২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্জন

লেখক -

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাঁচ সপ্তাহ পার হয়েছে। কোন সরকারের জন্য সময়টা খুব বেশি নয়। তবে মানুষের অন্তহীন আশাবাদের কারণে অনেকে প্রতিটি দিন পার হওয়ার সাথে সাথে হিসাব নিয়ে বসতে চান যে, কী অর্জিত হলো। আবার অনেকেই এমন কথা বলার জন্য ব্যস্ত থাকেন যে, এই সরকার পারছে না, এ সরকার দিয়ে হবে না। বাস্তব অবস্থা আসলে কী?

কোন পরিস্থিতিতে এ সরকার
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চেপে বসা কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনামলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব মৌলিক প্রতিষ্ঠান যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখনই ছাত্র-জনতার অভ‚তপূর্ব রক্তঝরা এক আন্দোলনে স্বৈরশাসন বিদায় নিতে বাধ্য হয়। একক কোনো রাজনৈতিক দল বা ভাবাদর্শের অনুসারীরা স্বৈরশাসন হটানোর জন্য এই আন্দোলন গড়ে তোলেনি। এই আন্দোলন সংগঠিত করেছে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্ররা । তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এটাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে কর্তৃত্ববাদবিরোধী প্রকৃত স্বাধিকারকামী সব ছাত্র-ছাত্রী। আওয়ামী লীগ সমর্থক স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী ছাড়া স্কুল-কলেজের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও এই আন্দোলনে অংশ নেয়।

এই আন্দোলন দমন করতে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিভিন্ন বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে। এতে সহস্রাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আহত ও পঙ্গু হয় ২০ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। এই সংঘাতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙে পড়ে। কারফিউ অমান্য করে গণভবনের দিকে ছুটে আসা ছাত্র-জনতার ঢল ঠেকাতে আরো গুলি চালানোর বিষয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব অপারগতা প্রকাশ করে। এতে শেখ হাসিনা মেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। স্বৈরাচারের পতনের পর সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাজপথের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় নামতে হয়। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়ে মাঠে নামে।

শেখ হাসিনার পলায়নের তিন দিন পর প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। এক দফা সম্প্রসারণের পর উপদেষ্টা পরিষদ পূর্ণ অবয়ব লাভ করে। সরকারের সামনে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ভেঙেপড়া প্রশাসনকে আবার কার্যকর করা। বিশেষত পুলিশ বাহিনীকে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে ফেরানো, ক্ষত-বিক্ষত অবকাঠামো মেরামত করে আবার কাজ করার মতো অবস্থায় নিয়ে আসা, জনপ্রশাসনে কর্তৃত্ববাদিতার কাঠামোকে স্বাভাবিক পেশাদার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ফেরানোও ছিল চ্যালেঞ্জ। আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল করে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরানো। রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এনে অবক্ষয় রোধ এবং নতুন যাত্রার জন্য প্রস্তুত করাও ছিল সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এসবের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের যে মৌলিক দাবিতে ছাত্ররা রক্ত ঝরিয়েছে সেটি কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।

কতটা এগোতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার
একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পাঁচ সপ্তাহে দেড় দশকের জঞ্জাল সরিয়ে জনগণের আশাবাদ পূরণ করা সত্যিকার অর্থেই ছিল কঠিন। তবে এর মধ্যে কর্মবিরতিতে নেমে পড়া নৈতিক মনোবলহীন পুলিশ বাহিনীকে কাজে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। যতদূর জানা যায়, সরকারের কাজে যোগদান করার ডেটলাইন পার হওয়া অবধি দুই শতের কিছু বেশি পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছে। গণহত্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কিছু সদস্যকে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হয়েছে। পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত ও দলবাজ নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রভাব নমনীয় করতে শতভাগ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জরুরি অবকাঠামো মেরামত সম্পন্ন করার পর দেশের সব থানা এর মধ্যে সচল করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি দায়িত্ব পালনে ফেরানোর সাথে সাথে দৃশ্যমান চাঁদাবাজি, হয়রানি ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পদোন্নতি বাণিজ্য অনেকখানি বন্ধ হয়েছে। গণহত্যার আদেশ দানের সাথে যুক্ত কর্মকর্তাদের সরিয়ে নতুনদের দায়িত্বে আনা হয়েছে।

সারা দেশে আইন শৃঙ্খলার সহযোগী বাহিনী হিসেবে আনসারকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দমনে কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। হাসিনার পলায়নের পর এই বাহিনীটিও অনেকখানি অকার্যকর হয়ে পড়ে। পুলিশের মতো নানা দাবি নিয়ে সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দেয়া হয়। প্রশাসনকে অকার্যকর করে অনাহুত কিছু ঘটানোর চক্রান্ত স্পষ্ট হওয়ার পর এই আন্দোলনকে দমন করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয়। দলকানা ও দুর্নীতির প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে আনসার সদস্য নিয়োগের একটি প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।

জনপ্রশাসনে পরিবর্তন স্বৈরশাসনোত্তর সরকারের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ ছিল। পূর্ববর্তী দেড় দশকে প্রশাসনে একান্তভাবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী দলগুলোর অনুগতদের নিয়োগ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ ধরনের একটি সাজানো প্রশাসন পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এর আগে বঞ্চিত ১৯৮২ ব্যাচের ছয়জন মেধাবী কর্মকর্তাকে সচিব পদে নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। একই ধরনের বঞ্চিত মেধাবী কর্মকর্তা পরবর্তী ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ ব্যাচেও রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ২০-২৫ জন কর্মকর্তাকে বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হলে সেটি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়কে স্বৈরাচারের প্রভাবমুক্ত করতে সহায়ক হতে পারত। বঞ্চিত সিনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রশাসনে এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সচিবের দায়িত্ব দেয়ার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। বিদ্যমান সচিব যারা বহাল থাকবেন তাদের মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করা যেতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের কার্যালয়ে মুখ্যসচিব ও সচিব পদে নিয়োগ দানে বিলম্ব এবং স্বৈরাচারবিরোধী বিপ্লবের চেতনা দিয়ে প্রশাসনকে বুঝতে ব্যর্থ হওয়া উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ওপর বেশি নির্ভর করার কারণে এক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে আগের সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার বিষয়গুলো তুলে আনার অঙ্গীকার করেছেন। পতিত স্বৈরাচারের সেই কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে মুখ্য অংশীদার সচিবদের একই দায়িত্বে বহাল রেখে সেটি যে সম্ভব হবে না সেটি প্রধান উপদেষ্টার সামনে সম্ভবত তুলে ধরা হয়নি।

এ কারণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এবং জেলা প্রশাসকের মতো মাঠ প্রশাসনে আগের সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দানে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। এই বিতর্কের কারণে এর মধ্যে কয়েকটি কমিশনে পরিবর্তনও আনতে হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনাকে এবিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ধারণ করতে না পারার কারণে এটি ঘটে থাকতে পারে। তবে প্রশাসন বিন্যাসে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ মোটেই বেশি সময় নয়। ভুলগুলো সংশোধন করে সামনে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে দৃঢ় থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ষড়যন্ত্র উত্তরণে বাস্তব পদক্ষেপ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর তারা যাতে ঘোষিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারে তার জন্য পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসররা রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরির কৌশল গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন পেশাজীবী, এমনকি ডিসিপ্লিনড ফোর্সকে কর্মবিরতি, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি নিতে উসকে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই কাজগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর এখন শিল্প প্রতিষ্ঠান অচল করে রাখার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক কারখানার বড় একটি অংশ বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। এতে ২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবেশী দেশে চলে গেছে।
পোশাক কারখানাগুলোতে ম্যানেজার পর্যায়ের অধিকাংশ পদে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকরা অননুমোদিতভাবে কাজ করে আসছিল। তাদের সরকারি আদেশে ফিরে যেতে হওয়ায় নানা টুলস ব্যবহার করে পোশাক কারখানাগুলোকে অচল করে রাখা হয়েছে। সরকার নানাভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। এতে সাফল্যও আসছে। আর এর মাধ্যমে সব কিছুর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে সংবেদনশীল পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থির করার নতুন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সরকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণামদর্শী পদক্ষেপ নিতে পারলে সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হবে।

প্রফেসর ইউনূসের জাতিসঙ্ঘ মিশন
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রফেসর ইউনূসের চলমান সফরটি হবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সফরে ড. ইউনূস জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ প্রদান ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ সময় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে বৈঠক করবেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রথমবার বিদেশ সফরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে দ্রুত গতি সঞ্চার করবে বলে আশা করা যায়। তবে এই অভিযাত্রার সাফল্য পাওয়া বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অঙ্গীকার ও দৃঢ় ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement