে নেয়া যায়।
কোটা ফিরিয়ে দেয়ার আন্দোলন স্থগিত করা হলেও সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চের নামে আন্দোলনের নেতৃত্বে আনা হয়েছে একজন পরিবহন শ্রমিক নেতাকে। অর্থাৎ আগামী দিনে পরিবহন শ্রমিক ও সরকার সমর্থক এই তরুণদের রাস্তায় নামানো হবে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে এসব সংগঠনকে নামানো হলেও কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা তরুণদের সরকারের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের দাবি পূরণে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
অরাজনৈতিক এসব সংগঠনকে রাস্তায় নামানোর পাশাপাশি, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘গায়েবি’ মামলা দেয়া হচ্ছে। গাড়ি ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপসহ বিভিন্ন মামলায় বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ তৃণমূলপর্যায়ের কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ওয়ার্ডপর্যায়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের যে তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে, সেই তালিকা ধরে ধরে আসামি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ যাচাই-বাছাই পর্যন্ত করছে না। এসব মামলার একটি বড় লক্ষ্য হলো, সরকারের নিয়ন্ত্রণে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করলে যাতে ভোটকেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট পাওয়া না যায়। এসব মামলার সূত্র ধরে সক্রিয় নেতাকর্মীদের আগেই গ্রেফতার করা হবে।
গায়েবি এসব মামলায় মৃত ব্যক্তি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী, এমনকি প্রবাসে অবস্থান করছেন এমন বিরোধী নেতাকর্মীকেও আসামি করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ কিংবা তরিকুল ইসলামের মতো প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাঙচুরের মামলা দেয়া হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ আইনজীবী এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের বিরুদ্ধে ককটেল নিক্ষেপের হাস্যকর অভিযোগ এনে মামলা দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলকে নিপীড়নের মধ্যে রেখে সরকার নির্বাচনের আয়োজন করতে চাইছে। কিন্তু এতে কতটা সফল হওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারের অস্থির রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
alfazanambd@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা