২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সাক্ষাৎকার : ডা: এ কে এম ফজলুল হক

যুগোপযোগী করতে হবে স্বাস্থ্যনীতি

বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কনসালট্যান্ট বেজড হতে হবে
-

ডা: এ কে এম ফজলুল হক চট্টগ্রামে বেসরকারি চিকিৎসা খাতের অন্যতম পথিকৎ। তিনি একজন সনোলজিস্ট। ৩৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়া পার্কভিউ হসপিটাল ও জম জম হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং বহু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত। সম্প্রতি দেশের স্বাস্থ্য খাত, চট্টগ্রামের সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট এই সনোলজিস্টের সাথে। তিনি বলেছেন, এ দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে রোগীদের বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উন্নত সুযোগ-সুবিধা নির্ভর বেসরকারি হাসপাতালগুলো যাতে বাইরের বিশ্বের মতো কনসালট্যান্ট বেসড হতে পারে সে জন্য স্বাস্থ্যনীতিকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নয়া দিগন্ত’র চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ নূরুল মোস্তফা কাজী। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

নয়া দিগন্ত : চট্টগ্রামের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতের পথিকৎ বলা হয়ে থাকে আপনাকে। এই অঞ্চলের চিকিৎসাসেবা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
ডা. এ কে এম ফজলুল হক : চট্টগ্রামে সামগ্রিক (এজ এ হোল) চিকিৎসাসেবার মধ্যে মোটামুটি বলতে পারেন কার্ডিওলজি, জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, গাইনী, শিশু রোগ, চক্ষু, ইনএনটি সবগুলোর মধ্যে মোটামুটি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেটা সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে হোক, বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে হোক আমরা এসব ক্ষেত্রে ডায়াগনস্টিক সাইটে এবং ট্রিটমেন্ট সাইটে চট্টগ্রাম অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে ক্যান্সার চিকিৎসায় চট্টগ্রামে চাহিদা অনুযায়ী সেন্টার এখনো ডেভেলপ করেনি। তবে রিসেন্টলি হচ্ছে। যদিও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে রেডিওথেরাপি মেশিন অনেক সময় নষ্ট থাকে। বেসরকারি পর্যায়ে মা ও শিশু হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা চালু হচ্ছে, এভারকেয়ারে হচ্ছে, আমাদেরও (চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল) পরিকল্পনায় আছে। এখন আমাদের যেটা বিএমআরই হচ্ছে, সেটাতে হয়তো হবেনা, পরবর্তী পর্যায়ে তার্গেট আছে।
আগে হার্টের চিকিৎসার জন্য মানুষকে ঢাকায় যেতে হতো, ঢাকায়ও ফেইথ ছিল না, মানুষ বেশির ভাগ ইন্ডিয়া যেত। এখন তো হার্টের চিকিৎসা অলমোস্ট বাংলাদেশে হচ্ছে এবং চট্টগ্রামও হার্টের চিকিৎসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইভেন হার্ট অ্যাটাকের সাথে সাথে যদি রোগী আমাদের সেন্টারে আসে তাহলে আমরা সাথে সাথেই তাকে এনজিওগ্রাম করে হার্টব্লক যদি আমরা রিং লাগিয়ে ছুটিয়ে দিই তাহলে রোগীর হার্টটা ডেমেজ থেকে রক্ষা পাবে। এটা আমাদের এখানে হচ্ছে। হার্টের সব ধরনের বাইপাস সার্জারিসহ কনজিনেটাল হার্ট ডিজিজ, শিশুদের এডাল্টদের ভাস্কুলার সার্জারি সব ধরনের অপারেশনসহ সবকিছুই এই সেন্টারে হচ্ছে। এক কথায় ওয়ান স্টপ কার্ডিয়াক ট্রিটমেন্ট মেট্রোপলিটন হার্ট সেন্টারে হচ্ছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব কনসালট্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং কার্ডিয়াক সার্জন টিম। ফুল টিম সর্বদা প্রস্তুত। একটা রোগী হার্ট অ্যাটাক হলে আমাদের সেন্টারে না এসে যদি অন্য সেন্টারে যায়, তাহলে ওই রোগী তাৎক্ষণিক যেটা চিকিৎসা ডিলেইড হবে, পাবে না অনেক ক্ষেত্রে। উদারহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এখনই এনজিওগ্রাম করে রিং লাগাতে হবে, মোস্ট অব দ্য হসপিটালে সিসিইউ আছে; কিন্তু তাদের নিজস্ব ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট নাই ফলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অনকলে আসতে আসতে ওই সুযোগটা থাকবে না। আবার মোস্ট অব দ্য সিসিইউ থাকলেও কারোরই ক্যাথল্যাব নেই। চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে আরো দু’টি ক্যাথল্যাব শুরু হয়েছে, কিন্তু তাদের আবার কার্ডিয়াক সার্জারি নেই। স্ট্যান্ট লাগাতে গিয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা বা রাকচার হয় তাহলে তাৎক্ষণিক বাইপাস করে রোগীকে সেভ করা হয়। এটা করার ব্যবস্থা কারো নেই, শুধু মেট্রোপলিটন হার্ট সেন্টারে আছে। কার্ডিয়াক চিকিৎসায় অনেক ব্যয়বহুল একটা লাইফ সেভিং মেশিন আছে, যেটা হলো- আইএবিপি (ইন্ট্রা অ্যারোটিক বেলুন পাম্প) মেশিন, সেটা খুব বেশি ব্যবহার হয় না, সেই মেশিনও আমাদের সেন্টারে আছে। বাকি যা চিকিৎসা আছে সে ক্ষেত্রে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা জেনারেল কনসেপ্টের হসপিটাল থেকে সুপার স্পেশালিট কনসেপ্টে যাচ্ছি। ডায়াগনোসিস এর ক্ষেত্রেও ওয়ার্ল্ড ক্লাস ল্যাবরেটরি করার টার্গেট নিয়েই আমরা এগোচ্ছি, এখনো খুবই নগণ্যসংখ্যক সেম্পল ঢাকায় পাঠাতে হয়, যা ধর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে না, সে ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম এখন অনেকটাই স্বয়ং সম্পূর্ণ।

নয়া দিগন্ত : এই অঞ্চলের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতের সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলবেন?
ডা: এ কে এম ফজলুল হক : কার্ডিওলজির ক্ষেত্রে আগে অধিকাংশই বাইরে যেত। এখন বিদেশে যারা যায়, সেটা কিছুটা আমাদের আস্থার সঙ্কটের জন্য। আমাদের চিকিৎসা নাই, সে জন্য যাচ্ছে ব্যাপারটা তেমন না। আস্থার সঙ্কটের পেছনে আমাদের দেশের নার্সিং সেবাটার ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে আমরা একটু দুর্বল। আমাদের নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলো আছে, সেখানে টিচিংয়ের সঙ্কট যেমনি আছে, তেমনি কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা খুব একটা যায় না। লেখাপড়ায় দক্ষ মেয়েদের পরিবারগুলো নার্সিংয়ে দিতে চায় না; কিন্তু বিদেশে নার্সিং খুব নোবেল পেশা এবং অনেকেই পছন্দ করে নার্স হয়। এখানে এক দিকে ভালো ছাত্রদের নার্সিং পেশায় আসতে অনীহা রয়েছে, যারা আসছে তারা টিচিং এবং মেথডের কারণে খুব কোয়ালিটিফুল হিসেবে গড়ে উঠছে না। ফলে দক্ষ নার্স প্রোডাকশন হচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা যাদের নিয়োগ দিই ডিপ্লোমা বা বিএসসি সম্পন্ন করার পর তাদেরকে আমরা নিজেরা প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলি। কিন্তু দেখা যায় যে, এক বছর বা দুই বছর পর সরকার একসাথে কয়েক হাজার নার্স নিয়োগ দিয়ে দিলো। এতে আমরা যাদের গড়ে তুললাম তারা চলে গেল। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আবার নতুনদের নিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষিত করতে হচ্ছে। প্রফেশনালি আমাদের নার্স বা চিকিৎসকরা বিদেশে যেমন রোগীকে একেবারেই কনসার্ন করে, রোগীর পার্সোনালাইজ কেয়ার নেয়, একেবারেই ধরেন মাউথ কেয়ার নেয়া, হাতে ধরে খাইয়ে দেয়া মোট কথায় আন্তরিকতার জিনিসটায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি।
নইলে যে আমাদের জনশক্তি জানে না তা নয়। আমরা যদি সিদ্ধান্ত নেই তাহলে আমরাও পারব। সেভাবে আমরাও মোটিভেশন চালচ্ছি। এখন আস্তে আস্তে মানুষের আস্থা ফিরে আসছে, কারণ আমরা ডাক্তারদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মোটিভেশন চালাচ্ছি, বিহেভিয়রাল সায়েন্স, প্যাশেন্টস কেয়ার, মেডিক্যাল ইথিকস ইত্যাদি বিষয়ে।

নয়া দিগন্ত : চট্টগ্রাম কি চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ? আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
ডা: এ কে এম ফজলুল হক : ডাক্তার এবং টেকনোলিজির দিক থেকে আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। আমরা ইন্টারনাশনালি ব্র্যান্ডেড মেশিনগুলো সংযোজন এবং ব্যবহার করি। সিমেন্সের এমআরআই, সিটি স্ক্যান, বায়োকেমিস্ট্রির অটো অ্যানালাইজার, হরমোন অ্যানালাইজার, ইলেকট্রোলাইট অ্যানালাইজার এই মেশিনগুলো সবই আমেরিকান মেশিন ব্যবহার করি। আমাদের ডাক্তারদের এফসিপিএস করতে বহু বছর লেগে যায়, আমাদের এখানে তো খুব ভালোভাবে লেখাপড়া করিয়েই পাস করায়। দেখা গেল ১০০ জন পরীক্ষা দিলো; কিন্তু পাস করল মাত্র পাঁচজন। কাজেই আমাদের ডাক্তার এবং টেকনোলজি এ দুই দিকে কোনো কমতি নেই। রিপোর্টের ক্ষেত্রে কিছু কনট্রোভার্সি আছে। সেটারও অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে, যেমন একটি ল্যাবে যখন স্যাম্পল কালেকশন করা হয় তখন হয়তো রোগীর ব্লাডে সুগার বেশি ছিল, বা আরেক জায়গায় স্যাম্পল দেয়ার সময় সুগার কম ছিল। এসব কন্ট্রোভার্সি দূর করার জন্য আমরা ওয়ার্ল্ড ক্লাস মেশিনগুলো সংযোজন করেছি। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি কনসালট্যান্ট টু কানসালট্যান্টের ক্ষেত্রে পার্থক্য বেশি; কিন্তু মেশিন টু মেশিনে পার্থক্য একেবারেই সামান্য। তাই আমরা এখন উন্নত মেশিন নির্ভর পরীক্ষার মাধ্যমে রিপোর্ট দিচ্ছি। সে ক্ষেত্রেও কোনো সন্দেহ হলে আবার কনসালট্যান্ট দিয়েও আবার ক্রস চেক করিয়ে নিচ্ছি। তা ছাড়া এখন অনেকগুলো ট্রেনিং ইনস্টিটিউট হওয়াতে প্যাথলজিক্যাল খাতে দক্ষ জনবলের সঙ্কটও খুব একটা নেই। আমরা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছি। স্ট্যান্ডার্ডের দিক দিয়ে উন্নত বিশ্বের চেয়ে খুব একটা কমতি আমাদের নাই; কিন্তু এখনো আমাদের প্রফেশনাল কমিটমেন্টের ঘাটতি রয়েছে। কারণ আমাদের ডাক্তাররা রোগীদের যতটুকু সময় দিয়ে কাউন্সেলিং করা দরকার এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ঘাটতি রয়েছে। বিদেশে যেমন ডাক্তার রোগীকে তার রোগ সমপর্কে ভালোভাবে ধারণা দেয়, আবার দেখা যায় রোগী স্যাম্পল দিয়ে চলে গেছে, ওখানে তো আর ল্যাবে ল্যাবে দৌড়াতে হয় না, নিজের আইডি দিয়ে বললেই অনলাইনে ডাক্তার কি পরীক্ষা দিয়েছে, আবার স্যাম্পল দেয়ার পর রিপোর্টও অনলাইনে রোগী এবং ডাক্তারের কাছে চলে যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে এবং ফার্মেসি থেকে তা সংগ্রহ করা যাচ্ছে। একেবারেই পেপারলেস সেবা। আমরাও আস্তে আস্তে সে ধরনের অটোমেশনে যাচ্ছি। আমাদের হার্ট সেন্টারেও বারকোড সিস্টেমে রোগীদের পুরনো হিস্ট্রি সংরক্ষিত থাকছে।

নয়া দিগন্ত : চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবা নিয়ে তুলনামূলক কিছু বলবেন?
ডা: এ কে এম ফজলুল হক : সরকারি এবং বেসরকারি দুই লেবেলেই তো স্বাস্থ্যসেবা আমরা দিচ্ছি, সরকারি হাতপাতালগুলো নির্দিষ্ট সময়ে (অফিস আওয়ার) পর চিকিৎসা, ডায়াগনোসিসসহ বেশির ভাগ সেবা বন্ধ থাকে। অফিস টাইমের পর যেহেতু কনসালট্যান্ট পাওয়া যায় না, তাই সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষাগুলো করা যায় না। কিন্তু বেসরকারি লেবেলে ২৪ ঘণ্টাই সেবা উন্মুক্ত থাকে। বন্ধের সময় এমনকি রাতেও সব ধরনের সেবা চালু থাকে। জরুরিভাবে যদি হার্টের কোনো রক্ত পরীক্ষা করতে হয়, আবার কোনো স্ট্রোকের রোগীর তাৎক্ষণিকভাবে সিটি, এমআরআই করতে হয়, সেটা বেসরকারি ক্ষেত্রে সব সময়ই সম্ভব।

নয়া দিগন্ত : মানুষের মনে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা এবং ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট নিয়ে এক ধরনের আস্থার সঙ্কট রয়েছে, যার ফলে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসার জন্য পাশের দেশে গমণ করেন। মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে করণীয় সম্পর্কে কিছু বলবেন।
ডা: এ কে এম ফজলুল হক : বিদেশনির্ভরতার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যনীতি। একটি বড় সিদ্ধান্তের বিষয়, যুগোপযোগী গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি আমাদের নেই। ধরুন আমদের যারা ডাক্তারি পাস করে সবাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছে। তাহলে ইন্টার্নশিপের পর যাদের এখনো বিসিএস হয়নি বা এখনো পোস্টগ্র্যাজুয়েট করে নাই তাদের আমরা ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ দিই। তারা এটাকে একটা অন্তর্বর্তীকালীন বা টেম্পরারি জব হিসেবে নিচ্ছে। ফলে তারা এই চাকরিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। আমরা আস্থা কেন অর্জন করতে পারছি না এর মেইন কারণ হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যনীতির গলদ। আমাদের যারা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী সবাই সরকারি ডাক্তার। একটি বেসরকারি হাসপাতালে যখন রোগী আসে তখন ডাক্তারকে কল দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার সরকারি চাকরির অফিস সময় শেষে অনকলে রোগী দেখতে আসেন। কিন্তু ইন্ডিয়া, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর সব জায়গাতেই সার্বক্ষণিক কনসালট্যান্ট থাকে। যার ফলে সেখানে গেলেই কনসালট্যান্ট মিলছে। ইন্ডিয়াতে একটা স্বাস্থ্য পলিসি হচ্ছে তারা সব ডাক্তারকে সরকারি চাকরি দিচ্ছে না, শুধু অ্যাকাডেমিক হসপিটালগুলোতে প্রফেসর, ডাক্তার সরকারিভাবে নিয়োগ দিচ্ছে। অন্য যেসব হসপিটাল আছে, তাদের প্রত্যেক বিভাগের নিজস্ব কনসালট্যান্ট আছে। তাই সেখানে এমবিবিএস বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করার পর যেকোনো হাসপাতালে চাকরি নিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের স্যাটিস্ফেক্টরি স্যালারি দেয়া হয়। ফলে সেখানকার হসপিটালগুলো কনসালট্যান্ট বেসড হসপিটাল হিসেবেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দিনের যেকোনো সময়ে রোগী গেলে সেসব হাসপাতালে কনসালট্যান্ট মিলবে। কিন্তু আমরা সেটা পারছি না। আমাদের হাসপাতালগুলোতে পলিসির কারণেই সার্বক্ষণিক কনসালট্যান্ট থাকে না। ধরুন আমি বিজ্ঞপ্তি দিলাম যে, আমাদের সেন্টারে মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট হিসেবে যোগ দেন, তিনি করবেন না, কারণ তিনি সরকারি চাকরি করে প্রফেসর হতে এবং সেই পদবি নিয়ে বেসরকারি প্র্যাকটিস করতে চান। যার ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কনসালট্যান্ট বেসড হতে পারছে না। সে জন্য আমাদের রোগীরা বিদেশমুখী হয়। এটা একটা অন্যতম ফ্যাক্টর। এ ছাড় নার্সিং সার্ভিসেও আমাদের কিছুটা ঘাটতি আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিকাংশ জনগণকে সেবা দিচ্ছে, সে জায়গায় সবাইকে সরকারি চাকরি দিয়ে দিবে, তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে এটা নিয়ে চিন্তা করছে না। যার ফলে নতুন পাস করা ডাক্তারদের আবার প্রশিক্ষিত করে দক্ষ করে তুললে ক’দিন পর তাদেরও সরকার নিয়ে যায়। সবাইকে সরকার নিয়োগ দিয়ে দিলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের উৎস কোথায়? এ ক্ষেত্রে লিমিটেশন থাকলে তথা সরকার শুধু অ্যাকাডেমিক হসপিটালগুলোকেই ওন করবে এবং এগুলোতেই প্রফেসর, কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেবে, অন্য যারা পোস্টগ্র্যাজুয়েট করবে তারা বিদেশের মতো প্রাইভেট হাসপাতালে জব করবে। সিঙ্গাপুর, আমেরিকাতে এই নিয়মই চলছে। ইন্ডিয়াতে, ব্যাংককেও সেইম। আমাদের দেশে এটা না করাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সব বিভাগে নিজস্ব কনসালট্যান্ট নেই। অনকল হায়ার করা কনসালট্যান্ট দিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে। আমাদের হাসপাতালগুলো যদি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কনসালট্যান্ট নিশ্চিত করতে পারতাম কোনো রোগী বিদেশমুখী হতো না। তিনি নিজের ইরানে চাকরির অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। আমেরিকায় প্রত্যেক নাগরিরকের জন্য প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান ইনস্যুরেন্স কোম্পানি কতৃক নিয়োগ করা আছে। আমাদেরও সে ধরনের একটা পলিসি থাকতে হবে।
এর বাইরে আস্থার জায়গায় আরেক সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে সেটা হলো- স্বাস্থ্যসেবার জন্য তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে, ডিজি হেলথ আছে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল সোসাইটি আছে, বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ্আছে, সিভিল সার্জন অফিস আছে। আমাদের তো অর্গানোগ্রাম সেটআপ আছে। এখন ধরেন আমার স্বাস্থ্যসেবার কোয়ালিটি জাজ করার জন্য এখানে মাঝে মধ্যে র‌্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট, ভিজিল্যান্স টিম নিয়ে সাংবাদিকসহ নিয়ে এসে একেবারে ধরে আমাদেরকে জাতির সামনে দেখিয়ে দিচ্ছে যে এখানে এমন পাওয়া গেছে, তেমন পাওয়া যায়নি, এমন খারাপ ইত্যাদি। এ ধরনের হলে তো আস্থার সঙ্কট হবেই। আমরা নিজেরাই তো প্রশ্নের মুখোমুখি করছি। আমার কথা হচ্ছে কোয়ালিটি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; কিন্তু সেটা করতে হবে প্রপার অথরিটির মাধ্যমে। প্রপার অথরিটি আসুক, ভিজিট করার পর বলুক আপনার এই এই দোষ পাওয়া গেছে, সেটা আমাকে অফিসিয়ালি নোটিফাই করবে এবং নির্দিষ্ট সময় দেবে। ওই সময়ে মধ্যে সংশোধন না করলে আমার লাইসেন্স নবায়ন করবে না।
একেবারে হঠাৎ করে এসে আবার কেউ প্রশ্ন করলে কেন প্রশ্ন করল তারেও বাধবেন এভাবে তো হয় না। কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ করুক সেটা আমরাও চাই, কারন এখানে পথে ঘাটে বহু অস্বাস্থ্যকর ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। আমরা তো চাই কোয়ালিটি চিকিৎসা এবং মানুষের ভালো করতে না পারি, ক্ষতি করার অধিকার তো আমার নেই।

নয়া দিগন্ত : মেট্রোপলিটন হাসপাতাল নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
ডা. এ কে এম ফজলুল হক : আমরা এখনো জেনারেল হাসপাতালের কনসেপ্টে আছি। জেনারেল হাসপাতালের কনসেপ্ট থেকে আমরা এখন সুপার স্পেশালিটিতে যাচ্ছি। আমাদের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হার্ট সেন্টার একটি সুপার স্পেশালিটি হার্ট সেন্টার। এটার মাধ্যমে হার্টের চিকিৎসা যা আছে, আমাদের ইনহাউজ কনসালট্যান্ট, এমপ্লয়েড কনসালট্যান্ট এবং সার্জন টিমের মাধ্যমে ফুল টাইম সার্ভিস নিশ্চিত করছি, যাতে করে একটা হার্ট অ্যাটাকের প্যাশেন্ট এলে তাৎক্ষণিক এনজিওগ্রাম করে এনজিওপ্লাস্টি করে ফেললে রোগীর ফারদার হার্ট ডেমেজ হচ্ছে না। সুতরাং এটা অনেক বড় ব্যাপার। তা ছাড়া যাদের একেবারেই হার্ট ব্লক আমরা তাৎক্ষণিক পেসমেকার লাগিয়ে যে রোগীকে সেবা দিচ্ছি এর মাধ্যমে লাইফ সেভিংয়ের কাজগুলো আমরা করছি। কার্ডিওলজিতে সুপারস্পেশালিটি করেছি। এরপর একটা ইউরোলজি গ্রুপ আছে আমাদের স্পেশালাস্টিদের গ্রুপ। সেটার মাধ্যমে এবং ইউরোলজি-নেফ্রোলজি দু’টি মিলিয়ে আমরা কিডনি ডিজিজেস সুপার স্পেশালিটিতে যাচ্ছি। আমাদের ইএনটিতে সুপার স্পেশালিটি ইএনটি সেন্টার, গেস্ট্রোএন্টারোলজি সেন্টার, ওমেনস অ্যান্ড নিউনেটাল পেডিয়াট্রিক সেন্টার, অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রমা সেন্টার, এভাবে আমরা নিউরোসার্জারি, নিউরোমেডিসিন, ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন এসব বিষযে সুপার স্পেশালিটি ডিপার্টমেন্ট করে সেন্টার অব এক্সেলেন্স হিসেবে আমরা মেট্রোপলিটন হাসপাতালকে আগামীতে নিয়ে যাবার জন্য পরিকল্পনা করছি। এ লক্ষ্যে আমাদের অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে এবং এই দু’টি ভবন মিলিয়ে সুপার স্পেশালিটি করছি, যাতে কোনো রোগীকে বিদেশে যেতে না হয়, দেশেই যাতে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পায়। দুনিয়ার প্রসিদ্ধ কোম্পানিগুলোর মেশিনারিজ আমাদের এখানে স্থাপন করা হয়েছে। সিনিয়র কনসালট্যান্টরা এখানে বসেন। আমাদের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩৪ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমরা এক দিকে টেকনোলজির দিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্য দিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দিক থেকেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। অবকাঠামোগত দিক থেকেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।


আরো সংবাদ



premium cement