মানুষ পড়ার শিল্প
- অপূর্ব চৌধুরী
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০৬
মানুষকে পড়তে পারা একটি আর্ট। অন্যভাবে বলা যায় মানুষ পাঠ। মানুষকে পর্যবেক্ষণ এক নিখুঁত শিল্প বটে। এটি শুধু একটি দক্ষতা নয়; বরং গভীর একটি উপলব্ধির সূক্ষ্ম পথ। এই আর্ট মানুষের মনের গভীরতাকে আবিষ্কার করার অসীম আনন্দ দেয়। মানুষ পড়া মানে শুধু যা দেখা যায় বা শোনা যায়, তা উপলব্ধি করা নয়; বরং যা অনুচ্চারিত, যা অদৃশ্য এবং যা অনুভব করা যায় না, সেটিকে উপলব্ধি করা।
বেঁচে থাকা যেকোনো মানুষের জীবন একটি জীবন্ত গল্প। তাদের অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন, হতাশা এবং সংগ্রামের কাহিনী তাদের হৃদয়ে লেখা থাকে। এই না বলা গল্পগুলো বুঝতে পারা মানে তাদের জটিলতা, দ্বন্দ্ব এবং সৌন্দর্যকে অনুভব করা। আমি যখন কাউকে পড়ি, তখন শুধু তাদের নয়, নিজেকেও নতুন করে জানতে পারি। এ যেন অন্যের ভেতর দিয়ে নিজেকে আবিষ্কারের এক নীরব যাত্রা।
মানুষের আচরণ বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞান একটি বিশাল ভিত্তি দেয়। মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স বলেছিলেন, ‘মানুষকে বিচার ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে’। কাউকে বোঝার জন্য আগে তাদের প্রতি খোলা হৃদয় এবং নিরপেক্ষ মন নিয়ে তাকাতে হয়।
শরীরের ভাষা এবং নীরবতা অনেক সময় শব্দের চেয়েও শক্তিশালী। আলবার্ট মেহরাবিয়ান দেখিয়েছিলেন, মানুষের অনুভূতির ৯৩ শতাংশ অমৌখিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। একঝলক দৃষ্টি, এক টুকরো নীরবতা, কিংবা একটি সামান্য অঙ্গভঙ্গি- সবই আমাদের মনের অবস্থা প্রকাশ করে।
ফেনোমেনোলজির দার্শনিক হাইডেগার এবং হুসারল এই জটিলতাকে ‘Lebenswelt’ বা জীবনের অভ্যন্তরীণ জগত নামে অভিহিত করেছিলেন। মানুষকে পড়ার সময় আমি তাদের জীবনের এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি- যা তাদের আসল কষ্ট, বেদনা, সুখ, আকাক্সক্ষাকে প্রকাশ করে।
মানুষের প্রকৃতি সবসময় দ্বৈত। এক দিকে আলোর ঝলকানি, অন্য দিকে ছায়ার আড়াল। ফ্রিডরিখ নিৎশে বলেছিলেন, ‘মানুষ তার দ্বন্দ্বের কারাগারে বন্দী’। কেউকে বাইরে থেকে যে আনন্দে ভরপুর মনে হয়, তার মনের গভীরে হয়তো অদৃশ্য কষ্ট লুকিয়ে থাকে। আবার বাইরে কারো কঠোরতা হয়তো মনের ভেতর নরম এক একান্ত সংযোগের আকাক্সক্ষা।
কার্ল ইয়াংয়ের ছায়া তত্ত্ব এই দ্বৈধতাকে স্বীকার করে নেয়। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু দিক থাকে, যা আমরা লুকাই বা দমন করি। মানুষ পড়া মানে এই লুকানো দিকগুলোকে বিচার ছাড়াই গ্রহণ করা।
সহানুভূতি হলো মানুষ পড়ার মূলমন্ত্র। ড্যানিয়েল গোলম্যান এটিকে আবেগগত বুদ্ধিমত্তার মূল উপাদান বলে অভিহিত করেছেন। এটি কেবল অন্যের অনুভূতি বোঝা নয়; বরং তাদের যন্ত্রণাকে নিজের ভেতর অনুভব করার ক্ষমতা।
স্টোইক দার্শনিক এপিকটেটাস বলেছিলেন, ‘আমাদের দু’টি কান এবং একটি মুখ রয়েছে যাতে আমরা বেশি শুনতে পারি এবং কম কথা বলি।’ সহানুভূতির সাথে শোনা মানে অন্যের অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করা। এমনটি মানুষের সাথে সংযোগ তৈরি করে এবং মনকে প্রসারিত করে।
মানুষকে পড়তে গিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরের জগতকেও আবিষ্কার করি। সোরেন কিয়েরকেগার্ডের ভাষায়, ‘নিজেকে জানা মানে অন্যের মাধ্যমে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা’।
আমি যখন মানুষের অনুভূতি, দ্বন্দ্ব এবং আকাক্সক্ষা পড়ি, তখন দেখি সেগুলো আমার নিজের জীবনেরই এক প্রতিফলন। তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি বুঝি, আমরা সবাই একই রকম গল্পের অংশ, যেখানে আবেগ, কষ্ট এবং আশা আমাদের একসূত্রে বাঁধে।
মানুষ পড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কাউকে বিচার না করা। দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্র বলেছিলেন, ‘অন্য মানুষ আমাদের মনের আয়না’। তাদের বিচার না করে বোঝার চেষ্টা করা মানে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। মানুষ পড়ার শিল্প আমাদের হৃদয়ে মানবিক বোধের জন্ম দেয়। এই বোধ আমাদের আন্তঃসম্পর্ককে গভীর করে, বিশ্বকে আরো সুন্দর করে তোলে।
মানুষের জীবন একটি চলমান বই। জীবনের প্রতিটি পাতা নতুন কিছু শেখায়। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের অভিজ্ঞতা, সুখ এবং দুঃখের গল্প লেখা হয় সেখানে। দার্শনিক হেরাক্লিটাসের কথায়, ‘আপনি একই নদীতে দুইবার পা রাখতে পারবেন না।’ মানুষও সেই নদীর মতো; প্রতিনিয়ত বদলায়, প্রবাহিত হয়।
আমি যখন কোনো ভিড়ের মধ্যে একাকী দাঁড়াই, মানুষ পর্যবেক্ষণ করি, তখন তাদের জীবনের এই গতিশীলতাকে উপলব্ধি করি। তাদের জীবন আমাকে শিখিয়ে দেয় মানবতা, সহানুভূতি এবং আত্ম-অনুসন্ধানের পাঠ।
মানুষ পড়ার শিল্প এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। হাজারো গল্পের ঝুলি বসে থাকে সেখানে। এই আর্ট কেবল একটি দক্ষতা নয়; বরং এটি মনস্তত্ত্ব, দর্শন এবং মানবিকতার এক অনন্য মিশ্রণ। প্রতিটি মানুষ এক মহাকাব্য- ভাঙা টুকরো আর আলো-ছায়ার মিশ্রণে গড়া। তাদের গল্প পড়তে গিয়ে আমি আমার নিজের জীবনের গল্পটিকেও নতুনভাবে লিখে যাই, পড়ে যাই।
তাই জীবনের প্রতিটি মানুষই একটি অমূল্য পাঠ। তাদের জীবনের নীরব ভাষা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সংযোগ, বোঝাপড়া এবং সহানুভূতির চর্চাই আমাদের একে একে মানুষ করে তোলে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা