শীতে পল্লী স্মৃৃতি
- শহিদুল ইসলাম
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:১৫
পৌষ-মাঘ শীতকাল। শীতের সকালে লেপ মুড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা মজার। ঘুমের ভেতর থেকে স্বপ্ন দেখতাম বড় হওয়ার। বাল্যকালে শুনেছি আমি ফুটবল খুব পছন্দ করতাম। তাই লেপের ভেতর থেকে ঘুমের ঘোরে ফুটবলে লাথি মেরে বলতাম- "ঐধভ নধষষ রং মড়রহম." শৈশব তথা শিশুকালে কেন বলতাম তা আমার মনে নেই। পরবর্তীতে ক্রিকেট খেলা হাইস্কুলে থাকতে দেখতাম এবং খেলতাম। শীতের সকালে দূর্বাঘাসের ওপর শিশির পড়া ভোরে সূর্যের কিরণে মুক্তা দানার মতো চিকমিক করে। সকালে আমাদের জমিতে খেজুরের গাছ ছিল তা থেকে খেজুরের রস প্রায় প্রতিদিন বাড়িতে আনা হতো। কোনো সময় উলা রস আবার কোনো সময় জিরিন রস। সকালে ঘুমে থেকে ওঠে বাইরে মাদুর পেতে বসতাম।
ঠাণ্ডায় শীতে গা হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যেত। সকালের এক চিলতে রোদ যেন সোনার চেয়ে দামি। তার পর জিরিন রস খাওয়ার পালা। বাঁকা স্টিলের দুই গ্লাস জিরিন রস না খেলে যেন সকালটা ভালো যেত না। গ্রামের লোকজন সকালে ওঠে আগুন পুড়ানোর পাল্লা করত। তারা খড়কুটা, কাগজ এবং বিচুলি দ্বারা আগুন তৈরি করত। তার পর হাত পা ছ্যাকার পালা পড়তো। চারদিকে কুয়াশা পড়তো। কুয়াশায় পাশের মানুষ চেনা দুষ্কর হয়ে পড়তো। একে শীত তার পর কুয়াশা এটা যেন অন্যরকম আমেজ সৃষ্টি করে তুলত। গোসল করার জন্য পানি গরম করা হতো। গরম কাপড়, টুপি, চাদর পারার রেওয়াজ পরিণত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে কম্বল ও জাম্পার পরা হতো। রৌদ্র কড়া হলে আমরা মাদুর থেকে ঘরে এসে সকালের খাবার গ্রহণ করে স্কুলে খেতাম। শীতের দিনে জব্বার স্যার আর ইসলাম স্যার জ্যাকেট এবং টুপি পরিধান করে আসতেন এবং ছাত্রদের খোলা মাঠে রৌদ্রের ভেতর পড়াতেন। জানুয়ারি মাসে নতুন বছর শুরু হওয়ায় আমরা নতুন ক্লাসে নতুন নতুন বই পেতাম। নতুন নতুন বইয়ের গন্ধে মন ভরে যেত। নতুন বইয়ের একটি কবিতা আজও আমার মনে পড়ে। সেটা গ্রামকেন্দ্রিক কবিতা বলে আরো গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।
সকালে খেজুরের রস জ্বাল দেয়ার পালা চলে। তার পর গুড় পাটালি খাওয়ার মজা অন্য ধরনের। উতলে যাওয়ার খেজুরের রসের ভেতর খোলামুচি পাটি শাপটা পিঠা ভিজানো এবং কাগজি লেবুর পাতা এবং এলাচ দিয়ে যেন সৌরভ ও স্বাদ আরো বাড়িয়ে তুলল। ভাপা, পুলি, পাটি সাপটা পিঠা আর ক্ষির বাড়িতে বাড়িতে এমনভাবে তৈরি হতো যেন আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হতো। আমাদের বাড়িতে ছিল চারটি গাভী। গাভীর দুধ কোনো সময় ফুরাতো না। স্কুল থেকে এসে দুপুরের পর বিকেলে জালরত দুধের ক্রিম কালার সর প্রায়ই আসার বরাতে ছিল, যা খেতে যেমন মধুর তেমন পুষ্টিকর। শীতের রাত এলে আমরা সবাই হারিকেনের আলোয় পড়া লেখা করতাম। এ হারিকেনের আলোই ছিল আমাদের পড়াশোনা করার একমাত্র সম্বল। রাত গভীর হলে ফুঁটায় ফুঁটায় শিশির পড়ে এবং লেপের ভেতর ঘুমের আয়োজন চলে। ঠাণ্ডা কালা পানি মাঝে মাঝে গরম পানিও জুটত।
শীতের রাতে আমাদের শৈশবকালে বুড়ো স্যার পড়াতেন। ১৫-২০টি পরিবারের ছেলেমেয়েসহ সবাই চেয়ারম্যান নানার বাড়িতে পড়ার আয়োজন ছিল মনোমুগ্ধকর। ১৫-২০ জন ছাত্র ছিলাম আমরা বুড়ো স্যারের। বুড়ো স্যারের লাঠিটা ছিল বাঁশের কুঞ্চির তৈরি। মাঝে মাঝে তৈল মালিশ করতেন লাঠিতে। তাই দিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করতেন যাতে আমরা শৃঙ্খলতার সাথে পড়াশোনা করি। বুড়ো স্যার ছিলেন বেটো গোছের কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা মধুর স্বরে কথা বলতেন। তিনি আমাদের বাল্যকালে বড় হওয়ার শিক্ষা দিতেন। শীতকাল এলে মিলাদ মাহফিলের রেওয়াজ পড়ত। আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রতি বছর ইসলামী জলসা হতো। হ্যাচাং লাইটের আলো আর চটের বিছানা ছিল বসার। মিলাদের সুজি অনেক সময় প্লেটে দেয়া হতো। অনেক সময় যখন প্লেট না জুটতো তখন কলার পাতা কেটে প্লেট তৈরি করা হতো এবং পাতার ওপর খাবারটি পরিবেশন করা হতো।
শীতকালে মাঠে মাঠে শীতকালীন সবজি চাষ করা হতো। পাতাকপি, ফুলকপি, পেঁয়াজ, সরিষা, গোল আলু, গম চাষ করা হতো মাঠজুড়ে। আলু, কফি ক্ষেতে পানি সেচ দেয়া হতো। গভীর অথবা অগভীর নলকূপ ছিল এর ভরসা। ড্রেনের পানি থেকে বাসন দ্বারা সেচ দিয়ে অনেক সময় পানি সরবরাহ করা হতো ক্ষেতে। গ্রামের সরিষা ক্ষেত মাঠে ভরে থাকত। চোখ ধাঁধানো রূপসী বাংলার অপরূপ দৃশ্য। চারদিকে হলুদের সমারোহ। এমন কি সরিষা ফুলের মধু ও আমাদের মুখের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে। শীতের দিনে গম ক্ষেত পাখি তাড়াবার জন্য আমরা মিলেমিশে ঝাঁক বেঁধে যেতাম এবং সন্ধ্যার সময় পাখি যখন বাসায় ফিরতো তখন বাসায় ফিরতাম। আলু তোলার মৌসুম যখন পড়তো তখন আমরা আলু তুলে বাড়িতে এনে মাটির ভেতর ভরে বল মতো তৈরি করে চুলার গনগনে আগুনের ভেতর রাখতাম। পরে সিদ্ধ হলে মাটি ভেঙে আলু বের করে তার পর খেতাম। শীতকালীন মহড়ায় স্কুলের প্রশিক্ষণ চলতো ভালো। আমি ছিলাম স্কাউট লিডার। চতুর্থ বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্কাউট জাম্বুরি ‘৮৯ সালে মৌচাক গাজীপুরের অংশগ্রহণ করেছিলাম। শীতে হাত-পা কম্পমান। গোসলে সাহস হতো না। তার পর প্রশিক্ষণের তাড়া, আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল। জাম্বুরিতে স্টিকার পেয়ে মেডেল পাওয়ার মজাই আলাদা। আমাদের সাথে বাঁশ ও বেতের কাজ জানাওয়ালা এবং ভাত-তরকারি পাক করার বিশেষজ্ঞ ছিল। যার কারণে আমরা জেলা ফার্স্ট হয়েছিলাম। শীতের দিনের স্মৃতি আর না বাড়িয়ে শেষ করছি। আশা করি শীতে প্রকৃতি যখন বিবর্ণ হয়ে পড়ে, গাছের পাতা ঝড়ে যায় তখন বর্ণিল হয়ে উঠবে সবার জীবন।
লেখক : প্রভাষক - দর্শন বিভাগ
সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা