০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ২ শাবান ১৪৪৬
`

আদর্শ গ্রাম

-


ছোট শরীফপুর- একটি নাম, একটি গল্প। ছবির মতো সাজানো এই গ্রামে প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে মানুষের জীবন বয়ে চলে। এখানে গাছপালা মায়ায় জড়ানো, পাখিদের গান মিশে থাকে বাতাসে। ছোট ছোট ঘর, সরু মাটির পথ, আর গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাসিখুশি মানুষ- সবকিছু যেন একটি রঙিন ক্যানভাস। এই গ্রামের প্রাণবন্ত মেয়ে লামইয়া, বয়স মাত্র ছয়।
লামইয়া এমনই এক শিশু, যার কৌতূহলী মনের সামনে যেন সারা পৃথিবী ছোট। তার মাথায় সারাক্ষণ ঘোরে হাজারো প্রশস্ত মেঘ কেন ভেসে যায়? আকাশ কেন নীল? গাছেরা কথা বলে না কেন? সারা দিনের এইসব প্রশ্ন জমিয়ে রাখে রাতের জন্য, বাবার কাছে নালিশ করার মতো করে। তার বাবাই তার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, যার কাছে সব উত্তর আছে।
সেদিন সকাল ছিল অন্য রকম। সূর্যের আলোয় পুকুরের জল ঝলমল করছিল। লামইয়া বাইরে দৌড়ে যায়। তার সঙ্গী মুনিয়া তাকে ডাকছিল। মুনিয়া তার চেয়ে দুই বছরের বড়, তবু তারা একে অন্যের অদ্ভুত ভালো বন্ধু। মুনিয়া তাকে নিয়ে তালতলার পুকুর পাড়ে যায়। ওখানে বসে তারা জলের দিকে তাকায়।
‘মুনিয়া, এই পুকুর এত শান্ত কেন?’ লামইয়া জানতে চায়।

মুনিয়া মাথা চুলকায়। একটু ভেবে বলে, ‘হয়তো পুকুর মা চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে।’
লামইয়া চোখ বড় বড় করে তাকায়, ‘পুকুরেরও মা থাকে? কী অদ্ভুত কথা!’
মুনিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। ‘সবকিছুরই তো মা থাকে। পুকুরেরও নিশ্চয়ই আছে।’
এই নতুন ধারণা নিয়ে লামইয়া দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে। সে ভীষণ কৌতূহলী। রাতে বাবার কাছে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেই।
বিকেলে গ্রামের শিশুদের আনন্দে মেতে ওঠার সময়। সবাই মিলে দল বেঁধে খেলে চোর-পুলিশ। লামইয়া ‘চোর’ হয়েছে, আর সবাই তাকে ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে। খেলার মাঝে হঠাৎ সে গাছের নিচে লুকিয়ে পড়ে। সেখানে বসে তার চোখে পড়ে ছোট্ট একটি পিঁপড়া, যা তার থেকে ১০ গুণ বড় একটি দানা টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।

পিঁপড়ার পথ অনুসরণ করে লামইয়া দেখতে পায়, ওটা নিজের দলের কাছে গিয়ে দানাটা ভাগ করে দিলো। লামইয়া অবাক হয়ে ভাবে, ‘পিঁপড়ারা এত ছোট! তবুও কত পরিশ্রম করে, আবার দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে!’ সে ঠিক করে, রাতে বাবার কাছে এই বিষয়েও জানতে চাইবে।
সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরলেন। তার চেহারায় সারাদিনের ক্লান্তি, তবুও মেয়ে কাছে এলে মুখে একরাশ হাসি। লামইয়া বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘বাবা, পুকুরের মা থাকে? মুনিয়া বলেছে, কিন্তু আমি তো দেখিনি!’
বাবা একটু ভেবে বলেন, ‘প্রকৃতি হচ্ছে পুকুরের মা। প্রকৃতিই পুকুর তৈরি করেছে। পুকুরে মাছ, জলজ প্রাণী, আর চারপাশের গাছপালা- সবই প্রকৃতির যতেœ বেড়ে ওঠে। তাই আমরা বলতে পারি, প্রকৃতি শুধু পুকুরেরই নয়, আমাদের সবার মা।’

লামইয়ার চোখ চিকচিক করে ওঠে। ‘তাহলে প্রকৃতি আমারও মা!’
বাবা হাসেন। ‘হ্যাঁ, মা। প্রকৃতি আমাদের সবার মা। আমরা যত্ন নিলে প্রকৃতি আমাদের আরো অনেক সুন্দর করে রাখবে।’
এরপর লামইয়া বলে, ‘আর পিঁপড়ারা? ওরা এত ছোট, কিন্তু ওদের দলবদ্ধভাবে কাজ করা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে।’
বাবা বলেন, ‘পিঁপড়ারা অনেক পরিশ্রমী প্রাণী। তারা আমাদের শেখায়, একসাথে কাজ করলে অনেক বড় কাজও সহজে করা যায়।’
লামইয়া খুশি মনে বলে, ‘তাহলে আমাদের ছো টশরীফপুরও তো এক পিঁপড়ার দল, তাই না বাবা? আমরা সবাই মিলে কাজ করি!’
বাবা মেয়েকে কাছে টেনে আদর করেন। ‘ঠিক বলেছ, মা। আমাদের গ্রামও একসাথে থাকার আর ভালোবাসার একটা সুন্দর উদাহরণ।’
পরের দিন সকালে লামইয়া জেগে উঠে নতুন একটি পরিকল্পনা করে। সে তার বন্ধুদের ডেকে বলে, ‘আমরা সবাই মিলে তালতলার পুকুর পরিষ্কার করব। এতে পুকুর মা আরো খুশি হবে!’

শুরু হয় তাদের ছোট ছোট হাতে বড় একটি কাজ। মুনিয়া, লামইয়া আর তাদের বন্ধুরা দল বেঁধে পুকুরের চারপাশে পড়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে থাকে। গ্রামের বড়রা তাদের দেখে অবাক হন। একজন বলেন, ‘এই ছোট্ট শিশুরা আমাদের শেখাচ্ছে, কিভাবে নিজের গ্রামটাকে ভালোবাসতে হয়।’
পুকুর পরিষ্কার হয়ে গেলে লামইয়া বাবাকে গিয়ে বলে, ‘দেখো, বাবা! আমরা পিঁপড়ার মতো দলবেঁধে কাজ করেছি। পুকুর মাকে এখন কত সুন্দর লাগছে!’
বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘তুমি অনেক ভালো, আমাদের গ্রামের গর্ব। তোমার এই ভালোবাসা আর উদ্যোগে এক দিন আমাদের ছোট শরীফপুর আরো সুন্দর হবে।’

ছোট শরীফপুরের প্রতিটি দিনই যেন একেকটি নতুন গল্প। লামইয়া আর তার মতো কৌতূহলী শিশুরা গ্রামটিকে প্রাণবন্ত রাখে। তাদের প্রশ্ন, তাদের মুগ্ধতা আর তাদের ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রামের মানুষদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
পুকুর পরিষ্কারের সেই ঘটনা যেন গ্রামের মধ্যে একটি ঢেউ তুলল। বড়রা ভাবতে শুরু করলেন, প্রকৃতিকে নিয়ে বাচ্চাদের মতো করে আমরাও কি একটু বেশি যতœবান হতে পারি না? গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক আমানত মিয়া বললেন, ‘এই শিশুদের মধ্যে আমরা যদি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এই বীজ বুনে দিতে পারি, তারা এক দিন পৃথিবীর জন্য এক আশীর্বাদ হবে।’
এরপর থেকে গ্রামে ছোটখাটো আরো অনেক উদ্যোগ শুরু হলো। কেউ পুকুরের পাশে গাছ লাগাল, কেউ গ্রামের রাস্তা পরিষ্কার করল। ছোট শরীফপুর যেন ধীরে ধীরে একটি উদাহরণ হয়ে উঠছিল।

এক সন্ধ্যায় লামইয়া আবার বাবার কাছে ছুটে গেল। তার চোখে ঝিলিক দেয়া উচ্ছ্বাস।
‘বাবা, আমরা শুধু ছোটশরীফপুরকে নয়, পাশের গ্রামগুলোও সুন্দর করে তুলতে পারি না?’
বাবা মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনলেন। ‘কীভাবে করবে তুমি?’
লামইয়া গম্ভীর মুখে বলল, ‘পড়ালেখা শেষ করে আমি বড় হবো। তারপর সবার সাথে মিলে বড় কাজ করব। পুকুর, নদী, গাছপালা- সবকিছু সুন্দর করে তুলব। আমি চাই সবাই যেন আমাদের ছোট শরীফপুরের মতো সব গ্রামকে ভালোবাসে।’
বাবা মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন। ‘তোমার এই স্বপ্নটুকুই আমাদের আশা। যদি তোমরা এগিয়ে যাও, তাহলে এক দিন পুরো দেশ তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’
ছোট শরীফপুরে লামইয়ার মতো আরো অনেক শিশু ছিল। তাদের মধ্যেই ছিল রুহান, তার বয়স সাত বছর। সে ছিল গ্রামের সবচেয়ে চঞ্চল ছেলে। লামইয়ার সঙ্গে তার বন্ধুত্বটা ছিল অদ্ভুত রকমের। তারা একসাথে দুষ্টুমি করত, আবার সমস্যার সমাধানেও একসাথে মাথা খাটাত। পুকুর পরিষ্কারের কাজে রুহানের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। সে সবসময় বলত, ‘কাজ করতে গিয়ে মজা না পেলে কাজ করব কেন?’
পুকুর পরিষ্কার হওয়ার কয়েকদিন পর গ্রামে একটি মজার ঘটনা ঘটল। পুকুরের পাশেই ছিল একটি ছোট আমগাছ। রুহান একদিন সকালে উঠে দেখল, গাছের নিচে কচি আম পড়েছে। সে ভেবেছিল আমটি কেবল তার জন্য। কিন্তু আমটি কুড়াতে গিয়ে দেখল, লামইয়া আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে। দু’জনের মধ্যে তর্ক লেগে গেল, কেউই আম ছাড়তে রাজি নয়।

এটা দেখে গ্রামের বড়রা হাসতে লাগলেন। আমানত চাচা এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোমরা তো সবার জন্য কাজ করছ। এবার নিজে ভাগাভাগি করে খাওয়াও শিখবে কি না?’
তারা দু’জন লজ্জা পেয়ে আমটি দুই ভাগ করল। তারপর মজা করে খেতে খেতে আবার পুকুর পাড়ে এসে বসে পড়ল। লামইয়া বলল, ‘আমরা কি শুধু পুকুর পরিষ্কার করেই থামব? গ্রামের সব কাজেই তো আমাদের হাত লাগানো উচিত।’
রুহান মাথা নাড়ল। ‘ঠিক বলেছ। আমি তো ভাবছি, এবার গ্রামের সবাইকে নিয়ে বড় একটা অনুষ্ঠান করব। সেখানে আমরা গান গাইব, নাটক করব আর সবাইকে জানাব যে গ্রামটাকে ভালো রাখতে আমাদের সবার কাজ করতে হবে।’
এই ভাবনাটি খুব দ্রুত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। বড়রাও এতে যুক্ত হলেন। একটি সুন্দর সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে আয়োজন করা হলো এক বড় অনুষ্ঠান। সেখানে লামইয়া আর রুহান মিলে একটি গান গাইল। গানের কথা ছিল, ‘আমরা সবাই একসঙ্গে, গ্রামকে ভালোবাসি। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি, প্রকৃতির কাছে আসি।’
এই গানের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলেন, ছোটদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা কেবল কাজ নয়, এটি ভালোবাসার বন্ধনকেও আরো গভীর করছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
বর সাজিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে স্কুল কর্মচারীর রাজকীয় বিদায় কুমিল্লায় দর্শন পরিবারের দ্বিতীয় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত কুমিল্লায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৭৯ জনের নামে হত্যা মামলা, গ্রেফতার ৩ জুলাই বিপ্লব সাংবাদিকদের মূল্যায়নের সুযোগ করে দিয়েছে : মাহমুদুর রহমান জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছে পৌনে ২৭ হাজার কোটি টাকা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশ সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি : প্রধান উপদেষ্টা তাবলীগের বিরোধে প্রভাব পড়েনি বিশ্ব ইজতেমায় নিবন্ধন পেল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, প্রতীক ফুলকপি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে যে দুই দলকে দেখছেন পন্টিং-শাস্ত্রী জিপিএইচ ইস্পাতের আয়োজনে গ্র্যান্ড ইভেন্ট ‘জিপিএইচ মহারাজ দরবার’ অনুষ্ঠিত বই ছাপার আগে সেন্সরশিপ করার প্রশ্নই আসে না : সংস্কৃতি উপদেষ্টা

সকল