১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে মুসলিম বিশ্ব

-

                                                                               (প্রথম কিস্তি)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো বিনির্মাণ করেছিলেন তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। ঐতিহাসিকভাবে এটি স্বীকৃত যে, ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যতগুলো মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সবগুলোতে আইন ও রাজনৈতিক শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়াদি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মূলভিত্তি ছিল ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাসনকাল ছিল উমাইয়া (৬৬১-৭৫০ সাল), আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮ সাল), উসমানীয় বা অটোম্যান (১২৮১-১৯২৪), সাফাভিদ (১৫০১-১৭২২) ও মোগল (১৫২৬-১৮৫৭ সাল)।

একাদশ শতাব্দী থেকে ইসলামী বিশ্ব তুর্কি ও মোঙ্গলদের আক্রমণের শিকার হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম হয়। বাণিজ্যে চাতুর্য ও সামরিক ও নৌশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা অনেক মুসলিম ভূখণ্ড করায়ত্ত করে। তারা তুর্কি ও মোঙ্গলদের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি; বরং তারা এসব দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে শাসন ও শোষণ চালাতে সক্ষম হয়। রাশিয়া, হল্যান্ড, ব্রিটেন, স্পেন ও ফ্রান্স ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণার যূপকাষ্ঠে মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রভাবকে খর্ব করতে সমর্থ হয়।

বিংশ শতকে একদিকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ তাদের আধিপত্য সুসংহত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে; অন্যদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্রতর করে তুলতে সচেষ্ট হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) পরবর্তী অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল স্বাধীনতা লাভ করে। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সেখানেও উপনিবেশবাদের ষড়যন্ত্র ও চাতুর্যের ছাপ রয়ে যায়। ঔপনিবেশিক প্রভুরা মুসলমানদের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হলেও শেষ পর্যন্ত ‘ভাগ করো আর শাসন করো’ নীতির আওতায় মুসলিম জাতির ভৌগোলিক মানচিত্র পরিবর্তন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্র তৈরি করে এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করার মাধ্যমে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। তারা সীমান্ত রেখা তৈরি করে তাদের পছন্দমতো শাসকদের ক্ষমতায় বসায়।

মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফরাসিরা পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা, লেবানন ও সিরিয়ায়, ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন, ইরাক, আরব উপসাগরীয় এলাকা, ভারত উপমহাদেশ, মালয় ও ব্রুনাই এবং ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা এসব দেশের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজনৈতিক পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থা, আইনগত কাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেদের মতো করে পাল্টে দেয়। সেই সাথে মুসলমানদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়। ঔপনিবেশিক প্রভুদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও খ্রিষ্টান মিশনারিরা ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদ ও ঔপনিবেশবাদের সংরক্ষণে সৈনিকের ভূমিকা পালন করে। তারা ইসলামে দীক্ষিত না হয়ে; বরং উপনিবেশের জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা চালায়।

লক্ষণীয় যে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বেশির ভাগ মুসলিম ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে যে ইউরোপীয় আইন-কানুন ও প্রতিষ্ঠান রেখে গেছে তার অধিকাংশ ইসলামী নীতি ও আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বস্তুত ইউরোপীয়দের সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়ন করে এটি বলা যায়, তারা মূলত ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে ‘আধুনিক ক্রুসেড’ শুরু করেছিল। ফরাসিরা আলজিয়ার্সের একটি জামে মসজিদ দখল করে সেটিকে একটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করে সেখানে ফরাসি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল।

মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের প্রত্যাশা ও আকর্ষণ। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ফলে দ্রুত ব্যাপক পরিসরে শিল্পপণ্যের উৎপাদন বাড়ে। এসব পণ্যের বাজারজাতকরণে তারা এশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন বাজারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। আরব অঞ্চলে তারা বিকাশমান বাজারের সম্ভাবনা দেখতে পায়। পুরো আরব ছিল তখন উসমানীয় খিলাফতের আওতাধীন। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইউরোপীয়রা উসমানি খেলাফতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে প্রবেশের পথ খুঁজতে শুরু করে। ইউরোপের মধ্যে পর্তুগাল হচ্ছে প্রথম দেশ যারা এশিয়ার ভারতে প্রথম আগমন করে। ভাস্কো দা গামা ভারতের দক্ষিণ উপকূলের কালিকট বন্দরে সর্বপ্রথম পদার্পণ করে। এরপর তাদের পথ অনুসরণ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া উপনিবেশে অভিযান শুরু করে। পুরো আরব এলাকা স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের আওতায় চলে আসে। আরবের পূর্বকূলের দেশগুলো ব্রিটেনের অধীনে এবং পশ্চিমের দেশগুলো ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীনে পতিত হয়।

সাধারণত ঔপনিবেশিক আধিপত্যের স্বরূপ তিনটি ক্ষেত্রে প্রভিভাত হয়ে উঠে। প্রথমত, রাজনৈতিক আধিপত্য; দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ এবং তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সম্প্রসারণ। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল সবচেয়ে মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী।
সামরিক শক্তির জোরে বিভিন্ন মুসলিম দেশকে উপনিবেশে রূপান্তর করে ইউরোপীয়রা তৃপ্ত হয়নি; বরং নানাবিধ চুক্তি ও ব্যবসায়িক কর্মকৌশলের মাধ্যমে তারা মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ ব্যাপক হারে চুরি বা লুণ্ঠন করে পাশ্চাত্যে নিয়ে যায়। ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও আদর্শিক চিন্তা-চেতনায় পশ্চিমা ভাবধারা অনুপ্রবেশ করিয়ে তারা মুসলিম সমাজকে পঙ্গু করে দেয়। তারা পাশ্চাত্যের সেক্যুলার চিন্তাধারার এক ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে অনেকটা সক্ষম হয়, ‘ধর্ম যার যার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এটিকে রাজনীতিতে টেনে আনা ঠিক নয়।’ এরূপ প্রচারণা দ্বারা তারা ইসলামকে সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে প্রয়াস চালায়। পাশাপাশি তারা কাদিয়ানি ও বাহাই মতবাদের প্রচারণার মাধ্যমে ইসলামের ভ্রান্ত ও অপব্যাখ্যার সুযোগ করে দেয়। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে উপনিবেশ স্থাপনের কাজ সুগম করে নেয়। তারা ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অভিযান চালিয়ে তাকে পরাজিত করে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখলের মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে পদার্পণকে সুদৃঢ় করে। ১৭৬৪ সালে তারা খোদ মোগল সম্রাটের ওপর আঘাত হানে। ১৭৯৮ সালে মহীশুরে টিপু সুলতানকে পরাজিত করে পুরো ভারতে দখল প্রতিষ্ঠা করে। উপমহাদেশে প্রধানত মুসলমানরা ১৮৫৭ সালে যুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং লড়াই চালিয়ে অবশেষে সম্রাট বাহাদুর শাহ ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন। এরপর ব্রিটেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওই দিকে উসমানিয়া খেলাফতের অবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। ১৭৯৮ সালে ফরাসিরা মিসরের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। উসমানীয় বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮০৪ সালে সার্বিয়া ও গ্রিস বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

এদিকে রাশিয়া ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তার তুলাজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে উড়াল পর্বতের পূর্বদিকে মধ্য এশিয়ায় আগ্রাসন চালানোর সম্প্রসারণবাদী নীতি গ্রহণ করে। রাশিয়া ১৮৬৫ সালে খুজান্দ, ১৮৬৮ সালে বুখারা ও ১৮৭৩ সালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী খিবা দখল করে নেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অত্যন্ত দাপটের সাথে অবস্থান করলেও রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী নীতির বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা ছিল যে, আমুদরিয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল রাশিয়ার কর্তৃত্বে এবং আফগানিস্তানের পূর্বের অঞ্চলগুলো ব্রিটিশদের কর্তৃত্বে থাকবে। রাশিয়া ১৮৮৫ সাল নাগাদ মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ নগরী ও পাঞ্জাব পর্যন্ত তার আগ্রাসন অব্যাহত রাখে।

১৮৭৮ সাল থেকে জার্মানি ও ব্রিটেন ও রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী নীতিতে উৎসাহিত হয়ে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে মনোনিবেশ করে। ১৮৮৪-৮৫ সালে জার্মানি পূর্ব আফ্রিকার তাগাংকিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন ও টোগো এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের নামিবিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে। জার্মানির সম্প্রসারণবাদী নীতি ব্রিটেনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা পূর্ব আফ্রিকায় জার্মানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় আফ্রিকার ব্যবসায়-বাণিজ্যে ফরাসিদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ফরাসি ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে সেনেগাল ও নাইজারের মধ্য রেললাইন চালু করেছিল। এ ব্যবস্থাকে ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থের প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখতে পায়।

১৮২০ সালের দিকে ব্রিটিশরা আরব উপদ্বীপে অবস্থিত কাতার ও ওমানের সাথে এক চুক্তি সই করে এবং এর ফলে আরব এলাকায় ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। ওই দিকে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা আলজেরিয়া ১৮৩০ সালে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। নেপোলিয়নের আমল থেকে ফ্রান্স বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আলজেরিয়া দখলের যুক্তি খাড়া করে। এ সময়ে দু’দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছিল। এক পর্যায়ে আলজেরিয়ার শাসক হুসাইন পাশা হাত পাখা দিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে আঘাত করেন। এরূপ উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ১৮৩০ সালে ফরাসিরা ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স দখল করে নেয়। কিন্তু আলজেরিয়ার যোদ্ধারা জনযুদ্ধ চালিয়ে চার দশক পর্যন্ত ফরাসিদের ঠেকিয়ে রেখেছিল। অটোম্যান সৈন্যরা তাদের সহায়তা করে এবং মরক্কোও সমর্থন জোগায়। এতদসত্ত্বে¡ও ফরাসিদের কাছে আলজেরিয়ার জনগণ পরাজিত হয়। মরক্কো আলজেরিয়াকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার কারণে ফ্রান্স ওই দেশটিও দখলের পাঁয়তারা করে। তারা মরক্কো দখল করতে গেলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং ১৮৪৪ সালে মরক্কোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। এদিকে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশরা ওমান ও কাতারের সাথে চুক্তি বাস্তবায়ন করে আরো ১০ বছরের জন্য আরব উপদ্বীপে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে। এক পর্যায়ে তারা ওমানকে ভাগ করে মাস্কট ও জানজিবার নামে দুটো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি ব্রিটেন বাহরাইনকেও বাধ্য করে ওমানের মতো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে।

১৮৭৫ সাল নাগাদ ব্রিটেন ও ফ্রান্স মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দখল প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্স আগে আলজেরিয়া ও মরক্কো দখল করেছিল। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশরা মিসরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এসময় মিসরের শাসক ইসমাইল পাশা ব্রিটিশদের হাত থেকে মিসরকে রক্ষায় বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি কিছুটা গণতান্ত্রিক নীতি প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। ব্রিটিশরা তুর্কি খলিফাকে চাপ দিয়ে ইসমাইল পাশার পরিবর্তে তার পুত্র তাত্তফিক পাশাকে মিসরের শাসক নিয়োগ করে।

ওই দিকে ফরাসিরা মরক্কো ও আলজেরিয়ার পরে তিউনিসিয়ার দিকে ঔপনিবেশিক শ্যেন দৃষ্টি ফেলে। তারা ব্রিটিশদের বিরোধিতা ছাড়া তিউনিসিয়া দখল করে নেয়। বিনিময়ে ব্রিটেন তুর্কি খলিফার কাছ থেকে সাইপ্রাস দ্বীপ দখলে নেয় এবং ফরাসিরা তাতে নীরব থাকে। তিউনিসিয়ার তখনকার শাসক মুহম্মদ আস-সাদিক ফরাসিদের প্রভাব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফ্রান্স অবশেষে ১৮৮১ সালে সামরিক অভিযান চালায়। রাজকীয় প্রাসাদ দখল করে। সেখানকার শাসককে অধীনতামূলক চুক্তি সই করতে বাধ্য করে। মিসরে ব্রিটেনের অনুগত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। ১৮৮১ সালের সেপ্টেম্বরে তার বিস্ফোরণ ঘটে। আহমেদ উরাবির নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে রিয়াদ পাশার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৮৮২ সালের ১১ জুলাই ব্রিটিশরা আলেকজান্দ্রিয়ায় হামলা চালায়। মিসর এরূপ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের কাছে যে অস্ত্র ছিল তা একেবারে সেকেলে। ব্রিটিশরা আধুনিক বোমা নিক্ষেপ করে। তীব্র আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে মিসর ১৮৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের করতলগত হয়। ১৮৯৯ সালে ব্রিটেন সুদান দখল করে নেয়। সুদান দীর্ঘকাল ধরে মিসরের অংশ ছিল। ব্রিটিশরা তাদের লুণ্ঠিত পণ্য ও কাঁচামাল যাতে সহজে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করতে পারে সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে মিসরের রাজধানী কায়রো পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে। কায়রো শহর থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এসব পণ্য ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হতো। এ দিকে ব্রিটিশরা যে বছর সুদান দখল করে (১৮৯৯) সেই একই বছরে তারা কুয়েতের শাসককে অধীনতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। চুক্তি অনুযায়ী কুয়েত ব্রিটেনের প্রোটেক্টরেটে পরিণত হয়। বিদেশে ব্রিটেনের অনুমতি ব্যতীত কোনো দূত পাঠানো নিষিদ্ধ হয়।
আফ্রিকার মুসলিম অঞ্চলগুলোতে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা থেকে লিবিয়া অবশিষ্ট ছিল। ইতালি ওই দেশটির প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে ১৯১১ সালে রাজধানী ত্রিপোলি ও বারকাহতে নৌ আক্রমণ চালায়। তুর্কি খলিফার দুর্বল সেনাবাহিনী ত্রিপোলিতে ইতালি আগ্রাসন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে লিবিয়ার সমস্ত উপকূল ইতালির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ১৯১৪ সালে ব্রিটেন ইরাকে আক্রমণ চালায়। সহজে বসরা, আমারাহ ও নাসিরিয়া দখলে নেয়। এরপর তারা বাগদাদে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তুর্কি খলিফার সাথে ১৯১৬ সালে জোরপূর্বক চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা দখল করে নেয়। এ সময় (১৯১৭) ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ১৯১৫ সাল নাগাদ সৌদি আরব ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীনের বাইরে ছিল। এ বছর বাদশাহ আবদুল আজিজ ব্রিটিশদের সাথে এ মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, কোনো দেশ সৌদি আরবে আক্রমণ চালালে ব্রিটেন তাকে সাহায্য করবে। এ চুক্তি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement