দেশে বন্যা-উত্তর কৃষি ব্যবস্থাপনা
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:২৩
‘বন্যা-উত্তর কৃষি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক গোলটেবিল বৈঠক হয়েছে। সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল পলিসি স্টাডিজ (ক্যাপস) এ আয়োজন করে। ওই গোলটেবিল বৈঠকে শতাধিক কৃষি বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ ড. মুহা. রুহুল আমীন। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা যেসব মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন তার ভিত্তিতেই আজকের এই আলোচনা।
আলোচকরা মনে করেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে গত ২১ আগস্ট অতিবৃষ্টি ও আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে আসা উজানের ঢলে দেশে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একই সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেয়াও এই আকস্মিক বন্যার অন্যতম কারণ।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি
বন্যায় বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রধান যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ফেনী ও নোয়াখালীসহ ১১ জেলার ৭৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়ে ১০ লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এতে এখন পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যু হয়। ৫০ লাখ ২৪ হাজার জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। দুই লাখ ৯১ হাজার ৩৩ হেক্টর ধানি জমি আক্রান্ত হয়েছে। ১৯ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমির আমনের বীজতলা পুরোপুরি আক্রান্ত হয়েছে। দুই হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। ধানের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শাক-সবজির। বিভিন্ন মশলা, ফলবাগান, সবজি, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও টমেটো, পান, আখসহ তিন লাখ ৩৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়। বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতি হয় এক হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দীঘি, খামারের সংখ্যা এক লাখ ৮০ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন; পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা তিন হাজার ৭৪৬ লাখ। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ, দুধ, ডিম ক্ষতি হয়েছে ৪১১ কোটি টাকার বেশি। সাত হাজার ৭২২ কিলোমিটার রাস্তা, এক হাজার ১০১টি ব্রিজ ও কালভার্ট এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ক্ষতি হয়।
বন্যা-উত্তর চ্যালেঞ্জসমূহ
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জের কথা আলোচকরা তুলে ধরেন। এর মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো- মহাসড়ক বিপর্যস্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের চলাচল কমে যাওয়া। এসব রাস্তা মেরামতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপ, তার ওপর দুর্যোগে কিছু ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করার চেষ্টা করে। সুতরাং বাজার নিয়ন্ত্রণেও কঠোর নজরদারি এক বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে খেতের কৃষির ব্যাপক ক্ষতি অন্যদিকে আবার নতুন করে কৃষি উৎপাদন করতে কৃষক বীজ ও সার প্রাপ্তি এবং নগদ অর্থের অনিশ্চয়তায় পড়েন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া যদি যথাযথভাবে না করা যায়, তাহলে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। নিম্নবিত্তরা সব হারিয়ে দরিদ্রদের কাতারে এসে দাঁড়াবে।
ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে করণীয়
উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন মেয়াদি পরামর্শ সুপারিশ করা হয়।
তাৎক্ষণিক করণীয় : বন্যায় আক্রান্তদের উদ্ধার, শেল্টার, খাদ্যদ্রব্য, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ পোশাক এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়াও কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত নির্ণয় কর হয়। এ কাজটি অনেক সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে বিশেষজ্ঞসহ দেশের তরুণ সমাজ এবং ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে, আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ এবং সহায়তায়।
স্বল্পমেয়াদে করণীয় : আমন ধান : ইতোমধ্যে লাগানো আমন ধান খেতের বন্যার পানি নামতে সময় নিলে সেগুলো পুরোই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে জলমগ্ন-সহিষ্ণু জাত (ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৭৯, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১২) হলে প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে টিকে থাকতে পারবে। আমন রোপণের স্বাভাবিক সময় শেষ। নাবি আমন রোপণের শেষ সময় ৩১ ভাদ্র। সে ক্ষেত্রে চারার বয়স হতে হবে ৩০ দিন। ধানের জাত হবে বিআর-২২, বিআর-২৩ এবং ব্রি ধান-৪৬ ও ব্রি ধান-৫৪। পাশাপাশি স্থানীয় জাত বিআর-৫, ব্রি ধান-৩৪ ও নাজিরশাইল আবাদ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গোছাপ্রতি চার-পাঁচটি চারা ঘন করে রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলেই চলবে। সার ও কীটনাশকের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।
রবি ফসল : যেখানে আমন উৎপাদন সম্ভব নয় সেখানে আগাম লাভজনক রবি ফসল, বিশেষ করে শাক-সবজি যেমন- বাঁধাকপি ফুলকপি, বেগুন, টমেটোসহ উপযোগী অন্য ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডাল ও তৈল ফসলের উন্নত চাষাবাদ এবং এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। মাষকলাই জাতীয় ফসল এবং গিমা কলমি, ডাঁটা, পালংশাক নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে।
গবাদিপশু ও মৎস্য : জরুরি পশুখাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধে টিকা প্রদান এবং ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হবে। মৎস্যচাষিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানো দরকার। মৎস্যখামারগুলো সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা দেয়াসহ মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত এবং চাষিদের মধ্যে পোনা বিতরণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা, মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
মধ্যমমেয়াদে করণীয়
কৃষকের পুনর্বাসন : শত শত মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, মৎস্যখামারসহ অনেক সম্পদের ক্ষতি পোষাতে তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্য বীমাপত্র বা শস্যবীমার প্রচলন করা প্রয়োজন। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপখাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষি বীমার আওতায় আনা প্রয়োজন। নিচু এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা হয়, ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। কৃষককে পুনর্বাসনের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক সহায়তা ও মানসিক কাউন্সেলিং। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষককে সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিতে হবে। সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পর কৃষককে তার কৃষি কাজ এবং গবাদিপশু পালনসহ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সাথে যুক্ত রাখতে হবে। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থাও করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। বন্যায় ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট যত শিগগিরই সম্ভব পুনর্নির্মাণ করা দরকার। অনেক খাল বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেগুলো দ্রুত খননের ব্যবস্থা করে পানি নিষ্কাশন করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। দাতা সংস্থা ও প্রবাসীদের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পানিবাহিত রোগ, খাদ্যের ঘাটতি, ঘরবাড়ি পুনঃস্থাপন এবং ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদে করণীয়
এ ধরনের আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং বন্যার পূর্বাভাসের পরিবর্তন ও বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। এর জন্য, পূর্বাভাসপদ্ধতি বদলাতে হবে, যাতে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। বন্যার সময়ের আশ্রয়ের জন্য শেল্টার তৈরি করতে হবে। ভারতের সাথে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ভারতের সাথে আলোচনা ইতিবাচক না হলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া যেতে পারে। অন্যথায় ভাটিতে বিকল্প বাঁধ দেয়া যেতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, বন্যা শুধু আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন- বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সাথে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমি উর্বর করে তোলে। কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি না, সেগুলোর প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। এসব কাজে বিভিন্ন সেক্টর থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।
বন্যা-উত্তর কৃষি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। প্রাথমিক পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন মহল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কাজের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সবার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সরকারকে করতে হবে। তবে, ব্যক্তি কৃষক পর্যায়ের কাজ করার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করতে পারে। এমনকি বিভিন্ন ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা