২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সিরিয়ায় স্বৈরশাসকের পতন

-

সিরিয়া মুসলিম ঐতিহ্যের পাদপীঠ, প্রাচীন নগরী দামেস্ক এর রাজধানী। বিশ্বের প্রাচীনতম শহর আলেপ্পো তার সুর্বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ দেশের বৃহত্তম নগরী। সেই সিরিয়ায় এবার ২৪ বছরের স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতন ঘটেছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিল গত ১৩ বছর ধরে। সেখানে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কারণে স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে। বিদ্রোহীগোষ্ঠী এইচটিএস একাধিক শহর দখলের পরে রাজধানী দামেস্ক দখল করে। ফলে স্বৈরশাসক পলায়ন করেন রাশিয়াতে। বিমানযোগে তিনি সেখানে যান। রাশিয়া তাকে আশ্রয় দেয়ার কথা স্বীকার করেছে। বাশার আল আসাদ যদিও বলেছেন, তার দেশত্যাগের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েছেন দেশত্যাগে। জনতা তার পিতা ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হাফিজ আল আসাদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করে।

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতনে ইসরাইলের হয়েছে পোয়াবারো। ইসরাইল পরমাণু স্থাপনাসহ সিরিয়ার আট শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করেছে। এদিকে তুরস্ক ও সিরিয়া সরকারসমর্থক কুর্দিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। মার্কিন নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ফ্লোরিডাস্থ পামবিচের বাসভবনে বলেছেন, তুরস্কের উপরে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে. ব্লিঙ্কেনের সাথে আলাপ করেছেন কুর্দিদের দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে। এ দিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সিরিয়া দখল করার বিরাট জায়গা সফর করেছেন এবং বলেছেন, একটি নতুন বাহিনী স্থায়ীভাবে মোতায়েন না করা পর্যন্ত সেখানে ইসরাইলের দখলদারি অব্যাহত থাকবে। ইসরাইল সিরিয়ার কুনেত্তা প্রদেশে ১৫ মাইল এগিয়ে গিয়েছে। এছাড়া সিরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনার উপর হামলা করেছে। ইসরাইল সিরিয়া দখল করতে চায়। সে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে গোলান মালভূমি সিরিয়ার কাছে হারানো সহ্য করতে পারে না। আমাদের দেশে যেমন সদ্য পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে, ঠিক তেমনি সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ ২৫ কোটি ডলার পাচার করেছেন রাশিয়ায়। এ ছাড়া এ অর্থ দিয়ে গোপনে রাশিয়ায় সম্পদ গড়েছেন বলেও জানা যায়। বাশার আল-আসাদ সরকার ২০১৮-১৯ সালে সিরিয়ায় বিদেশী মুদ্রার ব্যাপক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও প্রায় দুই টন ওজনের ১০০ ডলারের নোট ও ৫০০ ইউরোর নোট মস্কোর অনুরোধে বিমানবন্দরে পাঠিয়েছিলেন, যা বর্তমানে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রাশিয়ার ব্যাংকগুলোতে জমা রাখা হয়েছিল। এই অস্বাভাবিক অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, রাশিয়া আসাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং মস্কোর সামরিক সহায়তায় আসাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন সিরিয়ার জন্য অর্থ জমা রাখার অন্যতম প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছিল রাশিয়া।

বাশার আল-আসাদের বিরোধীরা ও পশ্চিমা সরকারগুলো তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়ার সম্পদ লুট ও যুদ্ধাপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ এনেছে। রাশিয়ায় অর্থ প্রেরণের ঘটনাগুলো ঘটে যখন সিরিয়া ক্রেমলিনের সামরিক সহায়তার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল। এ সময় সিরিয়ায় রাশিয়ার ভাড়াটে সেল সংস্থা ভাগনার গ্রুপের সদস্যরাও যুদ্ধ করেছে। এ সময়ে আসাদ পরিবারের সদস্যরা মস্কোতে বিলাসবহুল সম্পদ কেনার হিড়িকে নামেন। ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রাচ্যবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড শেঙ্কার বলেন, ‘এ অর্থ স্থানান্তর অবাক করার মতো নয়। আসাদ প্রশাসন নিয়মিতভাবে দেশের বাইরে অর্থ পাঠাত, যার উদ্দেশ্য ছিল তাদের অবৈধ সম্পদ ও দেশের ঐতিহ্য বিদেশে সুরক্ষিত রাখা।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসনের উচিত ছিল তাদের অর্থ এমন নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে তারা তা ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী ও তাদের ঘনিষ্ঠ চক্রের বিলাসী জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে পারবে।’

সিরিয়ান লিগ্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ গবেষক আইয়ান হামিদ বলেন, ‘রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে আসাদ প্রশাসনের অর্থের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে আসছে। ২০১১ সালে আসাদ সরকার যখন বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করে তখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলার জন্য মস্কো আল-আসাদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।’ লন্ডনভিত্তিক সিরিয়া বিশ্লেষক মালেক আল আব্দেহ বলেন, ‘সিরিয়া রাষ্ট্র হয়তো রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য রাশিয়াকে অর্থ প্রদান করছিল।’

রফতানি তথ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইপমোর্ট জিনিয়াসের কাছে থাকা রাশিয়ার বাণিজ্য রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৩ মে আসাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ১০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ১০০ ডলারের নোট নিয়ে একটি বিমান সিরিয়া থেকে মস্কোর ডনুকোভো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ২০ মিলিয়ন ইউরো সমমূল্যের ৫০০ ইউরোর নোট নিয়ে গিয়েছিল মস্কোতে। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২১টি ফ্লাইটে মোট ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি মূল্যের নগদ অর্থ পরিবহন করা হয়েছিল। রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৮ সালের আগে সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রুশ ব্যাংকগুলোর মধ্যে এমন কোনো নগদ অর্থ স্থানান্তর হয়নি। সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশী রিজার্ভ প্রায় শূন্য থাকা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থে লেনদেন করতে হতো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাশিয়া থেকে গম কিনত এবং নোট ছাপানো ও প্রতিরক্ষা খাতের খরচে রাশিয়াকে নগদ অর্থ প্রদান করত। তবে রেকর্ড মতে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দামেস্ক থেকে ব্যাংক নোট গ্রহণ করা দু’টি রুশ ঋণদাতা ব্যাংক বিগত ১০ বছরের মধ্যে সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশ থেকে এমন নগদ অর্থের চালান গ্রহণ করেনি।

এ দিকে, জাতিসঙ্ঘের সতর্ক বার্তা এসেছে সিরিয়ার ব্যাপারে। সিরিয়ায় যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি বলে সতর্ক করেছেন দেশটির বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন। গত মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গেইর পেডারসেন বলেন, ‘একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার আগে গত দুই সপ্তাহে সেখানে ব্যাপক সঙ্ঘাত হয়েছে।’ সেখানে যুদ্ধ উত্তেজনা বৃদ্ধি বিপর্যয়কর হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। তিনি দেশটির উত্তরাঞ্চলে তুরস্ক সমর্থিত সশস্ত্র দল সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) এবং কুর্দিদের নেতৃত্বে সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।

গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে এসএনএর যোদ্ধারা এসডিএফের কাছ থেকে সিরিয়ার উত্তরের শহর মানবিজ দখল করেন। এরপর তারা ইউফ্রেতিস নদীর ধারে পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এ দিকে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পেডারসনের বক্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, উত্তর সিরিয়ায় যে যুদ্ধবিরতি চলছে, সেটি এই সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মিলার আরো বলেন, ‘আমরা সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ পেতে এসডিএফের সাথে, তুরস্কের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।’ কোনো পক্ষই সিরিয়ার সঙ্ঘাত দেখতে চায় না।

এ দিকে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দূতাবাসে ১২ বছরের মধ্যে গত মঙ্গলবার প্রথম পতাকা উড়িয়েছে ফ্রান্স। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে একযুগ ফরাসি দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর এখন সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তৈরি এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার হওয়ার মধ্যে ফ্রান্স আবার তাদের দূতাবাসে পতাকা উড়াল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের নেতাদের সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত রয়েছে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।

ইরান বরাবরই সিরিয়াকে সমর্থন করা নিয়ে এ দেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement