২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রেমিট্যান্স অর্জনে আরবি ভাষার গুরুত্ব

-


বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে আরবি চর্চা হয়। অমুসলিমরা আরবির চর্চা করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কিংবা ইসলামকে জানার জন্য। আর মুসলমানরা আরবি শেখে ধর্ম ও ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ধর্মীয় কারণ ছাড়াও অর্থনৈতিক কারণে আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হচ্ছে রেমিট্যান্স আর এই রেমিট্যান্সের বেশি ভাগ আসে আরব বিশ্ব থেকে। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০২০ সালে সব অধিবাসীরা ২১.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠায়। এই বিপুলসংখ্যক রেমিট্যান্সের ৭৩ শতাংশ আসে (GCC) Countries অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশাল শ্রমবাজারের প্রধান অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা এবং তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার আরো উদ্যোগী হবে।

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ জীবিকার তাগিদে কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে আরব বিশ্বে। অথচ আরবি ভাষার সাথে তাদের পূর্ব কোনো সম্পর্ক থাকছে না। তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথাযোগ্য বেতনভাতা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিশাল শ্রমশক্তি আরবি ভাষায় সুদক্ষ না হওয়ায় যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না। বিশিষ্ট গবেষক ড. মো: আবু বকর সিদ্দিক বলেন, কাজের ক্ষেত্রে একসময় ভাষাগত দক্ষতা না থাকলেও তেমন সমস্যা হতো না, কিন্তু বর্তমানে বিদেশী কোম্পানিগুলো আরবি ভাষা জানা শ্রমশক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভারত, চীন, জাপান, কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো আমাদের দেশেও যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশগামী শ্রমশক্তিকে ভাষাগত দক্ষ করে প্রেরণ করা যেত, তাহলে আরবিভাষী দেশগুলোতে নিজেদের অবস্থান আরো মজবুত ও সুদৃঢ় করতে পারত এবং দেশের আরো অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা (foreign currency) আসত।

এসব বিবেচনায় জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দক্ষ ও পারদর্শী জনশক্তি (Skilled Manpower) তৈরি করার নিমিত্তে আরবি ভাষা শিক্ষা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি আরবের প্রাক্তন ইকোনমিক কাউন্সিলর ও মিনস্টার ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান " মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে আরবি ভাষা শিক্ষা অপরিহার্য " শীর্ষক সেমিনার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, আমরা আরবি ভাষা শিখি ধর্মীয় কারণে, কিন্তু দুনিয়ার কারণে আরবি ভাষা শিখেন ফিলিপিন, চাইনিজ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতীয়রা। আমি পুরো আরবি ভাষায় বক্তৃতা শুনেছি রিয়াদের চাইনিজ অ্যাম্বাসেডর ও শ্রীলঙ্কান অ্যাম্বাসরকে। আমার দেখা বাংলাদেশী সরকারি কর্মকর্তা যেমন : হজ কাউন্সিলর, জেদ্দা, ডিফেন্স অ্যাটাচে, রিয়াদ, সৌদি আরব, ডেপুটি চিপ অফ মিশনে রয়েছেন যারা আরবিতে অনর্গল কথা বলেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ভাষা শিক্ষা ও শিখানোর ব্যাপারে তৎপর। বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ১৯৯৭ সালে মরহুম শহীদুল
আলম আরবি ও ফারাসি ভাষা শিখানোর কোর্স চালু করেন যা২০০৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

আরবি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্টিজের আইইউটি-ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল অ্যাডুকেশন ডিপার্টমেন্ট প্রস্তুত রয়েছে। আমরা ওয়াইসির ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে অনলাইনে প্রশিক্ষণ অনায়াসে চালু করতে পারি। তাদের অফিসিয়াল ভাষা হলো আরবি ও ফারসি। আমাদের ডাক্তার, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের আরব বিশ্বে চাকরির পথ সুগম করতে দ্রুত অনলাইনে আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স কালো চালু করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার জেনারেল শিক্ষার পাঠ্যক্রমে আরবিকে অন্তর্ভুক্ত করাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি । তার সাথে সাথে এই ব্যবহারিক আরবি শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
দেশে রেমিট্যান্স অর্জনের ক্ষেত্রে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য কারণ দেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স অর্জনের শতকরা ৮০ ভাগ আসে আরবি ভাষাভাষী দেশ থেকে। অর্থনৈতিক এ গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারতের মতো একটি হিন্দু প্রধান দেশে আরবি ভাষাকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।
আরব বিশ্বে জনশক্তি রফতানির জন্য তাদেরকে আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলে। একইভাবে পাকিস্তানও সে দেশের নাগরিকদের আরবি ভাষায় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। অথচ আমরা আরবি ভাষাকে অবহেলার কারণে সৌদি আরবে অধিকাংশ বাঙালি নিম্ন পর্যায়ের কাজ করতে দেখা যায়। আরবি ভাষার অদক্ষ হওয়ার কারণে তারা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে শ্রমিকের মর্যাদা পায়। অপরপক্ষে আরবিতে দক্ষ হওয়ার কারণে ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রমিকদের অফিসিয়াল বিভিন্ন কাজে নিয়োগ পেতে দেখা যায়।

একটি সমীক্ষায় দেখ যায়, সৌদি আরব থেকে হাজার হাজার বাংলাদেশী যে রেমিট্যান্স পাঠায় তার চেয়ে বেশি পাঠান ডেনমার্কের মাত্র ৩০০ জন সৌদিতে কর্মরত ডেনিস নাগরিকরা।
সৌদি আরবের কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয় অনারবদের আরবি ভাষা পাঠদান পদ্ধতি এ বিষয়ে মাস্টার্স করার সুবাদে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে গিয়ে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ছোটখাটো ব্যবসা করতে যে সমস্যা আমি বাস্তবে দেখেছি, তা হচ্ছে বাংলাদেশীরা বাকালা বা ছোট মুদি দোকান খুলেন কিংবা নানা প্রকার ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত হন ফলে তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে তাকে একজন সুদানি না হয় মিসরীয়কে রাখতে হয়। যারা দৈনিক পত্রালাপ বা যোগাযোগ অথবা আইনগত কার্যদি সম্পন্ন করার জন্য তাদেরকে বিশাল অঙ্কের একটি অর্থ প্রদান করতে হয়। যদি ওই বাঙালি
ভালো করে আরবি জানত তাহলে তার এই বিশাল অঙ্কের অর্থ অপচয় হতো না।
তাই আরব বিশ্বে ভালোমানের চাকরির বা ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহারিক আরবি শিক্ষা করা আবশ্যক। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই ভাষা শিক্ষায় যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা একে বারে অপ্রতুল।
সাবেক শিক্ষার্থী, কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব


আরো সংবাদ



premium cement