২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিক্ষার ভবিষ্যৎ রূপকল্প

-

‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’- এই স্বপ্নের ঘোরে কেটেছে শৈশব। ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে’ আমাদের কল্পনার পৃথিবীকে চেনার, বড় করার স্পৃহা তৈরির আবহে আমরা বড় হয়েছি। পরিচিত হয়েছি পৃথিবীর সাথে, প্রকৃতির সাথে- ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাইরে’-এর আলোকে। বস্তুত শিক্ষার একটি উদ্দেশ্যই হলো সমাজের সাথে, নৈতিকতার সাথে, প্রকৃতি ও পৃথিবীর সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার চেতনা সৃষ্টি। দেশকে জানার, ভালোবাসার, দেশের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে নিজেকে তৈরি করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। ভবিষ্যৎ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নৈতিকতা ও দায়বোধসম্পন্ন নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়োজনেই শিশু-কিশোর এবং তরুণদের পাঠ্যক্রম। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির সাথে সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণের যোগ্যতা সৃষ্টিই হচ্ছে শিক্ষার একটি মৌল উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীর মধ্যে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও কর্তব্যবোধ সৃষ্টি শিক্ষার আরেকটি মৌলিক লক্ষ্য। মানব সৃষ্টির রহস্য এবং কার্যকরণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীর চেতনাবোধ সৃষ্টিও শিক্ষার একটি অপরিহার্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

বস্তুত শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এর মাধ্যমে শিশু-কিশোর ও তরুণদের জাতিসত্তার সাথে, এর বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিতি ও আত্মীকরণ ঘটে। জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য, যাপিত জীবনের সাংস্কৃতিক ধারা, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক পরিসরের সাথে সম্পর্ক রচনা করার একমাত্র মাধ্যম শিক্ষা। এ জন্যই শিক্ষাকে অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) ঘোষণা করা হয়েছে ইসলামী জীবনাচারে; তাগিদ দেয়া হয়েছে জ্ঞানার্জনের। মহানবী সা:-এর কাছে সৃষ্টিকর্তা প্রথম যে বাণী (ওহি) পাঠিয়েছিলেন তা ছিল জ্ঞানার্জনের তাগিদ। নারী-পুরুষ, বিত্তহীন-বিত্তশালী সবার প্রতি সমভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে জ্ঞানার্জনের। দেড় হাজার বছর আগে সমভাবে সবার প্রতি যা আবশ্যিক ঘোষণা করা হয়েছিল তা এখন মৌলিক মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এর পরও শিক্ষার আলো সর্বত্র সমানভাবে বিচ্ছুরিত হয়নি। আলোকিত হয়নি সমাজজীবন, সৃষ্টি হয়নি প্রত্যাদিষ্ট আলোর আদলে ন্যায়বান ব্যক্তি; বরং উল্টোটা ঘটেছে। ব্যক্তি এবং দলীয় স্বার্থ ও রাজনীতির কদর্য প্রভাবে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন কুলষিত হয়েছে।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার আলোকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঙ্কটের মোকাবেলায় নিজ নিজ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সাথে সাথে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটিয়েছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত। চলমান প্রক্রিয়ায় মাঝে মধ্যে তা সংস্কারও করেছে। আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম। এখানে শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে, উন্নয়নের নামে শিশুদের ওপর বার বার চাপিয়ে দেয়া আমাদের জীবনবোধের বিরুদ্ধ মতাদর্শ। ফলে আমাদের তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষধাপ অতিক্রম করার পরও দেশের এবং বহির্বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে নিজেদের অসহায় বোধ করছে। দিন দিন বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। দেশের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও বৃহৎ অর্থনীতির তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। দেশে বর্তমান ২৩ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষিত বেকার মানবসম্পদ তৈরির ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শিল্পে লাখ লাখ বিদেশী কর্মসংস্থান এটাই প্রমাণ করে, আমাদের শিক্ষা দেশের শিল্পকারখানার চাহিদামাফিক মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ। এর একটি বড় কারণ শিক্ষার রাজনীতিকরণ। শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়ন এখানে গুরুত্ব পায়নি। শিক্ষা একটি বিনিয়োগ- এ ধারণা আগাগোড়াই অবহেলিত হয়েছে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নির্ধারণ করার সময় এখন এবং এখনই। শিক্ষিত বেকার তৈরির পরিবর্তে মানবসম্পদ তৈরির দিকে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মানবসম্পদ তৈরির পরিকল্পনার বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবসম্পদ তৈরির আদলে কর্মমুখী শিক্ষা এখন অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সবার আগে দরকার শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে একই সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান করে প্রয়োজনীয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকের জোগান দেয়া। এটি হলে শহরে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। নৈতিকতা এবং দায়বোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরির উপযোগী শিক্ষানীতি এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। যে শিক্ষানীতি তৈরি করবে আদর্শ মানবসম্পদ; যার ভেতর সৃষ্টি হবে নীতি-নৈতিকতা, দায়বোধ এবং সৃজনশীলতা। এই আলোকে প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষকের। শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে শুধু চাকরি নয়; দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কারিগরে পরিণত করা সময়ের দাবি।

আমাদের শিক্ষকরা মানুষ তৈরির পরিবর্তে নিজ ভাগ্য পরিবর্তনে কোচিং বাণিজ্যে অধিকতর উৎসাহী। শিক্ষক মানুষ তৈরির কারিগর। দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাতা তারাই। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। যেন তারা কোচিংমুখী না হন। শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক ও শিক্ষানীতির সাথে প্রয়োজন শিক্ষা উপকরণ এবং মূল্যায়নের মানসম্পন্ন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা শিক্ষাক্রম বৈশ্বিক-ক্রমপরিবর্তনশীল পারিপার্শিকতা, সমস্যাসঙ্কুল ঘটনাবলির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাথে সাথে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েরই চিন্তার ক্ষেত্র এবং জ্ঞানকে দান করবে বিশালতা। যে শিক্ষাক্রম সত্যিকার অর্থেই তৈরি করবে প্রকৃত মানবসম্পদ, সার্টিফিকেটধারী বেকার জনগোষ্ঠী নয়। যে মানবসম্পদ কার্যকরভাবে আলোকিত আদর্শবাদী সমাজ ও দেশ তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। মোট কথা, আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের যাপিত জীবনের প্রতিফলন থাকবে; থাকবে নীতি-নৈতিকতার আবহ।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement