১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`

সংস্কারে দরকার রাজনৈতিক সায়

-

শেষতক সংস্কার কতটুকু হবে, না হবে তা এখনো ভবিষ্যৎ। প্রস্তাব বা সুপারিশ মোটেই সিদ্ধান্ত নয়। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা পড়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো জাতির কাছে সনদ হয়ে থাকল। এ রেকর্ড থেকে সরে যাওয়া সহজ হবে না। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত ব্যক্তিরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান। দেশবরেণ্য। কারো কারো কাজের জ্যোতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বেও আলোচিত।

এরই মধ্যে তাদের দেয়া প্রস্তাবনা নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। চুলচেরা বিশ্লেষণও হচ্ছে। কিছু বিষয় নিয়ে রয়েছে সমালোচনাও। আর এ ধরনের ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, মতামত, ভিন্নমত খুব জরুরি। যা সিদ্ধান্তগ্রহণে সহায়ক হবে। বিভিন্ন কমিশনের দেয়া সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পরই আসবে পদক্ষেপ। তখন অন্তর্বর্তী সরকার কাক্সিক্ষত সংস্কার শুরু করবে। আর সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে রাজনৈতিক তথা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, তাও হবে সনদের মাধ্যমে। ইতিহাসের এ অংশ মেনে নিয়েই এগোতে হবে সবাইকে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীজনরা খুব বুঝেশুনেই নতুন বাংলাদেশের কাঠামো গড়ার প্রত্যয়ে সংস্কার কমিশনের সদস্যদের নিযুক্ত করেছে। কমিশন প্রধান ও সদস্যরাও তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা তথা চব্বিশের বিজয়ের স্পিরিট ধারণ করে এসব প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছেন। আবার এই প্রতিবেদনই শেষ বা চূড়ান্ত নয়। একটি অধ্যায়ের শুরু মাত্র। স্বপ্ন ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী তার যে যাত্রা, সেটা শুরু হলো। এর বড় একটি অংশ এই প্রতিবেদনের প্রতিফলন। এটি অবশ্যই বাইরে থেকে চাপানো কোনো জিনিস নয়, ভেতর থেকে উদ্ভূত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ কমিশনগুলোতে সমন্বয়সহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য এক মাস সময় দেয়া হয়েছে। তবে জানুয়ারির মধ্যেই এই চার কমিশনসহ মোট ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জানিয়ে দেয়া হবে।

বাকি থাকবে বিচার বিভাগ সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবগুলো কবে কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হবে, তার একটি রূপরেখা আসতে পারে দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তাদের সংস্কার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’

দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে। এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে। এ ছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি...’ এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) “বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশী’ বলে পরিচিত হবেন” হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে। এগুলোর প্রতিটিই সংবিধানে বড় পরিবর্তনের সুপারিশ।

ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। একজন দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতাও হতে পারবেন না। সংবিধানের মূলনীতি ও সংসদের কাঠামোতে পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো, মৌলিক অধিকারের পরিসর বাড়ানো, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সংবিধানের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।

বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রয়েছে চার মূলনীতি-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এবারের সুপারিশ করা পাঁচ মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার সুপারিশ করছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কথা তো রয়েছেই। বিদ্যমানে ৩৫০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ জন সদস্য নির্বাচিত হন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে। সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। আইনসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে।

৪০০ আসন নিয়ে হবে নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স চার বছর কমিয়ে ২১ বছর করা, দু’জন ডেপুটি স্পিকার রাখা; যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। একজন সংসদ সদস্য একই সাথে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানের যেকোনো একটির বেশি পদে থাকতে পারবেন না।

আরেকটি বড় সুপারিশে অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। আইন সভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সব সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাকি ৫টি আসন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবেন। যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। আর উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারদলীয় সদস্য ব্যতীত উচ্চকক্ষের অন্য সব সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর। সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যেকোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন, তার জন্য এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের কথাও রয়েছে। পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে কমিশনগুলোর সুপারিশে। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবে। কমিশনপ্রধানরা এক মাস সময় চেয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তারা তাদের লিখিত মতামত দিয়েছে। সেখানে সবার জন্যই মূল উপজীব্য চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট। সেই আলোকে এখন পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও সিকোয়েন্সের অপেক্ষা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement