প্রদেশ প্রবর্তনের সমূহ ঝুঁকি
- আমীর হামযা
- ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:০৭
আমাদের দেশের আয়তন মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করে পশ্চিমাংশ ভারতে এবং পূর্বাংশ পাকিস্তানের অংশ করা হয়। ফলে বাংলা হয়ে পড়ে খণ্ডিত। এটি বর্ণবাদী হিন্দুদের বাসনা পূরণ করলেও বাংলার তখনকার সাধারণ মানুষের অর্থাৎ সংখ্যাগুরু মুসলমানের মন ক্ষতবিক্ষত করে। কারণ, ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলা ভাগ করে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠন করলে বর্ণবাদী হিন্দুরা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। তারা বাংলা ভাগকে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে বর্ণনা করে বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। আসলে বাংলা ভাগে তারা ওই সময় মায়াকান্না করলেও এর পেছনের কারণ ছিল স্রেফ আর্থ-রাজনৈতিক। এখানে বঙ্গমাতার অঙ্গছেদের কথা বলে যে কান্না তা নিছক কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ ছাড়া কিছু নয়। পূর্ববাংলায় নিজেদের জমিদারি খতম হওয়া এবং সামাজিক ক্ষমতা বিলোপের আশঙ্কায় ১৯০৫ সালে বর্ণ হিন্দুরা এর বিরোধিতা করে। তাদের সাংস্কৃতিক কাণ্ডারি রবীন্দ্রনাথও বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে গান লিখেন ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আর এই গানই এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত হওয়ায় এটি রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে গীত হওয়া বাধ্যতামূলক। এ তো গেল সাংস্কৃতিক দিক। বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেয় সন্ত্রাসবাদ। যার মাধ্যমে আমাদের এ অঞ্চলে উগ্র হিন্দুত্ববাদের গোড়াপত্তন। সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই সূর্যসেন আর প্রীতিলতারা আত্মাহুতি দেন।
কৌতূলোদ্দীপক হলো, যে বর্ণহিন্দুরা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে মাতম করেছিলেন, সেই তারাই ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বাংলা ভাগের জন্য তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেও দ্বিধা করেননি। ছয়চল্লিশ-সাতচল্লিশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় লাখো বনি আদমকে জীবন দিতে হয়।
সাতচল্লিশে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাংলা ভাগে অতিতৎপরতার পেছনেও বিদ্যমান ছিল আর্থ-সাংস্কৃতিক কারণ। পূর্ববাংলা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুদের কাঁচামাল সংগ্রহের প্রধান উৎস। তাই ১৯০৫ সালে সমূহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় বর্ণ ও ধনিক বণিকশ্রেণীর হিন্দু জনগোষ্ঠী বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে। সেই তারাই পূর্ববাংলা থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ হারানোর ভয়ে বাংলা ভাগে মরিয়া হয়ে ওঠে। কারণ, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ইসলাম, তাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থানান্তরিত হলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ার শঙ্কায় বাংলা ভাগে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ফলে পশ্চিম বাংলা সর্বভারতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। আর মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়তে সচেষ্ট হয়। পরবর্তী সময়ে একাত্তরের জনযুদ্ধে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাও দিন মাস বছর গড়িয়ে ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ছিল সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আজও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সোনার পাথরবাটি হয়ে আমাদের মতো আমজনতার কাছে অধরাই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ জমানার দীর্ঘ ৫৪ বছরে এ দেশে ধনী আরো ধনী হয়েছে। গরিব আরো গরিব এবং নিঃস্ব হয়েছে। বৈষম্য সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছেন, তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে একটি দুষ্টচক্র গড়ে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিশেষ করে সদ্য পতিত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠা করেন মাফিয়াতন্ত্র। অবশেষে ছাত্র-জনতার বিপুল রক্তের বিনিময়ে উৎখাত হয় ফ্যাসিবাদী শাসন। অবসান ঘটে হাসিনার অপশাসন। জীবন বাঁচাতে হাসিনা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে।
হাসিনা-উত্তর এখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারকল্পে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের বর্তমান এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন এনে দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা করছে। ‘দেশের পুরনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেয়ার পক্ষে এ কমিশন’। (প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫)
এখন প্রশ্ন হলো, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে এই যে প্রদেশ গঠনের চিন্তাভাবনা এটি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক। প্রদেশ গঠনের বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন কোনো আলোচনা নয়। এবারই যে প্রথম এ আলোচনা উত্থাপিত হয়েছে তা-ও নয়। স্বৈরাচারী এরশাদের আমলেও প্রদেশ প্রবর্তনের আলোচনা হয়েছিল। পরে মাফিয়া রানী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দোসর হয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি দেশকে পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী প্রচারণা চালায়। জনসংযোগ করে। কিন্তু ওই প্রস্তাব হালে পানি পায়নি।
আমাদের মনে থাকার কথা, এরশাদ জমানায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপন করার চেষ্টা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে সংবিধানের এক কেন্দ্রিকতার উল্লেখ করে ওই উদ্যোগকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ফলে উদ্যোগটির সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে বিকেন্দ্রীকরণে প্রদেশ প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে। এটা ঠিক যে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে প্রদেশ গঠন বা প্রবর্তনের কথা শুনতে খারাপ লাগে না। বরং শুনলে কানে আরাম দেয়। শুধু মধুর নয়, সুমধুর লাগে। যেমন ভোরের ঘুমের আমেজ খুব ভালো লাগে। কিন্তু আদৌ কি ভোরে ঘুমানো স্বাস্থ্যসম্মত? নিশ্চয় নয়। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের কাছেও প্রদেশ গঠনের বিষয়টি এমন মনে হয়। কেন এমন মনে হয়, সেই আলোচনা জরুরি।
প্রদেশ গঠন আমরা এ জন্য বাস্তবসম্মত মনে করি না : প্রথমত, বাংলাদেশ খুব ছোট একটি দেশ। এ দেশে অঞ্চলগতভাবে উন্নয়নবৈষম্য তীব্র নয়। ফলে অঞ্চলে অঞ্চলে বিরোধ কোথাও নেই। দ্বিতীয়ত, যে কারণটি বিদ্যমান, তা হলো ভারতের উসকানিতে দেশের এক-দশমাংশ ভূ-খণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের একটি অংশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। উপরন্তু দীর্ঘ দিন ধরে চাউর রয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের পশ্চিমাদের পরিকল্পনার কথা। যদি প্রদেশ গঠন করা হয়; তা হলে আশঙ্কা রয়েছে পার্বত্য জনপদে বিচ্ছিন্নতাবাদী জুম ল্যান্ড আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এতে আমাদের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তায় নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। এমনিতে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দীর্ঘায়িত হওয়ায় বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করে চলেছে। এ ছাড়া একসময় চিত্তরঞ্জন সুতারের বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে। তাই দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে প্রদেশ প্রবর্তন আমাদের কাছে বিবেচনাপ্রসূত চিন্তা বলে মনে হয়নি।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, প্রদেশ প্রবর্তনের চিন্তা বাদ দিয়ে কিভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়? এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হলো, দেশে প্রচলিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারলে দেশে যথার্থ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে কার্যকর স্বায়ত্তশাসন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনগণের কাছে প্রকৃত জবাবদিহির ব্যবস্থা করা গেলে তৃণমূলে আরো বেশি ক্ষমতায়ন করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ জন্য অবশ্যই প্রয়োজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা যাতে কোনো অবস্থাতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। নাক না গলাতে পারেন। আইন সভার যারা সদস্য নির্বাচিত হবেন অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের কর্মপরিধি আইন প্রণয়নে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
প্রদেশ প্রবর্তনে সবশেষ যে সমস্যার কথা উল্লেখ করতে চাই; তা হলো প্রদেশ গঠনে প্রাথমিক যে পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে জোগান দেবে। তার সবটুকু নিশ্চয় নিজস্ব উৎস থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এই অর্থ জোগাড় করতে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। পরিণামে দেশ আরো বিদেশী ঋণের জালে জড়িয়ে পড়বে।
উপরের আলোচনার পর আমরা প্রত্যাশা করি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রদেশ গঠনের চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসবে। তাদের প্রণীতব্য সুপারিশমালায় প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব স্থান পাবে না।
e-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা