ছাত্র-গণবিপ্লব, জাতীয় ঐক্যের উপাখ্যান
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২১:১৮
দীর্ঘদিন বিভাজিত জাতিসত্তার যন্ত্রণাময় অবস্থা থেকে মহান আল্লাহর রহমতে ছাত্র-জনতার অভ‚তপূর্ব বিপ্লবে দেশে নতুন ধারার সূচনা হয়েছে। বহু বছর পর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। তবে এই স্বস্তির নিঃশ্বাসের জন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। মা-বাবার সোনালি স্বপ্ন ভবিষ্যৎ সুখস্বপ্ন তপ্ত বুলেটের আঘাতে মিলিয়ে গেছে মুহূর্তেই। অনেক শিশু অকালে হারিয়েছে তার বাবাকে। অনেক স্ত্রী অকালে বৈধব্য বরণ করেছেন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জীবন্মৃত হয়ে নারকীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবারের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এরও আগে গত ১৬-১৭ বছর হাজার হাজার মানুষ বন্দী হয়েছেন, আয়নাঘরে হারিয়ে গেছেন, গুম হয়েছেন। দিনের পর দিন সংসার স্ত্রী সন্তান ফেলে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। বেদখল হয়ে গেছে অনেকের বাড়িঘর, সম্পত্তি, ব্যবসায়, অর্থবিত্ত। অপর দিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার মদদে অনেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। শূন্য হয়ে গেছে ব্যাংকগুলো। কোমর ভেঙে গেছে অর্থনীতির। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার পরও এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য অসার প্রমাণ করেছে। জনাব সিদ্দিকী সাহেবের আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা একেবারে মাঠে মারা গেছে। এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে আওয়ামী লীগ পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি সামলেছেন। এ ক্ষেত্রে কাদের সিদ্দিকীর আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে । এ যেন মক্কা বিজয়ের পরবর্তী দৃশ্যপট। ক্ষমার চেয়ে বড় গুণ আর নেই। মানবিক প্রেক্ষিত এবং মানবিকতা বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। এ ক্ষেত্রে মক্কা বিজয়-পরবর্তী মানবতার মহান নেতার কথা বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মহানবীর ব্যবহার, তার সাথীদের (সাহাবি) সাথে, প্রতিবেশীদের সাথে, অবিশ্বাসীদের সাথে- সবই বিস্ময়কর। তার জীবনবোধের এই ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যই তাকে তার জীবননাশী শত্রুর কাছেও গ্রহণীয় করেছে। তাঁর অতি পরম শত্রু তাকে অত্যন্ত নির্ভরশীল মনে করতে বাধ্য হয়েছে। কি এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি যে জন্য আবালবৃদ্ধবণিতা-শত্রুমিত্র সবার কাছেই হয়ে উঠেছিলেন গ্রহণীয় ব্যক্তিত্ব। শিশুদের কাছে তিনি শিশুর মতোই আচরণের অধিকারী। শিশুদের তিনি আদর করেছেন, খেলাধুলায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। কিশোরদের অনুপ্রাণিত করেছেন খেলাধুলার মাধ্যমে দৈহিক সক্ষমতা অর্জন করতে। সময়ের সদ্ব্যবহারে তাদের করেছেন অনুপ্রাণিত। এতিমদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। সাহাবিদের তিনি এতিমদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে বলেছেন। বলেছেন, ‘একজন এতিম প্রতিপালনকারী এবং আমি শেষ বিচারের দিন একত্রে এভাবে থাকব’ বলে তিনি শাহাদত এবং মধ্যমা আঙুল একত্রিত করে দেখান।’ (বুখারি)
মহানবী এ কথাও বলেছেন, ‘সবচেয়ে উত্তম মুসলিম ঘর সেটিই যেখানে একজন এতিমের লালন করা হয় এবং সবচেয়ে খারাপ মুসলিম ঘর সেটিই যেখানে এতিমদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ) মহানবী এ-ও বলেছেন, ‘যে যুবতী মহিলা স্বামীর মৃত্যুর পর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের লালনপালনের জন্য দ্বিতীয়বার বিয়েতে রাজি হয়নি, শেষ বিচারের দিন তার এবং আমার অবস্থান হবে এরকম- বলে তিনি মধ্যমা এবং শাহাদাত আঙুল একত্রে করে দেখান।’ আওফ বিন মালিক আল আশিকি এটি বর্ণনা করেছেন।
আবু হুরায়রা একটি ঘটনার কথা বলেছেন, এক ব্যক্তি এক দিন নবীজী সা:-এর কাছে এসে নিজের রুক্ষ স্বভাবের কথা বলায় মহানবী তাকে এতিমের মাথায় চুমু দিতে এবং অভাবীকে খাবার দিতে বলেন। (মুসনাদে আহমাদ) এতিমের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার বাণী- ‘তুমি কি দ্বীন অস্বীকারকারীকে দেখেছ, সে তো সেই-ই যে এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়।’ (১,২/১০৭) বস্তুত সমাজে একজন সাধারণ ব্যক্তির যে অধিকার রয়েছে একজন এতিমেরও একই অধিকার রয়েছে। সে-ও সমাজেরই নাগরিক। তার নাগরিক সুবিধা, মৌলিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একটি কল্যাণরাষ্ট্রে একজন এতিম অন্য সাধারণ ব্যক্তির মতোই সব ধরনের অধিকার ভোগ করবে। আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছে, ‘যে ব্যক্তি একজন বিধবা বা একজন এতিমের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করল সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদ করল। তার মর্যাদা এমন একজনের মতো, যে রাত জেগে ইবাদত করে এবং যে সবসময় রোজা রাখো।’ (বুখারি)
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-গণজাগরণে অনেকে বিধবা হয়েছেন, অনেকে এতিম হয়েছেন এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, এটিই ইসলামের শিক্ষা। এদেরকে সাময়িক সহায়তা সেটি চিকিৎসা হোক বা আর্থিক, যথেষ্ট নয়। এদের চিকিৎসা-পরবর্তী সামাজিক এবং আর্থিক পুনর্বাসন ইসলামের শিক্ষা। যারা বিধবা হয়েছেন তাদের সামাজিক এবং আর্থিক পুনর্বাসন ইসলামী চেতনার দাবি। যে সব শিশু এতিম হয়েছে তাদের সুরক্ষা দেয়া, তাদের যথাযথভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা এবং শিক্ষা-পরবর্তী যোগ্যতা অনুসারে পুনর্বাসন ইসলামী সমাজ চেতনার দাবিই নয়, রাষ্ট্র তথা জাতির নৈতিক দায়িত্ব। এই নৈতিক অনুভ‚তির আলোকে সমাজ গঠনের, রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞান কল্যাণরাষ্ট্রের চালিকাশক্তি।
ইসলামের এই বাস্তব নমুনার প্রতিফলন ছিলেন মহানবী সা: স্বয়ং। তার চরিত্রে একই সাথে প্রতিফলন ঘটেছিল- ক্ষমা, সহানুভ‚তি, দয়া, বিনয় ও মহানুভবতা। অন্যকে সাহায্য করার, অন্যের দুঃখে সমব্যথী হয়ে দুঃখ দূর করার চেষ্টা করেছেন সারাক্ষণ। জীবনের সবচেয়ে খারাপ শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করেছেন। উদারতা ছিল তার অলঙ্কার। আমানতদারি ছিল তার চরিত্রের ভূষণ। ক্ষমা, বিনয়, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা-দয়ার আধার ছিলেন তিনি। মর্যাদাবানকে তিনি যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন সব সময়েই। তার চরিত্রের এসব গুণাবলির চরম প্রকাশ ঘটে মক্কা বিজয়ের পর। দয়ার নবী, মানুষের নবী, ক্ষমার নবী পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের প্রতিভ‚ হয়ে সেদিন জাতীয় ঐক্যের যে অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন মানব জাতির ইতিহাসে তা অতুলনীয়। মানবিক মূল্যবোধ সততা-সারল্য এবং ক্ষমার মাধ্যমে সেদিন তিনি যে বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তা স্বর্ণালী অধ্যায়। মানবিক মূল্যবোধ, সততা, সারল্য এবং ক্ষমার মাধ্যমে সেদিন তিনি যে রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ তৈরি করেছিলেন তা রাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। বর্তমান প্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্য এবং সমৃদ্ধির পথে, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করার জন্য এই ঘটনার অনুসরণ ও অনুকরণ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। একক জাতিসত্তা এবং দেশপ্রেমের আলোকে দেশ গড়ার এটিই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ বিজয়ের এই শুভক্ষণে দয়া এবং ক্ষমার উদার ভ্রাতৃত্ববন্ধনে সবাইকে এক জাতি, এক দেশের আদলে পথচলার সময় এখন।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা