শিক্ষাব্যবস্থা : পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা
- ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
- ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:২১
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অর্জনের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারিনি। অদক্ষ পরিচালনায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বারবার শুধু হোঁচটই খাচ্ছে। কিন্তু যাত্রা মোটেই খারাপ ছিল না। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় আর হাতেগোনা কিছু স্কুল-কলেজ নিয়ে যে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়েছিল তার অগ্রভাগে ছিলেন ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা। স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান বুক সোসাইটির (পরবর্তীকালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি) কর্ণধার ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) যা আজ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ডিজি এবং ডিজি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা। তার পরে ডিপিআই ছিলেন আরেক কিংবদন্তি সাবেক ভিসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক।
এমনসব মহীরুহের হাতধরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার যাত্রা হয়েছিল।
১৯৬২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলের নিয়ম অনুসারে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে একই বিষয়গুচ্ছ- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে হতো, অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একমুখী (ঁহরঃৎধপশ)। বোর্ড ছিল একটিই- পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ড। পরে ১৯৬৩ সাল থেকে চালু হলো এসএসসি পরীক্ষা। এর জন্য নবম শ্রেণী থেকে বিজ্ঞান ও মানবিক দু’টি পৃথক শাখায় পাঠদানের ব্যবস্থা শুরু হয়। টেক্সট বুক বোর্ডের অধীনে রচিত ও মুদ্রিত প্রতিটি বিষয়ের বই যেমন- বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, পৌরনীতি ইত্যাদি ছিল নির্ভুল এবং চমৎকার বিষয়সমৃদ্ধ। আর তখনই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সৃষ্টি হলো চারটি শিক্ষা বোর্ড- ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোর। কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে গিয়ে অবশ্য শুধু বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক ছিল বোর্ড প্রণীত। বিজ্ঞান বিষয়ের মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক এ দেশে তৈরি না হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এ দেশের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে প্রখ্যাত ভারতীয় বইগুলো যেমন- বোস অ্যান্ড চ্যাটার্জির পদার্থবিজ্ঞান, লাডলি মোহন মিত্রের রসায়ন, দাস অ্যান্ড মুখার্জির ম্যাথমেটিকস ইত্যাদি পড়ানো হতো।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই কেবল কারিকুলাম-ভিত্তিক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর শুরুটি খুব মসৃণ হয়নি। আশির দশকের শুরুতে গঠিত ন্যাশনাল কারিকুলাম কমিটি মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য একটি কারিকুলাম প্রণয়ন করে। তবে টেক্সটবুক বোর্ড ও কারিকুলাম সংস্থার বিরোধের জেরে সিদ্ধান্তহীনতায় নতুন কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে ১৯৮৩ সালে শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময় কেটে গেলেও শুরুতেই নতুন কারিকুলাম হোঁচট খায়। এরপর টেক্সটবুক বোর্ড ও কারিকুলাম সংস্থাকে একীভূত করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোড (এনসিটিবি) গঠনের মাধ্যমে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলে জটিলতা দূর হয় এবং পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ নির্বিঘ্ন হয়।
১৯৯১ সালে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে মনোযোগ দেয়। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সুদক্ষ শিক্ষা সচিব ইরশাদুল হককে আহ্বায়ক করে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় কারিকুলাম কমিটি গঠন করা হয়। তিনি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের দক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে ৪৪টি বিষয়ভিত্তিক কমিটি গঠন করেন যার প্রতিটিতে আটজন করে সদস্য নেয়া হয়। সব বিষয়ের কারিকুলাম প্রণয়ন ও অনুমোদনের পর ১৯৯৫ সাল থেকে এ কারিকুলাম অনুসারে এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশের ব্যবস্থা করে যা ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এর মধ্যে ২০১২ সালে আবার নতুন কারিকুলাম প্রণীত হয়, যা ২০১৩ সাল থেকে কার্যকর হয়। আর সেই কারিকুলাম অনুসারে প্রণীত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক এখনো চললেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ২০২০ সাল থেকে আবার নতুন কারিকুলামের প্রবর্তন হয়। এ কারিকুলাম অনুসারে ২০২২ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য বিবর্তনবাদ, শরিফ ও শরিফার গল্প, লেসবিয়ান তত্ত¡ অন্তর্ভুক্তিসহ নানাবিধ বিতর্কিত বিষয়বস্তু উপস্থাপন, ইতিহাস বিকৃতি ও সর্বশেষ মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুধীজনদের তীব্র আপত্তির মুখে বহুবার পাঠ্যপুস্তক/বিষয়বস্তু পরিবর্তন করেও শেষরক্ষা হয়নি।
বিগত সরকারের নানা অবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও মতবাদ সন্নিবেশ করা এবং সামাজিক/ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী নানা বিষয় কোমলমতি শিক্ষার্থীর মনকে কলুষিত করার মতো অসংখ্য অভিযোগে এনসিটিবিকে বারবার বিব্রত ও জনসমক্ষে হেয় হতে হয়। এর সাথে যুক্ত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামধারী লেখকের বিষয়বস্তুর চৌর্যবৃত্তি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী পাঠ্যবস্তু উপস্থাপন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নামে উদ্ভট শিখনধারা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রবর্তন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে ক্ষুব্ধ করে ।
কারিকুলাম পরিমার্জন ও পাঠ্যপুস্তক উন্নয়নের এসব পালাবদলের মধ্যে ২০০১-০৬ সময়কালে শিক্ষা সংস্কারের ব্যাপক উদ্যোগ ছিল উচ্চাভিলাষী ও ব্যতিক্রমধর্মী। এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রথমে ঝঊঝওচ ও পরে ঝঊঝউচ প্রকল্পের মাধ্যমে চারটি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাস্তবায়নের সামগ্রিক দায়িত্বে ছিল এনসিটিবি। এগুলো হলো-
১. কারিকুলাম পরিমার্জন; ২. পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার; ৩.শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন (ঝপযড়ড়ষ ইধংবফ অংংবংংসবহঃ, ঝইঅ) পদ্ধতির প্রবর্তন ও
৪. পাঠ্যপুস্তক বেসরকারিকরণ
কারিকুলাম পরিমার্জনের আওতায় ‘একমুখী শিক্ষাক্রম’ প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থায় নবম শ্রেণী থেকে শিক্ষাধারা বিভাজন মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পরিবর্তে সব শিক্ষার্থীর জন্য একই বিষয়গুচ্ছ (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ বিদ্যা, সাধারণ বিজ্ঞান ইত্যাদি) প্রস্তাব করা হয়। কেবল উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী থেকেই শাখা বিভাজন-ভিত্তিক শিক্ষা শুরু হবে। এ প্রস্তাবের মূল যুক্তি ছিল অষ্টম শ্রেণী পাস করা একজন শিক্ষার্থীর নিজের ক্যারিয়ারের ধারা পছন্দ করার মতো বয়োপ্রাপ্তি হয়তো হয় না। তা ছাড়া দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবারই ইতিহাস-ভূগোলসহ সব বিষয়েরই কিছু ন্যূনতম জ্ঞানার্জন করা পরবর্তী জীবনের জন্য কার্যকর বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী এটিকে বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে শিক্ষার্থীদের দু’বছর পিছিয়ে দেয়ার শামিল এবং জাতীয় জীবনে দু’টি বছর বিনষ্ট করার চক্রান্ত বলেও প্রচার করলেন।
ঝইঅ কর্মসূচির প্রস্তাবনা ছিল- স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা এবং এসএসসি পরীক্ষার ৭০ শতাংশ নির্ধারিত থাকবে লিখিত পরীক্ষায় এবং ৩০ শতাংশ থাকবে সারা বছরের শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষকদের মূল্যায়নের ওপর। আর এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ ৩০ শতাংশ নেয়া হবে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঁচ বছরের শ্রেণী মূল্যায়নের গড় থেকে। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো, অনেকেই এ পদ্ধতির বিরোধিতা করল। যুক্তি হলো আমাদের দেশের শিক্ষকরা এখনো নৈতিকতার এমন পর্যায়ে পৌঁছাননি যাতে একটি নির্মোহ মূল্যায়ন হবে। এ কথায় যুক্তি যে ছিল না তা নয়। তবে কথা হলো- তাহলে জাতি কি কিছু লোভী মানুষের অনৈতিক চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করবে? নাকি নীতিহীন মানুষগুলোর অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল খুঁজবে?
সংস্কার প্রস্তাবের তৃতীয় বিষয়টি ছিল নতুন সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন। এ পদ্ধতিতে দু’ধরনের প্রশ্নের প্রস্তাব করা হয়। এতে প্রতি বিষয়ে ২৫-৩০ নম্বরের সৃজনশীল এমসিকিউ এবং পাশাপাশি মূল অংশ হলো ৭০-৭৫ নম্বরের কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। প্রচলিত মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর ‘বর্ণনা করো/ব্যাখ্যা করো’ ধরনের প্রশ্নের পরিবর্তে পাঠ্যপুস্তক থেকে অথবা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুকে নির্ভর করে প্রতিটি প্রশ্নে একটি উদ্দীপক/ংঃবস দেয়া থাকবে। তা থেকেই কিছু জ্ঞাননির্ভর, কিছু অনুধাবনমূলক ও কিছু সৃজনশীলতা-ভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী উত্তরের প্রশ্ন দেয়া থাকবে। শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার মাত্রা অনুসারেই একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের উপস্থাপনা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এ প্রশ্ন। অর্থাৎ মুখস্থ করা একই উত্তর সবার কাছ থেকে নয়, জাতীয় জীবনে একজন সৃজনশীল মানুষ তৈরি করাই ছিল এ ধরনের প্রশ্ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য।
চতুর্থ ও শেষ সংস্কার প্রস্তাব ছিল- বোর্ড কোনো টেক্সট বই প্রকাশ করবে না। সব বই বেসরকারি খাতে প্রকাশের সুযোগ দেয়া হবে, যাতে প্রতিযোগিতার কারণে একই বিষয়ে একাধিক এবং উন্নত মানের বই পড়তে পারবে শিক্ষার্থীরা। এ উদ্যোগের বিরুদ্ধেও নেমে পড়েন অনেকে এই বলে যে, বই প্রকাশ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। ২০০১-০৬ শাসনামলে তিন-চার বছর ধরে টেক্সটবুক বোর্ডের উদ্যোগে সারা দেশে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে বিভাগীয় সদর দফতর ও ঢাকায় অসংখ্য মতবিনিময় সভা ও ওয়ার্কশপ করে ব্যাপকভাবে মতামত সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি ঞছও (ঞবধপযরহম ছঁধষরঃু ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ) প্রকল্পের অধীনে লক্ষাধিক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেলাপর্যায় পর্যন্ত ঞবধপযবৎং ঞৎধরহবৎ প্যানেল প্রস্তুত করে রাখা হয় যাতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। টেক্সটবুক বোর্ডের এবং ঝঊঝউচ প্রকল্পের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ টিম দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফর করে শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয় তারা বিষয়গুলো কতটুকু বুঝতে পেরেছে। অবাক করা ব্যাপার হলো, অন্য সব স্টেকহোল্ডারের তুলনায় শিক্ষার্থীদের ৎবংঢ়ড়হংব ছিল অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। জানা মতে, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশের শিক্ষা সংস্কারে এত বিশাল কর্মযজ্ঞ আর কখনোই নেয়া হয়নি। কিন্তু এত কিছুর পরও পরীক্ষা সংস্কার ছাড়া বাকি তিনটি সংস্কার প্রস্তাবই বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের প্রবল বিরোধিতার মুখে ২০০৬ সালে পরিত্যক্ত হয়। অর্থাৎ বিশাল জাতীয় অপচয়ের বিনিময়ে আমরা শুধু বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই যাচ্ছি।
দুঃখজনক হলো, আজ পর্যন্ত ৫০ বছরে একটি সর্বজনীন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা আর সময় বা জনগণের অর্থ কোনোটিই অপচয় করতে পারি না, এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিভাবে? সবার আগে আমাদের প্রয়োজন একটি ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ যার আলোকে চলবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতি নয়। তৃণমূল থেকে সংশ্লিষ্ট সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে জনগণের শিক্ষানীতি। এর জন্য প্রয়োজন প্রথমে মেধাবী, প্রাজ্ঞ ও গতিশীল নবীন-প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার সমন্বয় থাকতে হবে। শুধু জাতির প্রয়োজনে পেশার বাইরে দীর্ঘ দিন বিনা সম্মানীতে সেবা দিতে ইচ্ছুক এমন মহাজনরাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন কমিশনের সদস্য হিসেবে। দ্বিতীয়ত, কমিশনের সুপারিশগুলোর ওপর দেশব্যাপী আলোচনা সভা/ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সর্বজনীন মতামত সংগ্রহ করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ‘জাতীয় টাস্কফোর্স’ গঠন করা যেতে পারে। অর্থাৎ পরবর্তী পর্যায়ের সব ধরনের বিতর্ক এড়িয়ে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে যেন আমরা একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।
এ প্রসঙ্গে আমি মোটাদাগে কয়েকটি বিনয়ী প্রস্তাব পেশ করতে চাই :
১. শিক্ষা হতে হবে সাম্যের ভিত্তিতে, সর্বজনীন ও প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক।
২. প্রাথমিক শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
৩. মাধ্যমিক শিক্ষা সপ্তম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত।
৪. একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাকে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতিক্ষেত্র রূপে গড়ে তোলা যায়।
৫. প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা হওয়া উচিত অনেকটা বিনোদনমূলক ও ভারমুক্ত।
৬. পাঠ্যপুস্তক-নির্ভর লেখাপড়ার বাইরে শ্রেণিবহিভর্ূত বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন- ক্রীড়া, বিতর্ক, বিভিন্ন ধরনের খুঁটিনাটি গৃহকর্ম, মেরামত কাজ, পরিবেশ পঠন, পরিচ্ছন্নতা কাজ ইত্যাদিকে বিভিন্ন শ্রেণী উপযোগী হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া মেধা বিকাশের সুযোগ হয় এমন কিছু বিষয় যেমন- উপস্থিত উপস্থাপনা, বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যা সমাধান, নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জটিল আলোচনা ইত্যাদি শ্রেণিকার্যক্রমে থাকতে পারে। নিজের পারদর্শিতা দেখাতে পারে এমন প্রজেক্ট হতে পারে। অর্থাৎ পড়ালেখা যেন বিরক্তিকর না হয় এবং শ্রেণিকক্ষ বৈচিত্র্যময় ও উপভোগ্য হয়।
৭. প্রতিটি শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা থাকবে। শুধু দশম শ্রেণী ও দ্বাদশ শ্রেণী শেষেই বোর্ড পরিচালিত আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন হতে পারে। বোর্ডের লিখিত পরীক্ষার সাথে শ্রেণিভিত্তিক আনুক্রমিক মূল্যায়ন সংযোজন করেই একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন করা বাঞ্ছনীয়।
৮. বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে যেন বর্তমানের মতো একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি না থাকে। এভাবে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ও বইয়ের ভলিউম দুটোই কমানো যায়।
৯. শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনে সবচেয়ে বড় যে কাজটি করতে হবে তা হলো- কারিকুলাম পুনর্বিন্যাস। কারিকুলামের পুরো খোলনলচে পাল্টানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। এটি চলমান প্রক্রিয়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত প্রয়োজন অনুসারে সংশোধন-পরিমার্জন করতে হয়। আর সে অনুসারে একটু একটু করে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হয়। এতে নীরবে উন্নয়ন চলবে কিন্তু কোথাও কোনো আঘাত অনুভূত হবে না। আর এ কাজটি করবে এনসিটিবির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞরা।
১০. কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একটি দক্ষ কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ পুল থাকতে হবে। গত তিন দশকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় ঝঊঝওচ, ঝঊঝউচ, ঞছও-সহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের একটি বেশ ভালো কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদল গড়েও উঠেছিল; কিন্তু বিগত শাসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের লোকজনকে এনসিটিবিতে পদায়ন করতে গিয়ে এসব বিশেষজ্ঞের অনেককে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের আবার ফিরিয়ে এনে এনসিটিবিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে নতুন নতুন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ তৈরির উদ্যোগও নিতে হবে।
১১. সাধারণ শিক্ষার মতো কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এ দু’টি শাখার কারিকুলাম অনুরূপভাবে বিন্যাস করতে হবে।
১২. ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ না করে এনসিটিবির মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করতে হবে।
১৩. বিদেশে চাকরির সুবিধা হাত করতে হলে ইংরেজির পারদর্শিতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজনে একটি পর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি কথোপকথন চর্চার ব্যবস্থা করা যায়।
১৪. শিক্ষকদের বেতনকাঠামো পুনর্বিন্যাস এবং একই সাথে নানা ধরনের প্রণোদনামূলক প্যাকেজ প্রবর্তনও জরুরি।
মোট কথা, শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করার সব উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা যদি জাতীয় অগ্রগতিতে কোনো কাজেই না আসে তবে সেই শিক্ষা দিয়ে কী হবে? যত তাড়াতাড়ি আমরা একটি কার্যকর জীবনঘনিষ্ঠ ও দক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি ততই সুগম হবে আমাদের জাতীয় পথ চলা, সুদৃঢ় হবে জাতির ভবিষ্যৎ।
লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং প্রাক্তন ডিজি, নায়েম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা