২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমাদের ভূস্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি দৃশ্য - ছবি : সংগৃহীত

আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার ধর্মীয় ৪২(১) (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। তার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণ দেখিয়ে তিন জেলায় এবার কঠিন চীবর দান উৎসব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ।

হুহু করে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। বিশ্বের দুর্গম স্থানগুলো পরিণত হচ্ছে ভূস্বর্গে। ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈনিকরা বিদ্রোহীদের যে দ্বীপে নির্বাসন দিয়েছিল সে দ্বীপের নাম ‘কালাপানি’। সেই কালাপানি (আন্দামান) দ্বীপপুঞ্জই এখন নবদম্পতির হানিমুনের প্রিয় স্থান। মনুষ্যবাসের অনুপযোগী স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে সুখী দেশের তালিকায়। শত সম্ভাবনা থাকার পরও পিছিয়ে পড়েছি আমরা। শুধু পিছিয়ে পড়া নয়, ‘পাহাড়ি’ ও ‘বাঙালি’ দুই স্রোত এক হতে না পারার কারণে চরম নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চয়তার উভয় পক্ষ।

পাহাড়িদের ‘আমি পারি আমি পারব’ উক্তিটির সত্যতা পেয়েছিলাম। সাতকানিয়া থেকে ৫২টি সিএনজি করে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই ৫২টি সিএনজি করে সেই পথেই আবার সাতকানিয়ায় ফিরতে হবে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে দমকা হাওয়াসহ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। কোয়ান্টাম আয়োজিত শেষ সভা শেষ করতেই দিন শেষ। বারবার সাবধান করা হয়েছে ৫২ সিএনজি যেন এক সাথে যায়। যাত্রার মিনিট দশেক পরই সিএনজি থেমে গেল। রাস্তা বন্ধ। আসার পথে রাস্তার যে অংশ পাহাড় কেটে করা হয়েছিল, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সে অংশের ২০০২৫ ফুট এক দিকের পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে গেছে। বরাবরের মতো এঁটেল কাদামাটির ওপর দিয়ে সিএনজি চলা তো দূরের কথা, হেঁটে চলাই কঠিন। পুরুষ ছাড়াও প্রত্যেক সিএনজিতে রয়েছেন দু’-একজন মহিলা। দুই ঘণ্টার পথ, কথা ছিল দিনের আলো থাকতেই পৌঁছতে হবে সাতকানিয়া। আমাদের আটকে পড়ার খবর যায় স্কুলে। খবর পেয়েই চলে আসে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। প্রতি সিএনজিতে পাঁচজন করে যাত্রী। যাত্রীদের না নামিয়ে রাস্তা থেকে ওপরে তুলে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে কাদামাটির স্থানটা পার করে দিলো। বেঁটে-খাট হালকা-পাতলা ওদের শরীর যেন ইস্পাত আর শক্তি যেন অসুরের। শক্তির সাথে ব্রেনও ছিল অসাধারণ।

‘দুর্গম এলাকায় ২০০১ সালে স্কুলটি যখন চালু হয় তখন এলাকাটি ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এক শিক্ষার্থীর নাম শৈক্য চিং। বান্দরবান থেকে জিপে রুমা তিন ঘণ্টার পথ। রুমা বাজার থেকে হেঁটে খাল। তারপর পাহাড়ি সঙ্কীর্ণ পথ। এর পর ডোবা-খন্দক ও ঝোপঝাড় পেরিয়ে আরো দুই ঘণ্টার পথ হেঁটে কেম্বোয়া পাহাড়। পাহাড়ের দুর্গম গ্রামটিতে বাড়ি শৈক্য চিংয়ের। চিকিৎসার অভাবে বড় ছেলেটি মারা যাওয়ার পর মেঝো ছেলে শৈখ্য চিংকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছিলেন তার বাবা। ‘এতদূরে ছেলেকে পাঠানো ঠিক হচ্ছে না, লেখাপড়া করে কী হবে? শেষে তো জুম চাষই করতে হবে।’ এ রকম অনেক কথা শুনতে হয়েছিল শৈক্যের বাবাকে। যাবতীয় বাধা উপেক্ষা করে সেদিন যা করেছিলেন তিনি তা-ই বদলে দিয়েছে শৈক্যের জীবন। শৈখ্য চিং এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। প্রিয় বিষয় অঙ্ক। ইচ্ছে বুয়েটে পড়বে। কাজ করবে প্রযুক্তি নিয়ে।’ (প্রকাশ, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, দৈনিক নয়া দিগন্ত)।

আমাদের একদিকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা আর অপরদিকে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পশ্চিমে সাগর। সাগর ঘেঁষে বিশে^র বৃহত্তর সমুদ্রসৈকত। সাদা বালুর এত দীর্ঘ সৈকত বিশে^ আর কোথাও নেই। আগে কখনো বন বিভাগের সাজানো কাঠগাছ, কখনো পাহাড়, কখনো বনপাহাড় এসব সাজানো গাছের ফাঁকে ফাঁকে প্রকাণ্ড সাইজের একেকটি গাছ দৈত্যের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আছে শাল, সেগুন, গর্জন, গামারি, শীলকড়ই, তেলসুর, চাম্বুল, নাগেশ্বর, অর্কেডিয়া, রাবার, সিভিট, কনক, অশ্বত্থ, লোহাকাঠ, কাজুবাদাম, ঢাকিজামসহ প্রচুর ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের মহাসমারোহ। শত বছরের পুরনো গাছও এখানে রয়েছে। প্রাকৃতিক ও বন বিভাগের সৃজিত এসব মূল্যবান কাঠবাগান যেন শেষ হতে চায় না। আমাদের দেশে এত পরিমাণ মূল্যবান কাঠগাছ আছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বনের ফাঁকে ফাঁকে ফসলের জমি, বিল ও জলাভূমি। বিল ও জলাভূমিতে ফুটে রয়েছে লাল-সাদা শালুক ফুল, জলচর বিহগ-বিহগী, চিংড়ি মাছের হ্যাচারি, পাহাড়িদের বাড়িঘর, তাল সুপারি নারকেল বাগ, পদ্মদীঘি, পানের বরজ, ইটভাটা, লালমাটির টিলা, মাটির দেয়াল ঘর, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও হাট-বাজার। এসব দেখতে দেখতে অহঙ্কারে মন ভরে ওঠে। বন বিভাগের সাজানো বাগান ও মানুষের তৈরি মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ছাড়াও প্রকৃতির বিছিয়ে রাখা পাহাড়, জঙ্গল, খাল-বিল, ঝরনা, অসংখ্য ডোবা-নালা, রয়েছে নদী সাঙ্গু, শঙ্খ, মাতামুহুরী, বাঁকখালী কর্ণফুলী। প্রধান নদী কর্ণফুলী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে লুসাই নাম ধারণ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কর্ণফুলী নাম ধারণ করেছে। দু’পারের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন এসব নদী। শঙ্খ নদীকে কেন্দ্র করে দু’পারে কালাপুর বাজার, আইশশ্যা খালি বাজার, মুরালি ঘাট, চানখালি বাজার, মাস্টার হাট, ইউনুস মার্কেট, খোদার হাট, খাগরিয়া ভোর বাজার; লোহার পুকুর বাজার, মইশমুড়া, দোহাজারি, বোমাং হাট, নয়ার হাট, বিশ্বের হাট, ধোপাছড়ি বাজার গড়ে উঠেছে। এ নদী দিয়ে নেমে আসে পাহাড়ি কৃষকদের দ্রব্যসামগ্রী। পাহাড়িদের মধ্যে অধিকাংশই মারমা। তাদের আদিবাস ছিল মিয়ানমার। সে কারণে তাদের মারমা বলা হয়। বয়সে থুত্থুরে হলেও এ শঙ্খ অসংখ্য অপকর্ম করে বসে মাঝে মাঝে। গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে জনপদ বিলীন করে দেয়। তখন ভয়ঙ্কর থাকে এর মূর্তি।

মানুষের তৈরি বৈচিত্র্য দেখার পর মানুষ নিজে কত বৈচিত্র্য তা দেখার জন্যও আসতে হয় এই পার্বত্য এলাকায়। বাংলাদেশে মোট উপজাতির অধিকাংশই পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বাস করে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজাতি চাকমা। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা- ওরা বাঁশের মাচা করে ভূমি থেকে উপরে বাড়িঘর করে বাস করে। তা ছাড়াও রয়েছে ম্রো, তঞ্চংগা, বোম, খুসি, চাক ইত্যাদি উপজাতি। এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ মুসলমান, বাকিরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও স্বকীয়তা। সাজেকের রুইলুই পাহাড় থেকে কংলাক পাহাড়ে ট্রেকিং করে যাওয়ার পথে মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড়ে আদিবাসীদের জীবন-যাপন, উৎসব ও সংস্কৃতির নানা উপকরণ উপভোগ করা যায়।

১৩টি রাজ্য নিয়ে মালয়েশিয়া। পাহাড়-জঙ্গল পূর্ণ একটি রাজ্যের নাম পাহাং। এক হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতায় মধ্য উপদ্বীপ মালয়েশিয়ার তিতিওয়াংসা পর্বতমালার অবস্থিত মাউন্ট উলুকালি। শ্বাপদসঙ্কুল ভয়ঙ্কর নির্জন বিদঘুটে অন্ধকার দুর্গম সেক্টর ছিল উলুকালি। উলুকালির নাম শুনলেই গা ছমছম করত। দিনের বেলায়ও এখানে লোকজন আসত না। এখন বিশে^র বিত্তশালীরা ছুটে আসে এই উলুকালি পাহাড়ের চূড়ায়। ইচ্ছাশক্তি ও সাধনার দ্বারা পরিত্যক্ত উলুকালি পাহাড়ই আজকের গেনটিং হাইল্যান্ড। প্রধান আকর্ষণ ওয়ার্ল্ড গেন্টিং রিসোর্টস, একটি পাহাড়ি রিসোর্ট যেখানে ক্যাসিনো এবং থিম পার্ক- সেখানে জুয়া খেলার অনুমতি রয়েছে আর রয়েছে আকাশচুম্বী ভবন। এ গেনটিংয়ের নির্মাণ ইতিহাসটাও গল্পের মতোই চমৎকার। অর্ধশতাব্দী আগে চীন দেশ থেকে মিস্টার টং নামে এক ভদ্রলোক ভাগ্যের সন্ধানে প্রায় শূন্য হাতে এ দেশে আসেন। টং সাহেব ঠিকাদারি ব্যবসায় করে একসময় প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হন। তিনি জীবনের শেষ দিনগুলো কোলাহলপূর্ণ শহরের বাইরে ভিন্ন পরিবেশে নিরিবিলি কাটাতে চাচ্ছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, কুয়ালালামপুর থেকে বেশ দূরে, জনমানবহীন অরণ্য ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় এ স্থানটি তার পছন্দ হয়। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা নির্মাণ করেন এই বিলাসবহুল অবকাশ কেন্দ্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণ দেখিয়ে তিন জেলায় এবার কঠিন চীবর দান উৎসব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ। কঠিন চীবর দান বৌদ্ধ ধর্মের একটি ধর্মীয় আচার উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমা পালনের এক মাসের মধ্যে যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে এই উৎসবটি পালন করা হয়। এক সূর্যোদয় থেকে আরেক সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সুতা কাটা থেকে শুরু করে বোনা, সেলাই, ধোয়া, শুকানোসহ দান করা কঠিন কাজটি সম্পন্ন করতে হয় বলে এই উৎসবেব নাম কঠিন চীবর দান উৎসব।

প্রবীণ বাঙালিরা অধিক বুদ্ধিমান লোকদের ‘ব্রিটিশ’ বলে। কারণ, মোগলরাজ প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ছেঁকে ৩০০ বছরে যা জমিয়েছিল ব্রিটিশরাজ গোটা কয়েকজন লোকের দ্বারা তা নিয়ে গেছে তিন জাহাজে করে। এখন আর নিতে হয় না, আমরাই দিয়ে আসি। আমাদের কোটিপতিদের কেউ কেউ যা আয় করে তা নিয়ে যায় তাদের কাছেই। মধ্য আয়ের ছোট্ট এই দেশ। এ দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে গেছে এর কিছু অংশ পার্বত্য তিন জেলার উন্নয়ন, রিসোর্টসহ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করলে মিস্টার টংয়ের মতো অমর হওয়াসহ নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণে কোনো ধর্মের কোনো উৎসবই বন্ধ থাকত না। নানা জাতিগোষ্ঠীর নানা ধর্মের নানা উৎসবের চিড়িয়াখানাসহ কাশ্মিরের মতো ভূস্বর্গ পেয়ে যেত পার্বত্য এলাকা। (অসমাপ্ত)

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল